গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর আর এখন কলিযুগ চলছে। চারযুগ ধরে নারীদের অবস্থান ঠিক কীরকম? সহজ পথে নারীরা কিছু পায়নি, এটা চরম সত্য। শাস্ত্রের বেড়াজাল প্রায় সবটাই নারীকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। শৈশবে পিতার, যৌবনে স্বামীর, বার্ধক্যে থাকতে হবে পুত্রের অধীন। যত অধীন, যত বাধ্য, তত সতী। পুরুষশাসিত সমাজ অদ্ভুত কৌশলে প্রমাণ করে ছেড়েছে...পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা।
পরিস্থিতি বিরূপ ছিল। তবু দমিয়ে রাখা যায়নি যাঁদের পাঁচ হাজার বছর পরেও তাঁদের নাম স্মরণ শ্রদ্ধার সঙ্গে করতে হচ্ছে। সেকাল বলতেই মনে হয় যেন অচেনা কোনও যুগ! নারীদের মন অথবা অবস্থান পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যুগভেদ বলে কিছু নেই। চাঁদে যাওয়ার মতো আধুনিক যুগেও মেয়েদের রাত করে বাড়ি ফেরা নিয়ে কানাকানি হয়। আপনজনের রাগ হয়। আধুনিক আবাসনগুলি সমাজের প্রতিনিধি সেজে হিসেব নেয় কার বউ ঘরোয়া? স্বামীর সঙ্গেই কেবল বাইরে যায়? যুগের ভেদে পরিবর্তন খুব বেশি হয়েছে বলে মনে হয় না।
সত্যযুগ উচ্চারণ মাত্রই সুন্দর ছবি ভেসে ওঠে। ঋষিদের আশ্রম। বেদ শিক্ষা, মন্ত্র পাঠ। যাগ যজ্ঞ হোম। সেইযুগে রেণুকা নামে এক রাজকন্যা ছিল। শিক্ষিত ঋষির হাতে কন্যা সম্প্রদান করলে মান বেড়ে যেত। তাই রেণুকার বিবাহ হল জমদগ্নি ঋষির সঙ্গে।
পরশুরামের মতো বিখ্যাত পুত্রের মা, রেণুকার ভালো লাগত নদী তীরে বসে সময় কাটাতে। ঋষিপত্নী হলেই ধ্যান জপ করতে হবে এমনটা মেনে না নিয়ে সে দেখত নদীর জল। স্নানরত পুরুষ-নারী। শুষ্ক মন্ত্র নয়, ভালোবাসত জীবন। ফলত, ভয়ঙ্কর অপবাদ নেমে এল জীবনে। স্বামীর ক্রোধে তাঁর মস্তক ছেদন করল আপন পুত্র পরশুরাম!
নারীদের উত্তরণের পথে বাধা এসেছে বারবার। সামাজিক, সাংসারিক সমস্ত রকম দিক দিয়েই প্রতিহত করার চেষ্টায় পিছিয়ে যায়নি কেউ। মাথা নিচু করে মেনে নিয়েছিল কি না বা হাহাকার করে বিধাতার কাছে নালিশ করেছিল কি না, দেখার বিষয় সেটাই।
ত্রেতাযুগ। রামায়ণের যুগ। সীতা নিজগুণে শ্রেষ্ঠ। রামায়ণ থেকে নারীদের অবস্থানের যে চিত্রটুকু পাই তাতে দেখা যায়, সামাজিক চাপের মধ্যেও নিজের প্রতি আস্থা ছিল। অহল্যার কথা মনে পড়ে। সতীত্বের প্রথাগত সংজ্ঞায় তিনি বিবেচিত হতেই পারেন না। একটাই কথা উচ্চারিত হয়েছিল তাঁর মুখ থেকে... মিথ্যা বলতে পারব না। দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছিল, সেকথা অস্বীকার করতে পারবেন না, সমাজ ভয় দেখালেও না। মূল রামায়ণ বলে...অহল্যা বিতাড়িত হয়ে কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করে জীবন কাটিয়ে দেন। পাথর হয়ে যাওয়া বা অন্য কোনও ঘটনা রামায়ণে নেই।
নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার লড়াই প্রত্যেক যুগের নারীদের করতে হয়েছে। বাসের ভিড়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা অফিস করছে, বাড়ি এসে চা বানিয়ে দিচ্ছে, সন্তানের ভবিষ্যৎ দেখছে সেই সঙ্গে রাত জেগে অফিসের কাজ করছে। দশভুজা উপাধি তো দূর কলঙ্কের ছোঁয়া বাঁচিয়ে কাজ করার চেষ্টায় জেরবার হয়ে যাচ্ছে।
দ্বাপরযুগ। পুরুষোত্তম বাসুদেব কৃষ্ণের কর্মযোগ চলছে নতুন ভারতবর্ষ গড়ে তোলার জন্য। আপাতদৃষ্টিতে আধুনিক যুগটিতে নারীদের অবস্থান পর্যালোচনা করলে প্রথমে মনে পড়ে রাধিকার কথা। সেই সময়ের নিরিখে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রেম ভাবনাটি এতখানি সুচারু সুন্দর যে, আজও তিনি নিন্দিত নন পূজিত হয়ে আসছেন। বাসুদেব কৃষ্ণের পত্নীদের মধ্যে রুক্মিণী একজন সাহসী নারী। পরিবার নির্দিষ্ট বিবাহ অস্বীকার করে তিনি পত্র দিয়েছিলেন কৃষ্ণকে। নিজের স্বাধীন ইচ্ছা অনুযায়ী পালিয়ে গিয়ে বিবাহ করেন কৃষ্ণকে।
দ্বাপর যুগের নারী...সত্যভামা। রাজনীতি, অস্ত্রচালনা...পুরুষের সমান দক্ষ এই নারী স্পষ্ট বক্তা হিসেবে বাসুদেবের প্রিয় ছিলেন। আত্মবিশ্বাস নারীর ভূষণ। সেই হিসেবে, কুন্তী আর দ্রৌপদী... নিজ নিজ ক্ষেত্রে উপযুক্ত কৃতিত্বের প্রমাণ দিয়েছিলেন। রাজপরিবারের কন্যা হলেও গহনা আর বিলাস নিয়ে মত্ত থাকেননি। রীতিমতো পড়াশোনা শিখেছেন। দুর্গম অরণ্য পাহাড় নদী ঘুরে বেড়িয়েছেন। কুন্তীর জন্মদাতা পিতা তাঁকে দান করে দিয়েছিল নিঃসন্তান বন্ধুকে। স্বামী পাণ্ডু চিররুগ্ন। জীবন ছিল না সুখের। অথচ, নিজেকে নিয়ে বিষাদ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েননি কুন্তী। সবসময় ইতিবাচক চিন্তায় ভরপুর থেকেছেন। এটাই শিক্ষণীয় আজকের দিনেও। বলিষ্ঠতমা নারী দ্রৌপদী। শত অপমানে এতটুকু সরে আসেননি লক্ষ্য থেকে। সর্বযুগে অত্যাচার বিষাদ হতাশার রূপ একইরকম।
নারীদের লড়াই করে উঠে আসার গল্প কি নিছক কল্পনা? আজকের দিনে শিক্ষণীয় নয়?
যজ্ঞের সময় পুরোহিতদের দান করা হতো গোরু এবং দাসী। সাধারণ মেয়েদের আজীবন কুমারী থেকে সেবা করতে হতো রাজপরিবারের। বড় ঘরের শিক্ষিত মেয়েদের মোটেই মাথায় তুলে রাখা হতো না। খনার মতো গণিতজ্ঞ মহিলাকে দশমরত্ন উপাধি দেওয়ার আগের রাতে জিভ কর্তন করা হয়েছিল। পরিবারের লোক চায়নি গৃহের নারী সদস্য সম্মানিত হোক রাজসভায়!
সত্য, ত্রেতা, দ্বাপরের পরে আসে কলিযুগ। আধুনিক যুগ। কত-শত প্রতিভা আর লড়াকু মহিলার কথা জানতে পারছি। যুগ আধুনিক হলেও লড়াই তো থেমে যায়নি!
কুন্তী, দ্রৌপদীর লড়াই আজকের দিনেও সমানভাবে সত্য। মন হতাশ না হলে হারিয়ে যায় না কেউই। কোথাও না কোথাও খুঁটি পুঁতে রাখবে ঠিক। আপন ভাগ্য জয় করার অধিকার বিধাতাকে দিতে হবে না নিজের যোগ্যতায় অর্জন করে নেবে নারী।