বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
আর দ্বিতীয়ত, পরিষ্কার দেখালেন বিহারে জোটের ‘বড়দা’ বিজেপিই। জেডিইউ ফ্যাক্টর ধূসর হয়েছে। কেউ বুঝল, কেউ না। আশা করা যেতেই পারে, নীতীশ কুমার বুঝেছেন। এতটুকু রাজনৈতিক বোধ তাঁর রয়েছে। আর সেটা আগেভাগে বুঝেছেন বলেই ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি তো মুখ্যমন্ত্রী নই! ওটা এনডিএ বৈঠকে স্থির হবে।’
নীতীশ বুঝেছিলেন, এবার তিনি হেরেও যেতে পারেন। তিনি মানে তাঁর দল। নীতীশ বিধানসভা নির্বাচনে দাঁড়ান না। তাঁর ট্র্যাক হল লোকসভা। ওখানে দৌড়েই বারবার তিনি জিতেছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হয়েছেন। শেষবার বিধানসভা ভোটে সমতা পার্টির হয়ে তাঁকে দাঁড়াতে দেখা গিয়েছিল ১৯৯৫ সালে। ওই শেষ। তারপর থেকে বিধান পরিষদ। সেফ গেম। হারের ভয় নেই... ক্ষমতা হারানোর চাপটাও উধাও। জোট গঠন থেকে ‘সুশাসন’... নিখুঁত ছকে দশকের পর দশক গড়িয়েছে তাঁর বিজয়রথের চাকা। যখন যে কাজে লেগেছে, তাকে ধরেই ক্ষমতার অলিন্দে থেকে গিয়েছেন তিনি। কখনও প্রাণের ‘সখা’ বিজেপিকে হ্যাটা করেও। বিজেপি কিন্তু তখনও অপেক্ষায় থেকেছে... সঠিক সময়ের। একটা পরিস্থিতি, মুহূর্ত তো এমনও আসবে, যখন নীতীশ বাধ্য হবেন ঝুঁকতে! কেউ তাঁর সঙ্গ দেবে না... আরজেডি না, লোক জনশক্তিও না...। তখন সামনে আসবে গেরুয়া শিবিরের আসল রূপ। ফাল হয়ে বেরনোর খেলা। রামবিলাস পাসোয়ানের মৃত্যুর পর রীতিমতো কৌশলে নীতীশের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল চিরাগ পাসোয়ানকে। রামবিলাস-পুত্র এনডিএতে থেকে লড়লে অঙ্কটা যে পরিষ্কার হতো না! তাই চিরাগ আলাদা লড়লেন। এবং ঘোষণা করে... নীতীশকে সাফ করবেন তিনি। মানে, নিজের নাক কেটে জেডিইউ সুপ্রিমোর যাত্রাভঙ্গ। নীতীশের ভোট কেটে নিলেন তিনি। নিজে ডুবে গেলেন। আর নীতীশকে নামিয়ে দিলেন তিন নম্বরে। জোটের বড়দা হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াল বিজেপি।
তাই নীতীশ বেশ বুঝেছিলেন, জোটের বাঁধনে থাকা সত্ত্বেও এবার তাঁর মাঝেমাঝে একলা লাগছে। তিনি চোটপাট করেছেন, সামান্য সব বিষয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, ধমক লাগিয়েছেন...। প্রচারপর্বে খুব স্বস্তিতে দেখা যায়নি তাঁকে। কারণ তিনি বুঝেছিলেন, ছুঁচ হয়ে ঢোকা বিজেপি এবার ফাল হয়ে বেরতে শুরু করেছে। কিন্তু কিছু বলতে পারেননি... করতেও পারেননি। শুধুই গিলতে হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারের যে বড্ড মায়া! নিজের দমে বিহার জয়ের ক্ষমতা তাঁর দলের এবার নেই। তাই মেনে নিতেই হবে... বিজেপির ঔদ্ধত্য, অহঙ্কার, কৌশল।
