বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
আমাদের অসম্ভব অবাক লাগছে যে, এসব প্রচার থেকে হঠাৎ গত রবিবার থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্পূর্ণ সরে এসেছেন। উন্নয়ন, বিকশিত ভারত, অমৃতকাল, কর্তব্যকাল, আচ্ছে দিন, সবকা সাথ সবকা বিশ্বাস, ডিজিটাল ইন্ডিয়া, সব। হ্যাঁ, সব ভেসে গিয়েছে হঠাৎ কোন এক অজানা স্রোতে। সামনে এসে বিপুল পাহাড়ের মতো হাজির হয়েছে হিন্দু বনাম মুসলিম। প্রধানমন্ত্রী ১০ বছরের সব ইস্যু আর নিজের লার্জার দ্যান লাইফের রাষ্ট্রনায়ক রাষ্ট্রনায়ক টাইপের আচরণ ও স্টাইল ভুলে গিয়ে মরিয়া হয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, হিন্দু সেনা এবং বজরং দলের সুরেই কথা বলতে শুরু করেছেন।
রাজস্থান থেকে ছত্তিশগড়। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে দেশবাসীর সম্পত্তি ছিনিয়ে নিয়ে মুসলিমদের দিয়ে দেবে। নারীর মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেবে কংগ্রেস। দলিত ও আদিবাসীদের সংরক্ষণ কেড়ে নিয়ে মুসলিমদের দেবে কংগ্রেস। রাজস্থানের বাঁশওয়াড়ায় মুসলিমদের পরিচয় দিতে গিয়ে কী বলেছেন তিনি? বলেছেন, আপনাদের সম্পদ কেড়ে নিয়ে কাদের বণ্টন করে দেওয়া হবে জানেন তো? যাদের সন্তান বেশি হয় তাদের। অনুপ্রবেশকারী বহিরাগত মুসলিমদের স্বজনপোষণ করে কংগ্রেস এবং বিরোধীরা। এই অভিযোগে সরব প্রধানমন্ত্রী।
বিস্ময় লাগছে এখানেই। ১০ বছর তিনি যদি সুশাসন চালিয়ে ভারতকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়ে থাকেন, তাহলে সেই সুশাসনের নমুনাগুলিই তো তাঁর ভোটপ্রচারের ইস্যু হওয়া উচিত ছিল। মানুষ সেগুলি চোখের সামনে দেখে এবং নিজেদের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করে তাঁর দলকেই ভোট দিয়ে আবার তৃতীয়বারের জন্য তাঁর সরকারকে অধিষ্ঠিত করবে। ১০ বছর ধরে যে উন্নয়ন আর সুশাসনের কথা তিনি বলেন ভারতজুড়ে, ভোটের প্রচারে সেই উন্নয়নকে ভুলে গিয়ে সবথেকে প্রকট এবং শেষ আশ্রয় হিন্দু বনাম মুসলিম চর্চা নিয়ে আসতে হল কেন প্রধানমন্ত্রীকে? তিনি কি নিজেই আর বিশ্বাস করছেন না যে, তাঁর ঘোষিত এবং প্রচার করা উন্নয়নের স্লোগানগুলি মাটিতে সেভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি? বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধির জ্বালায় তাহলে কি সাধারণ মানুষ প্রবলভাবে প্রত্যাঘাতের অপেক্ষায়? সেরকম কোনও আভাস ইঙ্গিত কি মোদি পাচ্ছেন? তাঁকে যতটা স্থিতধী এবং আত্মবিশ্বাসী দেখিয়েছিল এক মাস আগেও, সেরকম যেন দেখাচ্ছে না। বিশেষ করে এরকম সব ভাষণ দিতে হচ্ছে কেন? সুশাসনের দাবি ভোটে জেতার জন্য যথেষ্ট মনে হচ্ছে না কেন?
