রাজনীতিক ও পেশাদারদের ব্যস্ততা বাড়বে। বয়স্করা শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিন। ধনযোগ আছে। ... বিশদ
পবিত্র দিনটিকে চিনতে, জানতে, ভালোবাসতে শিখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। আমাদের প্রাণের কবি। ভালোবাসতে শিখিয়েছেন সমগ্র মাসটিকেই। ঋতুরঙ্গের কবি তিনি। প্রত্যেকটি ঋতু নিয়ে রচনা করেছেন গান, কবিতা। তবে গ্রীষ্মের প্রতি, বিশেষত বৈশাখের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ অনুরাগ। শুধুমাত্র জন্মমাস বলেই নয়, জীর্ণ পুরাতনকে ভাসিয়ে দিয়ে নতুনকে সাদরে বরণ করার নতুনতর দাবি নিয়ে আসে বলেই হয়তো বাংলা সনের প্রথম মাসটি ছিল তাঁর বিশেষ প্রিয়। আজীবন তিনি ছিলেন নতুনের পক্ষে। চেয়েছেন সমস্ত জরা, ব্যাধি বৈশাখী হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে অগ্নিস্নানে সবকিছু শুচিস্নিগ্ধ করতে। তাই লিখেছেন ‘মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই পয়লা বৈশাখ দিনটি নৃত্য, গীত ও নাট্যাভিনয়ের মধ্যে দিয়ে এক নতুন রূপ পেয়েছিল। যদিও তাঁর কাছে প্রতিটি সূর্যোদয় ছিল নূতন বছরের সূচনার মতোই। নববর্ষকে সাদরে বরণ করার সঙ্গে সঙ্গে ওই দিন আপামর বাঙালি বরণ করে নেয় রবীন্দ্রনাথকেও। এই রীতি চালু হয়েছিল কবিগুরুর জীবৎকালেই। ২৫ বৈশাখ জন্মদিন, তবে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র-জন্মদিন পালিত হতো পয়লা বৈশাখ। রবীন্দ্রস্নেহধন্যা চিত্রশিল্পী এবং সুলেখিকা রানি চন্দ লিখেছেন, ‘আজ নববর্ষ। এবারে ১লা বৈশাখেই গুরুদেবের জন্মোত্সব হবে... আগে থেকেই ঠিক করা হয়েছিল। ভোরবেলা কচি শালপাতার ঠোঙায় কিছু বেল জুঁই কামিনী তুলে ‘উদয়ন’-এর দক্ষিণের বারান্দায় গুরুদেবের হাতে দিয়ে তাঁকে প্রণাম করলুম। আজ অনেক আগে থেকেই গুরুদেব বারান্দায় এসে বসেছেন।’
২৫ বৈশাখ প্রবল জলকষ্টে জর্জরিত হতো রাঙামাটির দেশ বোলপুর শান্তিনিকেতন। সেই কারণেই হয়তো কবির জন্মদিন পালিত হতো বর্ষবরণের দিন। রবীন্দ্র-জীবনী পড়ে জানা যায়, কোনও এক বছর পয়লা বৈশাখের বিকেলে শান্তিনিকেতনে আছড়ে পড়েছিল তুমুল কালবৈশাখী। সকালে আম্রকুঞ্জে হয়েছে অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ নববর্ষের ভাষণ দিয়েছেন। বিকেলবেলা চা-পর্ব শেষ হওয়া মাত্র ঘন মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ। নেমে এল অন্ধকার। দিগন্ত ধুলোয় ঢেকে হইহই করে ছুটে এল ঝড়। কালবৈশাখী। কবিগুরু দু-হাত তুলে গেয়ে উঠলেন, ‘তাপস নিঃশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে।’ বর্ষবরণ এবং রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন-বরণ শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকদের কাছে হয়ে উঠেছিল অভিন্ন। আড়ম্বরের থেকেও বেশি দেখা যেত আন্তরিকতা।
রবীন্দ্রনাথ একা নন, বর্ষবরণ উৎসবে মেতে উঠত গোটা ঠাকুর পরিবার। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়ে জানা যায়, পয়লা বৈশাখ ছিল খাজনা আদায়ের প্রথম দিন। নিতান্তই বিষয়-কাজ। কিন্তু জমিদারি মহলে সেটা হয়ে উঠত পার্বণ। সবাই খুশি। যে খাজনা দেয় সেও, আর যে খাজনা বাক্সেতে ভর্তি করে, সেও। এর মধ্যে হিসেব মিলিয়ে দেখবার গন্ধ ছিল না।