চেয়ার টিকে গিয়েছে তাঁর। কিন্তু সামনে পাঁচটা বছর। নীতীশ বুঝছেন, আগামী এই রাজনীতির মরশুম তাঁর মোটেও সহজ যাবে না। এবার তাঁর সময় এসেছে কাঠের পুতুল হওয়ার। পাপেট শোয়ের সব নিয়ন্ত্রণটাই তুলে নিয়েছে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি। দাক্ষিণ্য হিসেবে রয়েছে ওই মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিটা। বলবেন নীতীশ... চিত্রনাট্য লিখবে বিজেপি।
বুঝেছিল বিজেপিও। বিহার হাত থেকে বেরিয়ে গেলে মেগা শোয়ের ক্লাইম্যাক্সটা ঝট করে এসে যাবে। ২০১৪ সালে শুরু হয়েছিল এই শো। ঝড়ঝাপ্টা গিয়েছে প্রচুর... নিজেদেরই তৈরি পাঁকে পড়ে প্রায় থমকে গিয়েছে অশ্বমেধের গেরুয়া ঘোড়া। কিন্তু ছুটতে শুরু করেছে আবার...। প্রতিদ্বন্দ্বীহীন মাঠে। সত্যিই তো, জাতীয় রাজনীতির নিরিখে বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়তে পারে, এমন ঘোড়া আছে নাকি? কংগ্রেস প্রায় সাইনবোর্ডের পর্যায়ে। যার সঙ্গে জোট গড়ছে, তারই শিরে সংক্রান্তি, বাম দলগুলি প্রায় অস্তাচলে। নবীন পট্টনায়েক নিজের রাজ্যের বাইরে খুব একটা মাথা গলান না। জয়ললিতা এবং করুণানিধির প্রয়াণের পর দক্ষিণী রাজনীতি বুকজলেই হাবুডুবু খাচ্ছে। কাজেই আছেন বলতে শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নোট বাতিল হোক, বা জিএসটি... কেন্দ্রীয় এজেন্সির চোখরাঙানি বা আইন সংশোধনে তুঘলকি কারবার... জাতীয়
স্তরে সবার আগে শোনা গিয়েছে একটাই কণ্ঠস্বর—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বিরোধিতার এই তীব্র রোশনাইয়ের উপর পর্দা দিতে হলে প্রয়োজন বাংলা দখল... আগামী বছর।
আগামী বছরটা বিজেপির জন্য তাই গুরুত্বপূর্ণ। বিহারে বিজেপি ছিল শাসকের ভূমিকায়। হতে পারে নীতীশ কুমারকে সামনে রেখে... কিন্তু রাজবেশটা তাদের গায়েও বিলক্ষণ ছিল। পশ্চিমবঙ্গে গেরুয়া পার্টি একেবারেই আনকোরা। লোকসভা ভোট আচমকাই তাদের একটা ডিভিডেন্ড দিয়েছে—ছুঁচ হয়ে ঢুকে পড়ার। অনেকগুলো আসন না চাইতেই ঝুলিতে এসে গিয়েছে গেরুয়া শিবিরের। তারপর থেকেই চলছে হাঁকডাক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের সমালোচনা, রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। আর ভাবটা এমন, একটা মাত্র সুযোগ দরকার... তাহলে কত কী না করে ফেলবে তারা। সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই লোকসভা ভোটের পর থেকেই। আর তার সঙ্গে রাজ্যের একটু নাম করা শাসক নেতাদের লোভ দেখানো... জিতে এলে যেন সবাইকেই সরকারের মাথায় বসিয়ে দেবে তারা। আদৌ যে তা হবে না,
সেটা বুঝতে পারছেন না, বা চাইছেন না অনেকেই। অন্ধের মতো এগিয়ে চলেছেন এক অলীক কল্পনার দিকে। বঙ্গ রাজনীতি দেখতে পারছে না, বিজেপির অদৃশ্য সেই ছুঁচটাকে।