এতটা টেনশনের চোখমুখ, এতটা মাত্রাজ্ঞানহীন, এতটা ভীত সন্ত্রস্ত এবং তাই বেপরোয়া শব্দচয়ন ও বাক্য উচ্চারণ দেখে দেশবাসীর সূক্ষ্ম সন্দেহ
হচ্ছে, তাহলে কি মোদি প্রথম দফার ভোটের পর কিছু পূর্বাভাস পাচ্ছেন? তিনি কি গরিষ্ঠতা হারানোর আশঙ্কা করছেন? ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গার ভূত তাঁকে চিরকাল তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছে। তাঁকে কংগ্রেস এবং বিরোধীরা উগ্র সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়েছে। মোদি বহু যত্ন করে গত ১০ বছর ধরে নিজের উন্নয়নশীল, স্টেটসম্যান সুলভ একটি ইমেজ নির্মাণে প্রাণপণে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। অথচ ভোটের আগে সেই সযত্নলালিত ইমেজের এভাবে ধ্বংস করলেন কেন? তিনি কেন আবার এভাবে প্রকটভাবে হিন্দু, মুসলিম ইস্যুকে তীক্ষ্ণভাবে সামনে নিয়ে এসে নিজেকে আবার পিছিয়ে নিয়ে গেলেন? নাকি আসল মোদি এরকমই? এতদিন আমরা মুখোশ পরা কাউকে দেখেছি!
মোদির ভক্ত দুরকমের। একদল বলে থাকে, আমরা বিজেপি নই। আমরা মোদিজিকে দেখে উদ্দীপ্ত। আমাদের মনে হয়েছে তিনি কিছু একটা করবেন। ভারতের উন্নতি একমাত্র তিনিই আনতে পারবেন। হিন্দুত্ব টিন্দুত্ব আমাদের কাছে কোনও ইস্যু নয়। এই অবস্থান আদৌ কতটা সত্য সেটা এখনও প্রমাণিত হয়নি। যদি সত্য হয়, তাহলে এই অংশকে মোদি প্রবল অস্বস্তিতে ফেললেন। কারণ, তাঁরা ১০ বছর ধরে বলে আসছেন, মোদি মোটেই সাম্প্রদায়িক মনোভাব বরদাস্ত করেন না। তাঁর একটাই লক্ষ্য, ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিক। কিন্তু ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে ইদানীং মোদি যে ভাষণ দিচ্ছেন এবং এভাবে আশ্চর্য বিভাজনের রাজনীতিকেই প্রধান বক্তব্য হিসেবে প্রচার করছেন, এটা ওই উন্নয়নের মোদিকে পছন্দ করা ভক্তের দলকে কি খুশি করছে? তারা কি বিব্রত অথবা একটু বিরক্ত হচ্ছে না?
মোদির ভক্তদের আর একটি দল আছে, যারা সংখ্যাগুরু। তারা মোদিকে সরাসরি হিন্দু হৃদয়সম্রাট হিসেবেই পছন্দ করে। তাঁর মুঘলবিরোধী হুংকার। মুসলিম নামাঙ্কনের শহর, রাস্তা, সিলেবাস মুছে দেওয়া। হিন্দু শব্দটির পরিবর্তে আচমকা গত দেড় বছর ধরে ‘সনাতন’ শব্দ বেশি বেশি করে বলা, ইত্যাদি শুনে এই অংশটি খুব উজ্জীবিত হয়। তাই মোদির এতদিনের যে বিশ্বগুরু, পাঁচ ট্রিলিয়ন ইকনমি, বিনামূল্যে রেশন, সকলের জন্য ঘর, সকলের জন্য পানীয় জল, সংখ্যালঘুদের উন্নয়ন প্রকল্প, ইত্যাদি বিষয় এই উগ্র অংশের কাছে তেমন উত্তেজনাপূর্ণ ছিল না। তাঁরা দেখতে চান, হিন্দু সম্রাট মোদিকে। তিনি হুংকার দেবেন, তিনি হুঁশিয়ারি দেবেন, তিনি রামমন্দির নির্মাণ করে বলবেন আগামী ১ হাজার বছর ধরে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হবে, এসব শুনতেই এই অংশের ভালো লাগে। অতএব মোদির সাম্প্রতিক ভাষণগুলো এই অংশের কাছে অত্যন্ত প্রিয় হবে বলাই বাহুল্য।
