বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
গোল্ড ফ্লেকের প্যাকেটটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ফেলুদা। প্রায় মিনিট দশেক। তোপসে মুম্বই গিয়েছে। শেয়ার বাজার সংক্রান্ত একটা কাজে। ব্যাপারটা ও সত্যিই বোঝে। মাঝেমাঝেই হিল্লিদিল্লি করতে হয়। ফেলুদার স্যাটেলাইট হয়ে থাকার এখন আর দরকার হয় না। বহু বছর কেস থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে ফেলুদা। মাঝে মাঝে ইংরেজি উপন্যাস বাংলায় অনুবাদ করে। তার অবশ্য বেশ ডিমান্ড। ওতেই নিজেরটা চলে যায়। সব বদলে গিয়েছে। চারমিনারটাও। বছর তিনেক আগেও রবীন্দ্র সদনের কাছে একটা দোকান ধরা ছিল ফেলুদার। ওখান থেকেই আনিয়ে নিত। এখন আর সেটাও মেলে না। অগত্যা গোল্ড ফ্লেক। বিরক্ত হয়ে এবার ফেলুদা ঠিক করেছে, আর নয়। ছেড়েই দেব। তোপসেরও অবশ্য তাতে প্রচ্ছন্ন উস্কানি আছে। আর মাঝে মাঝে শিকড় নড়ানোর চেষ্টা। এবার বলেছিল, চলো আমার সঙ্গে মুম্বই। একটু ঘুরে আসবে। শিবাজি কাসল এখন কেমন আছে, সেটাও না হয় দেখে আসা যাবে। ফেলুদা যায়নি। বেশি জোরাজুরি করা যায় না। এই বয়সেও হয়তো গাঁট্টা বসিয়ে দেবে। এখনও সে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। বেশি বললে একটাই উত্তর, ‘ল্যান্ড লাইনে তো দিব্যি চলে যাচ্ছে।’ তোপসে যাওয়ার পর ফেলুদা একদিন পালসিট থেকে ঘুরে এসেছে, একদিন দুপুরবেলায় গড়পারের রাস্তায় হেঁটে বিকেলে বাড়ি ফিরেছে, দু’দিন কলেজ স্ট্রিটে গিয়েছে, একদিন ঢুঁ মেরেছে নিউ মার্কেটের কিউরিও শপে, আর আজ বেরনোর মুখে ল্যান্ড লাইনে একটা ফোন পেয়ে জামাকাপড় বদলে আবার বসে পড়েছে বৈঠকখানার সোফায়। তখন থেকেই নজর আটকে গোল্ড ফ্লেকের প্যাকেটে। ঠিক তার পাশে রাখা না বই, না ডায়েরি, না নোটবই গোছের বস্তু।
কলিং বেলটা বাজল। ঘড়ির দিকে তাকাল ফেলুদা। পারফেক্ট ৩টে ৪০। ভদ্রলোক ঠিক এই টাইমটাই দিয়েছিলেন। নাম বলেননি। শুধু বলেছিলেন, ‘আপনার কাছে আমার খুব ব্যক্তিগত একটা জিনিস এসে গিয়েছে। ওটা নিতে যাব।’
—কী জিনিস বলুন তো?
—আপনি জানেন। যদিও জেনেবুঝে নেননি। নিছক কৌতূহল। তাও জিনিসটা আমার। ওটা ফিরিয়ে দিলে খুব ভালো হয়।
—প্রমাণ করতে পারবেন, ওটা আপনার?
—পারব। আসছি আমি। ঠিক ২০ মিনিটে।
দরজা খুলতেই একচিলতে হাসি খেলে গেল ফেলুদার ঠোঁটে। একমাথা টাক। এবড়োখেবড়ো ছুঁচলো পাকা দাড়ি। গোল সোনালি ফ্রেমের চশমার মাঝে জ্বলজ্বল করছে দুটো চোখ। বাঁদিকের কাচটা খানিক চিড় খেয়েছে। তাতেও চোখের ঔজ্জ্বল্য ঢাকা পড়েনি। এই গরমেও বাদামি রঙের কোট ঝুলছে গায়ে। ধুলোর আস্তরণ রংটা আরও বেশি বাদামি করে দিয়েছে।
—চেনা ঠেকল বুঝি?
—খুব।
—অথচ সাক্ষাৎ আমাদের এই প্রথম!
