বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
হুগলি জেলার তারকেশ্বর ব্লকের অধীন ভঞ্জিপুর গ্রামের এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা সবিতা মাহাতো আজ খেলাধূলার অঙ্গনে বহুচর্চিত নাম। অ্যাডভেঞ্চার তাঁর মনে নেশা ধরিয়েছে। আবার সাইকেলে চড়ে দূর দূরান্তরে বিদেশ বিভূঁইয়ে চলে যাওয়াও তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়। তাই তো সাইকেলে চড়ে বিশ্বভ্রমণে বেড়িয়ে পড়তে প্রস্তুত সবিতা। সেই সঙ্গে আগামী বছর এভারেস্ট অভিযানের প্রস্তুতি নিতে এখন থেকেই তিনি উঠে পড়ে লেগেছেন।
কথা হচ্ছিল সবিতা মাহাতোর সঙ্গে। কথাবার্তায় তিনি খুবই তুখোড়। হরিপালের পানিশেওলা ইন্দিরা স্মৃতি বিদ্যাপীঠ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রিষড়া বিধানচন্দ্র কলেজ থেকে ভূগোলে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছেন। তারকেশ্বর বটতলা ভলিবল ক্লাবের কর্মকর্তা প্রবীর কোঙার জানিয়েছেন যে, অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন সবিতা কোচ সুরেশ মণ্ডলের প্রশিক্ষণে ভলিবলে নিজের মনোনিবেশ করেছিলেন। পরে তিনি ভলিবল থেকে সরে আসে। তারপর ২০১৪ সালে পর্বত অভিযান তাঁকে পেয়ে বসে। সাক্ষাৎকারে সবিতা জানালেন, ‘ছন্দাদি (গায়েন) কাঞ্চনজঙ্ঘা যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনিই পর্বতারোহণে উৎসাহ দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর আদর্শে আমি অনুপ্রাণিত। তাঁর টিপস নিয়ে আমার পর্বতারোহণ শুরু।’ সে কারণে মনে অসম্ভব ধরনের জেদ চেপে গিয়েছিল সবিতার। ছন্দা গায়েনের আদর্শে অনুপ্রাণিত সবিতা বিগত কয়েক বছর ধরে ছোট বড় বিভিন্ন শৃঙ্গে অভিযান করেছেন। তাতে সাফল্যও এসেছে। ১৫টি শৃঙ্গের মধ্যে কামেট, ত্রিশূল প্রভৃতি ১০টিতে সফলতা লাভ করেছেন। সাহসই তাঁর মনোবল বাড়িয়ে দেয়। সাফল্য মানুষকে আরও বেশি সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। সে কারণেই সবিতা আগামী বছর এভারেস্ট অভিযানে পাড়ি জমাতে উন্মুখ। তবে সবিতা মনে করেন যে, এভারেস্টের চেয়েও আরও কঠিন শৃঙ্গ রয়েছে যা জয় করে অধিক তৃপ্তি পাওয়া যাবে। তাঁর কথায়, পাহাড়ে গেলেই প্রত্যেকটি মুহূর্তই তাঁর কাছে স্মরণীয় হয়ে ওঠে। তিনি আরও জানিয়েছেন, আমার সাফল্যের মূলে প্রধান প্রেরণাদাতা অবশ্যই আমার বাবা-মা। তাঁদের অনুপ্রেরণা না পেলে এত দূর এগনো আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
বাবা চৌহান মাহাতো ও মা কান্তি মাহাতো সদা সর্বদা মেয়েকে উৎসাহ দিতে কসুর করছেন না। মেয়ের অভাবনীয় সাফল্যে তাঁরা গর্বিত ও উচ্ছ্বসিত।