আগামী বছরটা বিজেপির কাছে আরও একটা কারণে গুরুত্বপূর্ণ... ২০২১ সালে জনসঙ্ঘ ৭০-এ পা দেবে। ১৯৫১ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে ঝামেলার পর গড়ে ওঠা দলটির যা আদর্শ বা লক্ষ্য ছিল, তা পূরণ হওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দু’বার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিতে আসার পর বিজেপি তাই আর পিছন ফিরে তাকাতে চাইছে না। জনসঙ্ঘ ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন যে সব রেজল্যুশন নেওয়া হয়েছিল, তার অন্যতম ছিল বাংলার সঙ্গে বিহারের সীমানা ‘অ্যাডজাস্ট’ করা। বাংলা চিরকালই রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক গুরুত্বের দিক থেকে বাকি রাজ্যকে পিছনে ফেলে এসেছে। স্বাধীনতার পর যখন বাংলাকে দু’টুকরো করে দেওয়া হল, তখনও সেই চরিত্রে বদল আসেনি। ভারতের শাসক বা শাসন মঞ্চে বসতে ইচ্ছুক প্রত্যেক রাজনৈতিক দল এবং ব্যক্তি সেটা হাড়ে হাড়ে জানেন। তাই বক্তৃতায় বাংলাকে কানেক্ট করার এতটুকু প্রয়োজন বোধ হলেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টেনে আনেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস, স্বামী বিবেকানন্দকে। কথায় কথায় আসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঙ্ক্তি। মোদি জানেন, ইতিহাস, ঐতিহ্যেই লুকিয়ে আছে বাংলার সেন্টিমেন্ট... যাবতীয় আবেগ। আর তারপরই ভক্ত-সমর্থকদের মধ্যে দেখা যায় এক অদ্ভুত ‘হতাশা’র অভিব্যক্তি। ভাবটা এমন... আহা রে, সব গেল। বিজেপি ক্ষমতায় এলেই আবার সোনার বাংলা হয়ে যাবে। তারা দেখতে পায় না, বাংলা এখনও সোনারই আছে। খুঁচিয়ে ঘা করে, তারপর মলম লাগানোর মতো কোনও মহত্ত্ব নেই। বঞ্চনা এবং ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েও এখানে মুখ্যমন্ত্রী স্কুলছুটদের পড়াশোনার চার দেওয়ালে ফিরিয়ে আনতে কন্যাশ্রীর ব্যবস্থা করেন। বিয়েতে অসুবিধা যাতে না হয়, তাই প্রাপ্তবয়স্কার ঘরে পৌঁছে যায় রূপশ্রীর টাকা। চুক্তিবদ্ধ কর্মীরাও ৬০ বছর পর্যন্ত কাজ করতে পারার নিশ্চয়তা পান। আর কোভিড পরিস্থিতিতে বিনামূল্যে রেশন... মমতাই বলতে পারেন, আমাদের রাজ্যে যেন কেউ না খেয়ে থাকে। এই সব প্রকল্পই বিজেপির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার পরে শুরু করেছে। ভারতের সবথেকে বেশি জনঘনত্বের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে গত আট মাস ধরে করোনার মতো মহামারীকে সামাল দিয়ে রেখেছেন, তা গোটা ভারত দেখছে না। দেখতে দেওয়া হচ্ছে না। উল্টে এই সাফল্যের যাবতীয় ক্রেডিট দাবি করছেন মোদিজি। এর কি খুব প্রয়োজন ছিল?
আসলে নরেন্দ্র মোদিও বুঝতে পারছেন, এবার না হলে আর কখনও হবে না। যেভাবে হোক
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে উল্টে ফেলতেই হবে। একমাত্র তৃণমূল নেত্রী পথের কাঁটা হয়ে পথে পড়ে না থাকলেই দেশের সম্পূর্ণ গেরুয়াকরণ সম্ভব। তখন ‘অখণ্ড ভারত’, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকরের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে দ্রুত অনেকটা এগিয়ে যাবে বিজেপি। এ স্বপ্ন তো আজকের নয়... জনসঙ্ঘের সৃষ্টিকালের।