—ঠিক।
দরজাটা বন্ধ করল ফেলুদা। রজনী সেন স্ট্রিটের বাড়িতে প্রথমবার পদার্পণ ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর।
—আমি নিশ্চয়ই সোফার পাশের চেয়ারটায় বসব?
হেসে ফেলল ফেলুদা। ‘আপনি সোফাতেও বসতে পারেন।’
—নাঃ। ওটা আপনার জায়গা।
বসে পড়লেন বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি। খানিকক্ষণ ফেলুদার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘তাহলে এবার দিন!’
—আগে তো আপনাকে প্রমাণ দিতে হবে।
টেবিল থেকে দেশলাইটা তুলে নিলেন তিনি। ধীরেসুস্থে একটা কাঠি বের করলেন। ফস করে জ্বালিয়ে তুলে নিলেন ডায়েরিটা। উসখুস করে উঠল ফেলুদা। কিন্তু কিছু বলল না। ভদ্রলোক আগুনটা ধরলেন ডায়েরির নীচে। এটাই ভেবেছিল ফেলুদা।
—আর কিছু প্রমাণ দিতে হবে?
—নাঃ।
—প্রহ্লাদকে কোথায় পেলেন?
—কলেজ স্ট্রিটে। ফুটপাতের ধারে বসেছিল ডায়েরিটা নিয়ে। দেখব বলে চাইতেই দিয়ে দিল। খটকা লেগেছিল। জিজ্ঞেসও করেছিলাম। কিন্তু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কোনও উত্তরই দিল না। পরের দিন আবার গিয়েছিলাম। গোটা চত্বর খুঁজেও পাইনি। বুঝলাম, আপনি তার খোঁজ পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু এরপরও আমার খটকা অন্য জায়গায়। আপনি আমার হদিশ পেলেন কীভাবে?
হাসলেন ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। ‘আমার ডায়েরিটায় আসলে একটা বিশেষ ট্রান্সমিটার লাগানো আছে। ওটা খালি চোখে দেখা যায় না। আণুবীক্ষণিক সার্কিট তৈরি করে সেগুলোকে বিশেষ একটা তরলের মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছি। পাতায় কয়েক ড্রপ ছড়িয়ে দিতে হয়। শুষে নেয়। কিচ্ছুটি বোঝা যায় না। এমনিতে সাড়াশব্দ করবে না। কিন্তু আমি, প্রহ্লাদ আর নিউটন ছাড়া অন্য কারও হাতে পড়লেই সিগন্যাল পৌঁছে যাবে আমার কাছে। ভুলটা হয়েছে অন্য জায়গায়। প্রহ্লাদকেও কয়েক ড্রপ খাইয়ে দেওয়া উচিত ছিল। ভেবেওছিলাম। কিন্তু বিধুশেখর তাতে লোহার দুই হাত ঠং ঠং করে বাজিয়ে এমন বিশ্রীভাবে হাসল, মন বদলে ফেললাম। গ্রে ম্যাটার বলে কিছু যে প্রহ্লাদের মাথায় আছে, সেটা তো ও বিশ্বাসই করে না। ভাবটা এমন, প্রহ্লাদ যাবেটা কোথায়?
—আপনি ছিলেন কোথায়?
—গিরিডিতেই। কিন্তু অন্য একটা ফ্রিকোয়েন্সিতে। যে গবেষণাটা করছি, তা আজকের দুনিয়ায় বসে করা যাবে না। কৌতূহলে সমস্যা নেই। এই ফ্রিকোয়েন্সিতে বাগড়া দেওয়ার লোক বড্ড বেড়ে গিয়েছে।
—কী নিয়ে গবেষণা?
—ওটা বরং থাক। আপনি বলুন... এটাকে কি কেস হিসেবে দেখবেন?
চোখ দুটোয় হাসি ছড়িয়ে গেল ফেলুদার... ‘কোনটা বলুন তো?’
—এই যে গত কয়েকদিনে আপনি যা যা খুঁজে পেয়েছেন, সবের মধ্যে একটা যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন!
—কী কী পেয়েছি, আপনি জানেন?