আবার সাইকেলে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ সবিতার আর একটি নেশা। ২০১৭ সাল থেকে তাঁর সাইক্লিং যাত্রা শুরু। ইতিমধ্যে তিনি ১৭৩ দিন ধরে দেশের ২১টি রাজ্য ঘুরে ফেলেছেন। পাটনা, লখনউ থেকে শুরু করে উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, জম্মু-কাশ্মীর, দিল্লি, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, গোয়া, গুজরাট, মুম্বই, কর্ণাটক, ছত্রিশগড়, ঝাড়খণ্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, অসম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, সিকিম প্রভৃতি রাজ্য তাঁর ইতিমধ্যেই ঘোরা শেষ। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, ‘মহিলা সুরক্ষা’ প্রতিষ্ঠিত করতেই তাঁর সাইকেল ভ্রমণ। সাইক্লিং করতে গিয়ে তাঁর প্রচুর তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। এমনকী ইভটিজিং থেকে শুরু করে অশ্লীল গালাগালি ও সাইকেল ধরে টানাটানি করতেও দ্বিধা বোধ করেনি মানুষ। তবুও এইসব গায়ে না মেখে, ভয় না পেয়ে এগিয়ে গিয়েছেন সবিতা। তিনি বলেন, ‘৫০ জন খারাপ হলেও ৫০০ জন আমাকে যাত্রাপথে সম্মান জানিয়েছে। এমনকী আমায় নিরাপত্তা দিতে পুলিস আমার পিছনে সহযাত্রী হয়ে আমাকে সর্বতোভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।’ একই পথে নিরাপত্তা ও সাফল্য পাওয়া তাঁর লক্ষ্য। এভাবেই তিনি সাইকেলে ওয়ার্ল্ড ট্যুরে যাওয়া মনস্থির করেন। সাইকেল চড়ে ১ লক্ষ কিলোমিটার অতিক্রম করা তাঁর স্বপ্ন। তাছাড়া দূষণের বিরুদ্ধে অভিযানেও সবিতা সক্রিয়। ‘বেটি পড়াও বেটি বাঁচাও’ স্লোগানকে তুলে ধরতে প্রচারাভিযানও চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবিতাকে সম্মানিত ও পুরস্কৃত করা হয়েছে। এই ধরনের পুরস্কারই তাঁর আগামী দিনের চলার পথে পাথেয়। ২০১৭ সালে তারকেশ্বর পুরসভা, পঞ্চায়েত সমিতি ও ব্লক উন্নয়ন দপ্তরের উদ্যোগে তাঁকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে সম্মান জ্ঞাপন করা হয়। ১৩ ডিসেম্বর মৌলালি যুব কেন্দ্রে রাজ্য ক্রীড়া দপ্তরের সুচারু ব্যবস্থাপনায় ছন্দা গায়েন সাহসিকতা পুরস্কারের সঙ্গে ৭৫ হাজার টাকার আর্থিক পুরস্কার সবিতার হাতে তুলে দেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্রীড়া দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী লক্ষ্মীরতন শুক্লা। এটা সবিতার কাছে এক স্মরণীয় সম্পদ।
আমজনতার ধারণা, আগামীদিনে সাইক্লিং ও পর্বতারোহণে সবিতার আরও প্রশংসিত হবে এবং ক্রমশ এই দুই ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানে এগিয়ে যাবে। তবে এতকিছু সাফল্য ও প্রশংসা পাওয়ার পরও তাঁর আক্ষেপ, স্থানীয় ভঞ্জিপুর গ্রাম পঞ্চায়েত তাঁর সাফল্যের প্রতি বিন্দুমাত্র ওয়াকিবহাল নয়। তবুও তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ দেশের সম্মান বজায় রাখতে তাঁর চেষ্টার কোনও ত্রুটি থাকবে না। উপরন্তু ক্রীড়াজগতে তিনি তাঁর পারফরম্যান্সকে ক্রমাগত উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করার লক্ষ্যে দস্তুরমতো বীরবিক্রমে এগিয়ে যেতে চান। সকলের আশীর্বাদ প্রার্থনা করেছেন সবিতা।