বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
করোনা বিদায় নেয়নি। তা সত্ত্বেও আনন্দে মেতেছেন এঁরা... পুজো কমিটির ধারক ও বাহকেরা। তাঁরা প্রভাবশালী। তাই ২০০৯ সালের কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ হেলায় অমান্য করতে পারেন। আদালত তো জানিয়েই দিয়েছিল, কোনওভাবে মণ্ডপের উচ্চতা যেন ৪০ ফুট না ছড়ায়। তা সত্ত্বেও বছরের পর বছর বহু পুজো কমিটি ইচ্ছেমতো প্রভাব খাটিয়ে চলেছে। বেড়ে চলেছে প্যান্ডেলের উচ্চতা। থিম হচ্ছে...। আমাদের রাজ্য সরকারের পরিকাঠামো অনুযায়ী, আগুন লাগলে ১৫০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত জল দিতে পারে দমকল। কিন্তু মণ্ডপের উচ্চতা যদি ১৪৫ ফুট হয়? সেই আগুন কত দ্রুত ছড়াবে, আর তাতে দমকলের পক্ষে আদৌ জল দেওয়া সম্ভব হবে কি না, সেই অঙ্ক পুজো প্ল্যানিংয়ের সময় কেন কষে নেওয়া হবে না? এটা কি দায়বদ্ধতার নমুনা? আসলে, এক একটা পুজো কমিটির নেপথ্যে এক একজন প্রভাবশালী। আর প্রত্যেকেই লেগে পড়েছেন কম্পিটিশনে। একজন অন্যজনের ঘাড়ে দোষ ঠেলে চলেছেন... অমুক পুজোয় তো ৬০ ফুট উঁচু প্যান্ডেল হয়েছে! তমুক প্রভাবশালী ৪৫ ফুটের মণ্ডপ করেছে। তার বেলা? কেউ যদি ৪০ ফুটের উপর মণ্ডপ তৈরি করেই থাকেন, তাহলে প্রশাসন কেন ব্যবস্থা নেয়নি? কেন সেই মণ্ডপের বাড়তি অংশ ভেঙে দেওয়া হয়নি? এই সবটাই তো মানুষের স্বার্থে, যে কোনও রকম বিপদ এড়ানোর উদ্দেশ্যে? দোষ চাপালেই কি প্রশাসনিক কর্তব্য মিটে যায়? ভিড়ের দাপটে একটি পুজোয় জনতার প্রবেশ অষ্টমীর রাত থেকে বন্ধ করে দেওয়া হল। তার আগের পাঁচদিনে কিন্তু যা হওয়ার হয়েই গিয়েছে। তৃতীয়া থেকে ঢল নেমেছে রাস্তায়। কোভিড বিধি রয়েছে... আছে তার ফাঁকও! সেই ফাঁক খুঁজেই জনতাকে ‘দর্শনের সুযোগ’ করে দেওয়া হয়েছে নিরন্তর। যুক্তি কী? এক পুজো কমিটির কর্তা বলছিলেন, ‘হাইকোর্ট তো বলেছে মণ্ডপের ভিতর ভিড় জমানো যাবে না। তা তো হয়নি! বাইরে ভিড় হলে আমরা কী করব?’ কিন্তু তাঁরাই তো সুচারুভাবে প্যান্ডেলের একপাশটা খোলা ছেড়ে রেখেছেন। মানুষও বাঁধভাঙা জলের মতো ছুটে গিয়েছে থিম দেখার নেশায়, ভিড় করেছে, ধাক্কাধাক্কি হয়েছে... আর ছুটি নিয়েছে সামাজিক দূরত্ব। যেন একটা এই ক’টা পুজো না দেখলে জীবনই বৃথা! মুচকি হেসেছে নিয়তি। কারণ, এই ক’দিনে রাজ্যে করোনা সংক্রমণ বেড়ে চলেছে... ধীরে ধীরে। সরকারি হিসেব বলছে, ১৭ অক্টোবর রাজ্যে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ৬২৪। মৃত্যু ১৪। ঠিক আগের দিন, অর্থাৎ ১৬ অক্টোবর সংক্রামিত হয়েছিলেন কিন্তু ৪৪৩ জন। অর্থাৎ একদিনেই আক্রান্ত বেড়েছে ১৮১। এই পরিসংখ্যান কি যথেষ্ট উদ্বেগজনক নয়? সবচেয়ে বড় কথা, পুজো মিটেছে সদ্য। যাঁরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার লক্ষ্যে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন, সেই পুজোপিপাসুরা এখনও হাতেনাতে ফল পাননি। কারও সবেমাত্র উপসর্গ দেখা দিয়েছে, কেউ অপেক্ষায় রয়েছেন তিনদিন সম্পূর্ণ হওয়ার। তারপর টেস্ট করাবেন। কেউ কেউ তো আবার করোনা পরীক্ষার ধারেকাছেও যাবেন না। ডাক্তারকে ফোন করে ওষুধ জেনে নেবেন। সেই মতোই চলবে চিকিৎসা। একান্তই না পারলে গন্তব্য হাসপাতাল! কিন্তু করোনা সেই সময়টা দেবে তো?