—না, তা জানি না। তবে টেলিপ্যাথি বলছে, বেশ কয়েকটা সুতো। আর সেগুলো আপনি জোড়ার চেষ্টা করছেন।
—ঠিকই বলেছেন। আপনি গবেষণার ব্যাপারে কিছু না বলতে পারেন, আমি সুতোগুলোর কথা আপনাকে বলব।
প্রফেসর শঙ্কু এবার হো হো করে হেসে উঠলেন। ‘তেমন কিছু না। বলতে চাইছি না কারণ, ওই বিষয়বস্তুটা শুনে আপনার খুব একটা ভালো লাগবে না। যাই হোক, আগে আপনারটা শুনি। ততক্ষণে যদি আমার মন বদলে যায়, বলব।’
—প্রথম গেসলুম পালসিট। কেন, সেই ব্যাখ্যা দিতে পারব না। বলতে পারেন টেলিপ্যাথি! গত কয়েকদিন ধরে ভদ্রলোক আমাকে বড্ড টানছেন। ৩০ বছরে এমনটা একবারের জন্য ফিল হয়নি। অথচ হওয়া উচিত ছিল। স্রষ্টার প্রতি চরিত্রের টান থাকাটাই স্বাভাবিক। আমরা যে এখনও মানুষের মনে বেঁচে আছি, এখনও যে রাস্তাঘাটে দেখলে কচিকাঁচারা ভীষণভাবে চেনার চেষ্টা করে... তা তো ওঁর জন্যই! আচমকা কালবৈশাখীর সন্ধ্যায় ময়দান চত্বরে ঝড় আর ধুলোর কম্বিনেশনের মধ্যে যখন এক ভদ্রলোক তাঁর ছোট্ট কুকুরটিকে সঙ্গে নিয়ে শেড খোঁজেন... তখন যেন ঠিক অসমঞ্জবাবুর সঙ্গে ব্রাউনিকে দেখতে পাই। অসমের জঙ্গলে ঘুরতে গিয়ে হাফপ্যান্ট আর গামবুট পরা গাছপাগল প্রফেসরকে নেপেনথিস খুঁজতে দেখলে মনে পড়ে কান্তিবাবুর কথা। আবার বড়বাজারের গদিতে বসা ধুতি পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক যখন ডাক দেন, আসেন... অন্দর আইয়ে... মনে পড়ে যায় মগনলাল মেঘরাজকে।
—স্মৃতিগুলো বড্ড উস্কে দিচ্ছেন ফেলুবাবু। নকুড়বাবুর সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় না। এখন মনে হচ্ছে, এই গবেষণাটায় হাত দেওয়ার আগে একবার ওঁর সঙ্গে দেখা হলে বেশ হতো। কিংবা অবিনাশবাবু। গিরিডি গিয়ে দেখলাম, ওঁর বাড়িটা আর নেই। কাছেপিঠে কেউ চিনতেও পারল না অবিনাশবাবুকে।
—আসলে দোষটা আমাদের। নতুন প্রজন্মকে গ্যাজেট নির্ভর করে দিয়েছি। ক’জন এখন আর ছেলেবেলায় গল্পের বই নিয়ে বসে? ক’টা ক্লাসরুমে প্রফেসর শঙ্কুর আবিষ্কার নিয়ে বিতর্ক হয়? হাতেগোনা। আমরা তো তারপরও থাকতে চাই... ছেলেমেয়েদের মনে। ঠিক যেমনভাবে মানিকবাবু আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছেন। খুব মনে পড়ছিল পালসিটের কথা। মানিকবাবু ওখানেই না শুরু করেছিলেন পথের পাঁচালির শ্যুটিং! সেই দুর্গার ছুটে যাওয়া... পিছনে অপু... রেললাইন। গরমকাল। কাশবন পাব না জানতাম। তাও একটা টান অনুভব করলাম। অনেক খুঁজে রেললাইনের ধারে একটা ফাঁকা জায়গা পেলাম বটে। কিন্তু সবই যে বদলে গিয়েছে। ধু ধু প্রান্তর পেলাম না। এবড়োখেবড়ো পথের ধারে পড়ে রয়েছে নতুন প্রজন্মের ফেলে রাখা আবর্জনা। ভেবেছিলাম সভ্যতার অন্য প্রান্তে গিয়ে পৌঁছব। হল না। কিন্তু আশ্চর্য... একটি শ্যামলাপনা ছেলেকে দেখলাম। খালি গা... রেললাইনের ট্র্যাক ধরে ধীরে ধীরে ছুটছে। মুখে শব্দ... কু ঝিক ঝিক ঝিক। আর দূর থেকে ভেসে আসছে ট্রেনের ঘড়ঘড়। ভাবলাম, ডাক দিই... অ্যাই খোকা! দরকার হল না। যেন হাওয়া থেকে ফুটে উঠল এক কিশোরী। কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল তাকে। বলছে, ফের যদি দেখেছি, তোকে একা রেখে মেলা ঘুরতে চলে যাব।