নববর্ষ বরণ উপলক্ষ্যে ঠাকুরবাড়িতে মহা ধুমধামের সঙ্গে আয়োজিত হতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তার প্রস্তুতিপর্ব চলত বেশ কিছুদিন ধরে। দুই বেলা জমজমাট মহড়া বসত দোতলার বড় ঘরে। থাকতেন পরিবারের সদস্যরা। বর্ষবরণ উৎসবে তাঁরা অংশ নিতেন নাচ, গান ও অভিনয়ে। পয়লা বৈশাখের দিন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি থাকত ভূরিভোজ। এলাহি আয়োজন। বাড়ির টানা বারান্দায় মেঝেতে কার্পেটের আসন লম্বা করে বিছানো হতো। বসতেন পরিবারের সবাই। খাবার পরিবেশিত হতো কলাপাতায়। মাটির খুরিতে রকমারি পদ। থাকত কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল, নারকেল চিংড়ি, মাছের পোলাও, আম দিয়ে শোল মাছ এবং আরও নানাবিধ সুস্বাদু খাবার। ঠাকুর পরিবারে রান্না নিয়ে নিত্যনতুন চর্চা হতো। বিচিত্র ধরনের খাবার তৈরির প্রচলন ছিল। নববর্ষ উৎসবের দিনের পাতে তার প্রতিফলন ঘটত।
রবীন্দ্রনাথ নিজে ছিলেন দারুণ ভোজনরসিক। যদিও আহার করতেন পরিমিত। তাঁর উৎসাহে তৈরি হতো রকমারি খাবার। তিনি বিভিন্ন পদের নামকরণ করতেন। স্ত্রী মৃণালিনীর তৈরি নববর্ষের মিষ্টি ‘এলোঝেলো’ ছিল বিশেষ পছন্দের। কবি সেই মিষ্টির নতুন নামকরণ করেছিলেন ‘পরিবন্ধ’। বৈশাখের আনন্দ উৎসবে একবার মৃণালিনী কবির জন্য মানকচুর জিলিপি বানিয়েছিলেন।
সাংস্কৃতিক আয়োজন এবং রসনাতৃপ্তিকে কেন্দ্র করে বাঙালির বর্ষবরণ উৎসবের যে বিপুল আয়োজন, উনিশ শতকের শেষদিকে তার সূত্রপাত হয়েছিল কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারেই। ওই বিখ্যাত পরিবারের বর্ষবরণ উৎসবের অনুকরণে কলকাতা এবং পরবর্তী সময়ে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এই উৎসবের রেশ। যদিও তার আগে অষ্টাদশ শতকে নব্য বাঙালিদের বাবু কালচারের যুগে পয়লা বৈশাখের দিন কলকাতার উঠতি জমিদারের দল মেতে উঠতেন মোচ্ছবে। সাহেবদের খুশি করতে বসত বাইজি নাচের আসর, দেদার খানা-পিনা, ছুটত মদের ফোয়ারা। যদিও সেই উদযাপনের সঙ্গে রুচিশীল বাঙালি সংস্কৃতির ছিটেফোঁটা যোগ ছিল না।
বর্তমানে পয়লা বৈশাখ নিয়েছে উৎসবের চেহারা। বাঙালিরা অনেকেই পরেন নতুন পোশাক। দুপুরে কব্জি ডুবিয়ে চলে খাওয়াদাওয়া। পঞ্চব্যাঞ্জন সহযোগে। ব্যবসায়ীরা এইদিনে করেন হালখাতার পুজো। ভোর থেকেই বিভিন্ন মন্দিরে জমে ভিড়। লক্ষ্মী গণেশের পুজো সেরে তাঁরা হাজির হন নিজেদের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে। আসেন অতিথিরা। চলে খাওয়াদাওয়া। গল্পগুজব।
সন্ধেবেলায় বহু সাধারণ মানুষ দোকানে দোকানে যান হালখাতার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। সামান্য আয়োজন আন্তরিকতার ছোঁয়ায় অসামান্য হয়ে ওঠে। দোকানে পা রাখা মাত্র হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় ঠান্ডা পানীয়। তীব্র গরমে তাতে চুমুক দিলে মেলে অমৃতের স্বাদ। কোথাও আইসক্রিম দিলে ছোটদের আনন্দের সীমা থাকে না। ফেরার আগে দেওয়া হয় মিষ্টির বাক্স এবং ক্যালেন্ডার।
নতুন বঙ্গাব্দের ক্যালেন্ডার দেওয়ালে ঝোলালে আলোকিত হয়ে ওঠে ঘর। চোখ ঘোরে বিভিন্ন মাসের উপর। দুর্গাপুজো কবে? কালীপুজো কবে? যদিও এখন বাংলা ক্যালেন্ডারের তুলনায় ইংরেজি ক্যালেন্ডারের গুরুত্ব বেড়েছে। তবু বহু বাঙালি নিজেদের ঘরের দেওয়ালে বাংলা ক্যালেন্ডার সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। পুরোনো ঐতিহ্য মেনে।