কিন্তু যাঁরা তাঁকে উন্নয়নের কাণ্ডারী এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঊর্ধ্বে দেখতে চেয়ে নিজেদের বিশ্বাসকে পণ রেখেছিলেন, সেই ভোটব্যাঙ্কের কী হবে? তাঁদের মনে এখন তো সন্দেহ হওয়াই সঙ্গত যে, তাহলে কি ভুল ভেবেছিলাম? আসলে মোদি কখনওই নিজেকে বিভাজন থেকে অনেক উপরে নিয়ে গিয়ে এক সামগ্রিক সর্বজনগ্রাহ্য স্টেটসম্যান হতে পারেননি অথবা চাননি? এই অংশের বিশ্বাসে কি এবার কিছুটা ধাক্কা লাগল? তাঁরা যখন মোদি বিরোধীদের সঙ্গে তর্ক করতেন এতকাল,উন্নয়ন আর বিকাশের যুক্তিগুলিকে হাতিয়ার করে, এবার কি সেই যুক্তিগুলি কিছুটা ভোঁতা হয়ে গেল? কারণ, মোদি বিরোধীরা প্রশ্ন করতেই পারেন যে, ১০ বছর সফলভাবে রাজত্ব করার পর উন্নয়নের ইস্যুতেই তো ভোট চাওয়ার কথা ছিল! অথচ এখনও কেন হিন্দু মুসলিম ইস্যুকেই প্রধান চালকের আসনে রাখা হল? তাহলে তো মোদি নিজেই আত্মবিশ্বাসী নন? তাই এতটা মরিয়া হয়ে তাঁকে এসব কথা উচ্চারণ করতে হচ্ছে! কংগ্রেস এমনিতেই দুর্বল। কংগ্রেসকে শক্তিহীন প্রমাণ করার জন্য, মোদি নিজের উন্নত ইমেজের অধীত শক্তিক্ষয় করে ফেললেন কেন? ভোট সহজে আসছে না? ২৭২ আসন নিয়ে চিন্তা হচ্ছে? নাহলে এভাবে নিজের টেনশন প্রকাশ করে ফেলা তো মোদিকে মানায় না!
প্রকৃত বুদ্ধিমান কেউ সত্যিই বিশ্বাস করে যে, কংগ্রেস বা যে কোনও দল ক্ষমতাসীন হয়ে ভারতবাসীর সম্পদ দখল করে নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে বিলি করে দেবে? একটি সরকার নারীদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নিয়ে সংখ্যালঘুদের দিয়ে দেবে? দলিত, অনগ্রসর এবং আদিবাসীদের সংরক্ষণ কেড়ে নিয়ে মুসলিমদের দিয়ে দেবে কোনও সরকার? এসব ২০২৪ সালের ভারতে সম্ভব? যে দল এসব করার চেষ্টা করবে, তাদের এক মুহূর্ত ক্ষমতাসীন হয়ে থাকা সম্ভব ভারতের মতো প্রবল গণতান্ত্রিক দেশে? মোদিও জানেন এসব সম্ভব নয়। তাহলে তিনি বলছেন কেন? কেন তাঁকে দেশবাসীকে ভয় দেখাতে হচ্ছে? কেন নিজের কাজের জন্যই তিনি ভোট পাবেন, অযথা বিভাজনের রাজনীতির দরকার নেই, এটা মেনে নিতে পারছেন না? হঠাৎ কনফিডেন্স এত কমে গেল কেন তাঁর?
স্বয়ং মোদি এখনও পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পেরেছেন যে ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হবে? পারেননি। তিনিও জানেন যে, ওটা হবে না। যতই ভক্তরা মনেপ্রাণে চান। ভারতের সবথেকে শক্তিশালী শব্দবন্ধ স্বৈরতন্ত্রী-শাসক নয়। ভারতের সর্বশক্তিমান শব্দের নাম হল, সাধারণতন্ত্র! সোজা কথায় জনতা জনার্দন! বাড়াবাড়ি ভারত কোনওদিন বরদাস্ত করেনি।