—জানেন ফেলুবাবু, ওই দৃশ্যটা আপনার মনে কেন ধরেছে? কারণ, ওখানে কোনও স্বার্থ লুকিয়ে নেই। মানিকবাবুর ছবিতেও ছিল না। নিষ্পাপ দুটো ছেলেমেয়েকে বিভূতিভূষণের বই থেকে তুলে এনেছিলেন তিনি। ওই ফ্রেমটায় না ছিল রাজনীতি, না স্বার্থ, না কমার্শিয়ালাইজেশন। তাই ওরা আমাদের মনের ভিতর গেঁথে গিয়েছে।
—ঠিক বলেছেন। কিন্তু ওদের দেখে সেই যে মনটা আনচান করে উঠল... বাগ মানাতে পারলাম না। কলকাতায় সেদিন রাতে ফিরেছি। আর পরদিন সকালেই হাঁটা লাগিয়েছি গড়পার। তাড়া করে বেড়াচ্ছিল সেই ইউ রায় অ্যান্ড সন্স, সেই পথঘাট। আর গিয়েই আবার একটা অদ্ভুত ফিলিং।
—কী?
—প্রথমে দেখলাম বছর সাত-আষ্টেকের একটি ছেলেকে। আইসক্রিম কিনে দোকানদারকে বলছে, এটা একটু গরম করে দেবে? আমার বড্ড দাঁত শিরশির করে। খুব চেনা একটা ছেলেবেলা যেন দুম করে সামনে এসে গেল। সেই ভাবতে ভাবতেই এগচ্ছিলাম। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আলাপ হল এক মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে। কলিশন প্রায় লেগেই যাচ্ছিল। উনিই বলে উঠলেন, রোক্কে। জানলাম, তাঁর নাম বিশ্বেশ্বর ঘোষ। আঁকার টিচার। গড়গড় করে বলে চললেন, ঠাকুরদাও আঁকার শিক্ষক ছিলেন, থাকেন ভবানীপুরে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে আঁকা শেখান, কতজন স্টুডেন্ট, তার মধ্যে সেরা প্রদোষ, ডাকনাম তিলু...। তখনও চমকে যাওয়ার মতো কিছু ছিল না। কিন্তু তারপরই বললেন, মানিক নাকি এমন ছবি আঁকে, যা তাঁর ৫৬ বছরের জীবনে কাউকে আঁকতে দেখেননি। বয়স? মাত্র সাত। সব আঁকাতেই তাঁকে ১০+F দিতে হয়। বললেন, F মানে ফার্স্ট, বুঝলেন তো? সত্যজিৎ রায়কেও বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে আশুবাবু দিতেন। আশুবাবু মানে... আর কোনও কথা তাঁর মাথায় ঢোকেনি। হাত ধরে ঝাঁকুনি দেওয়ায় সংবিৎ ফিরেছিল। তিনি বলছেন, ও মশাই! কোথায় হারিয়ে গেলেন? প্রদোষ কিন্তু থাকে কাছেই। একটু আগেই দেখা হয়েছিল। আইসক্রিম খেতে বেরিয়েছিল। তখন আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে থাকলে কথা বলিয়ে দিতাম। বাড়ি ফিরে এসেও ঘোর কাটেনি।
—ছেলেটি কেমন দেখতে ছিল বলুন তো?
—বড় বড় টানা চোখ। অপরিষ্কার গায়ের রং। লক্ষ করার মতো সঙ্গের বুড়ো চাকর। গায়ের সব চামড়াই প্রায় কুঁচকে গিয়েছে। বলছে, খোকাবাবু গিরিডি থেকে ফিরেই দেখছি তোমার আইসক্রিম খাওয়ার ঝোঁক বেড়েছে।
—আপনার অবজার্ভেশন তো মারাত্মক বলে শুনেছি! বুড়ো লোকটির হাতে কিছু ছিল?