পয়লা বৈশাখ আজও খেলার মাঠে ঘটা করে বার পুজো অনুষ্ঠিত হয়। প্রশিক্ষক, কর্মকর্তা, খেলোয়াড়দের উপস্থিতিতে। এই শুভ দিনে মহরত হয় কোনও কোনও চলচ্চিত্রের। তবে আগে আরও বেশি সংখ্যায় হতো।
বিভিন্ন রচনা পড়ে জানা যায়, বৈশাখে নয়, একটা সময় ভারতে বছর শুরু হতো বসন্তকালে। বছর গণনা করা হতো সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন দিয়ে। ঋগ্বেদের সময় থেকে দেখা যায়, মাসের নাম বোঝানো হতো নক্ষত্রের নাম দিয়ে এবং দিনের নাম বিভিন্ন দেবতা বা ঋষির নাম দিয়ে। অনেকের দাবি, বাংলা সন প্রবর্তন করেছেন গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক। ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল থেকে বঙ্গাব্দ গণনার শুরু। ওই দিন তিনি গৌড়ের সিংহাসনে বসেন। তাঁর অভিষেকের দিনটিকে স্মরণীয় করার জন্যই প্রচলন হয় বঙ্গাব্দের। তবে এর সপক্ষে কোনও জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
বরং সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতটি হল, বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন মোগল সম্রাট আকবর। প্রমাণ দিয়ে এই মতের স্বপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, ঐতিহাসিক কাশীপ্রসাদ জয়সওয়াল, অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রমুখ।
সে যাই হোক, খ্রিস্টাব্দের পাশাপাশি বঙ্গাব্দ ছিল, আছে, থাকবে। পয়লা জানুয়ারির মতোই বছর বছর সাড়ম্বরে পালিত হবে পয়লা বৈশাখ। সেটা যাতে হয় তার জন্য কিন্তু বাঙালি জাতিকে সচেষ্ট হতে হবে। হীনন্মন্যতা ভুলে উঁচু রাখতে হবে মাথা। হতে হবে আত্মসচেতন। শুধুমাত্র লোক দেখানো একটি দিন নয়, সারাবছর মনেপ্রাণে নির্ভেজাল বাঙালি থাকতে হবে। চিন্তাশক্তি সম্পন্ন বাঙালি। দারুণভাবে সজাগ। কারণ বাংলাসংস্কৃতি আজ কিছুটা হলেও বিপন্ন। চারদিকে চোখে পড়ছে অন্য ভাষা ও সংস্কৃতির আস্ফালন। আগ্রাসনের অপচেষ্টা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অনুকরণ প্রবৃত্তিও। এরমধ্যেই বাঙালি জাতিকে চলতে হবে নিজেদের লক্ষ্য স্থির রেখে। আধুনিক হলে দোষ নেই। তবে আত্মঘাতী বা আত্মবিস্মৃত হলে চলবে না। প্রয়োজনে করতে হবে আত্মশুদ্ধি। খুলে দিতে হবে দ্বার। ভিতরে ঢুকতে দিতে হবে আলো। মেলে দিতে হবে ডানা। এ তো আসলে রবীন্দ্রনাথেরই ভাবনা। এইভাবেই হতে হবে উদারমনা। আন্তর্জাতিক। ভাবের আদানপ্রদান ঘটাতে হবে অনন্তের সঙ্গে।
পাশাপাশি নিজের শিকড়ের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে রাখতে হবে নিবিড় যোগ। আঁকড়ে ধরতে হবে আপন ভাষা ও সংস্কৃতিকে। বাঙালিরা সেটা পারলে বাংলা ভাষা বাঁচবে। বাংলা সংস্কৃতি বাঁচবে। দিকে দিকে ইংরেজি মাধ্যম গজিয়ে উঠলেও টলবে না বাংলার ভিত। বাঙালির ভিত। তবেই কিন্তু বছর বছর পয়লা বৈশাখের নরম ভোরে বেরবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। বেরবে সুসজ্জিত প্রভাতফেরি। পায়ে পা মিলিয়ে রাজপথে হাঁটবেন ধুতি-পাঞ্জাবি, লালপাড় সাদা শাড়ি। মেতে উঠবেন নাচে, গানে, কবিতায়। সমস্বরে গীত হবে ‘হে নূতন।’