আতঙ্ক বাড়ছে... তৃতীয় ঢেউয়ের। কেরলে ওনাম উৎসবের ঠিক পরেই একদিনে নতুন করোনা সংক্রমণ ছিল ৩১ হাজার ৪৪৫। পজিটিভিটির হার ১৯.০৩ শতাংশ। তখন আমরা আলোচনা করেছি... আতঙ্কিত হয়েছি। আর চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলে তখন আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু কী ছিল? পুজো আসছে... সতর্ক হওয়া চাই। না হলে কেরলের দশা হবে আমাদেরও। কিন্তু আমরাও বোধ হয় এখন মোদিজিতে অনুপ্রাণিত... কথায় আছি। কাজে নেই। পুজোর ঢাকে কাঠি পড়া মাত্র কেরল ভুলেছি আমরা। ওনামের করোনা কাণ্ড যেন আদিম যুগের কথা! আগে এই পুজোটা তো এনজয় করি! মাথা খাটিয়ে আমরা শব্দবন্ধটা বের করেছি বটে... ‘রিভেঞ্জ ট্যুরিজম’। দেড় বছর ধরে প্রকৃতি আমাদের বাড়িতে বসিয়ে রেখেছে। আর এখন আমরা চ্যালেঞ্জ ছুড়েছি তাকে... আমাদের কাছে ডাবল ডোজ আছে। আর প্রকৃতি কিছুই করতে পারবে না। কাঁচকলা দেখিয়ে ড্যাংড্যাং করে আমরা ঘুরব, ফিরব, ফুচকা খাব। এই না হলে পুজোর আনন্দ! পুজো কমিটির হর্তাকর্তারাও সুযোগ নিয়েছেন তারই। ভিড় একটু বেশি হলেই অজুহাত রেডি, ‘ওরা তো পাড়ার লোক।’ এক একটা পাড়ায় যে এত লোক থাকতে পারে, তা এই পুজোতেই আমরা আবিষ্কার করলাম। অঞ্জলি থেকে সিঁদুর খেলা—সর্বত্রই ঠেলাঠেলি। মাস্ক পরলে আবার মা দুর্গা ঠিক মতো অঞ্জলির মন্তর শুনতে পাবে না। সিঁদুর খেলা তো যাবেই না! তাই, চালিয়ে যাও মহাশয়।
দায়টা কার? এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। কলকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দেবে। সেটা কাজে লাগানোর দায়িত্ব প্রশাসনের, পুজো কমিটিগুলোর। তা কি হয়েছে? পুলিসও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেন ঠুঁটোর ভূমিকায়। এক পুলিসকর্মী বলছিলেন, ‘এত লোক... কী করব? লাঠি চালাব নাকি?’ না, লাঠি আপনি অবশ্যই চালবেন না। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট বলে তো একটা বস্তু আছে! সেটাও কি করা যেত না? যাওয়া-আসার সব পথই মণ্ডপমুখী। সব পাগলই যেন মত্ত মাদল বাজিয়ে ছুটে চলেছে... চলেছে। পুজোয় তাদের সব ভালো... সস্তা ভালো, দামিও ভালো... কাঁসিও ভালো, ঢাকও ভালো। কিছু একটা তো হচ্ছে! ওতেই হবে। ওই ছেলেটাও পুজোয় এসেছিল কলকাতায়। বাবা আর কাকার হাত ধরে। ওরা ঢাক বাজাবে, আর ছেলেটা কাঁসর। কলকাতার পুজো নয়, পেটের টান নিয়ে এসেছিল তাকে এই শহরে। তাও দশমী হতে না হতেই তার বাড়ি যাওয়ার বায়না। এই ভিড়ে সে আর চায় না থাকতে। সে জানে, করোনা বলে একটা রোগ তার স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে। এই রোগ ভিড়েই ছড়ায়। তাই আর নয়...।
আট বছরের একটা শিশুও বোঝে এই রোগের জ্বালা। আর আমাদের মতো বুড়ো খোকারা...?