—হুমম, মাদুলি। তাও সোনার চেনে। এই শ্রেণির লোকের হাতে সাধারণত দেখা যায় না।
—ঠিক। আমিও দেখেছিলাম। বাড়ির জন্য মন কেমন করছিল। তাই একবার ফ্রিকোয়েন্সি বদলে চলে এসেছিলাম। গিরিডি গিয়ে দেখি, উশ্রীর ধারে ওই দু’জন দাঁড়িয়ে। খোকার খুব দুঃখ... যেন উশ্রীকে অন্যভাবে আশা করেছিল।
—আমি যা ভাবছি, আপনিও তাহলে তাই ভাবছেন।
—ভাবছি। আর তাই দু’দিন ফলো করার পর আপনার কাছে এসেছি। বলুন তো, কিউরিও শপে গিয়েছিলেন কেন?
—বলছি।
উঠে গেল ফেলুদা। ঘর থেকে খবরের কাগজে মোড়া একটা জিনিস নিয়ে এল। ‘এটা দেখুন’।
—হুমম, মুখোশ।
—ভেতরটা দেখুন।
প্রফেসর শঙ্কু উল্টে দেখলেন। ‘এক কোণায় আর জে লেখা।’
—ঠিক। এটা খুব চেনা। বহু বছর আগে দেখেছিলাম। দার্জিলিংয়ে। রাজেনবাবু তাঁর প্রত্যেকটা শখের প্রাচীন জিনিসে আর জে লিখে রাখতেন। আজ বুঝলাম, স্মৃতিটা এখনও ধোঁকা দেয়নি।
—এই সব নিশ্চয়ই আপনি কাকতালীয় বলে মনে করছেন না।
—না। যদিও বা করতাম। আজকের পর আর করছি না।
প্রফেসর শঙ্কু তাকিয়ে রয়েছেন প্রদোষ মিত্রের চোখের দিকে। সটান।
—অর্থাৎ, আপনার যোগসূত্র যদি ঠিক হয়...!
—দেখুন, আমার হাতে কেস নেই। আপনার হয়তো গবেষণা আছে... কিন্তু তা মানুষের সামনে আসবে না। আপনার বটিকা ইন্ডিকা, মিরাকিউরল, নস্যাস্ত্র, শ্যাঙ্কোপ্লাস্ট... পাঠক জেনেছে আমাদের স্রষ্টার জন্য। তাঁর লেখায়। টাফা গ্রহ থেকে আপনি ফিরলেন কীভাবে? কোথায় আছেন? কী আবিষ্কার করলেন? এগুলো কি আর কেউ জানবে না? গড়পার, একটি ছেলে, গিরিডি, ১০+F... সবচেয়ে বড় কথা, আপনার এই রজনী সেন স্ট্রিটে পা দেওয়া। এরপর আর কাকতালীয় বলতে পারছি না। আপনার ডায়েরি কি আমি পড়ার চেষ্টা করিনি? করেছি। কিন্তু পারিনি। পড়া শুরু করলেই পরের লাইনগুলো বোর্ড মোছার মতো মুছে যায়। একেবারে কেলেঙ্কারিয়াস ব্যাপার। তখনই মনে হল, ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি একমাত্র একজনই পড়তে পেরেছিলেন। এবারও তাঁর মতো কেউই পারবে। না হয় আর একটু সময় দিই তাকে। কী বলেন?
—তথাস্তু। এখন আসি।
—গবেষণার বিষয়টা কিন্তু বললেন না!
—শুনবেন?
—বিলক্ষণ।
—প্রযুক্তির প্রচুর অপব্যবহার হয়েছে। আর নয়। আবার আমরা না হয় ফিরে যাই আদিম যুগে। শূন্য থেকে শুরু। সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট।
—তার মানে সবার মেমোরি ডিলিট হয়ে যাবে?
—হয়তো তাই? হয়তো নয়...। এখনও জানি না। বিধুশেখর বিরক্ত না করলেই হল। এবার যাই। ভবিষ্যতে কোনও না কোনও ফ্রিকোয়েন্সিতে আবার দেখা হবে।
হাত বাড়াল ফেলুদা... ‘দেখি আপনার অ্যানাইহিলিনটা!’
কলিং বেলটা বাজছে। আবার...। ভুরু কুঁচকে গিয়েছে ফেলুদার। বাইরে থেকে মিহি গলায় একটা শব্দ ভেসে আসছে—‘শঙ্কু... শঙ্কু... শঙ্কু।’