বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
বেহালা নয়, এখন দীপ্তি দেবীর ঠিকানা দক্ষিণ ২৪ পরগনার বৃদ্ধাশ্রম। নয় নয় করে ১৫টা বছর কেটে গেল। দীপ্তি দেবীই বৃদ্ধাশ্রমের প্রবীণতমা। বাড়ি ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে এলেও বাঁধন ছিঁড়তে পারেননি। তাই ছেলের কাছে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার আব্দার করেন। অনুমতিও মেলে। তবে, ওই দু’তিন দিন। প্রতিবারই ফেরেন চোখের জল মুছতে মুছতে। দীপ্তি দেবী জানেন, ছেলে-বউমার সংসারে তিনি আজ মস্ত এক ‘বোঝা’। সব বুঝেও তিনি অবুঝ। এ যে নাড়ির টান! অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা। কাটতে পারেনি ধাই-মাও। তাই এখনও এই বয়সেও প্রতিদিন সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বেলে সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। সেই মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে সন্তান রয়েছে মহা সুখে।
কিন্তু, এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। শাস্ত্র বলছে, ‘পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহি পরমন্তপঃ।/ পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতাঃ।।’ শাস্ত্র আমাদের শিখিয়েছে, পিতার সন্তুষ্টিতেই সন্তুষ্ট হন স্বর্গের সমস্ত দেবতা। শাস্ত্রই বলেছে, ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।’ স্বর্গের চেয়েও বড় জননী ও জন্মভূমি। শাস্ত্র ও সনাতন ভারতের ভাবনায়, পৃথিবীতে জীবন্ত দেব-দেবী হলেন বাবা, মা। সন্তানের কাছে যাঁরা পরম পূজনীয়, তাঁরাই আজ দিকে দিকে হচ্ছেন লাঞ্ছিত।
অসীম স্নেহে ও যত্নে তিল তিল করে বড় করে তোলা বহু সন্তানেরই মান ও হুঁশের ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। এমনকী, যাঁদের জন্য পৃথিবীর আলো দেখা, বহু ক্ষেত্রেই সেই বাবা মায়ের জীবনদীপ নিভছে ছেলে বউমার বিষাক্ত নিঃশ্বাসে। সন্তানের অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতা লঙ্ঘন করছে সহ্যের সমস্ত সীমা। তাই বাবা, মায়ের সুরক্ষার জন্য সরকারকে আনতে হচ্ছে আরও কঠোর বিল। যে কাজ করে সন্তানের ধন্য হওয়ার কথা, তা পালনের জন্য দেখাতে হচ্ছে জেলের ঘানি টানার ভয়। এ বড়ই দুর্ভাগ্য। লজ্জাও বোধহয় এদের দেখে লজ্জায় মুখ লুকায়!
সংসদের আসন্ন বাদল অধিবেশনে সরকার ‘মেনটেন্যান্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অব পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজেনস (সংশোধনী) বিল’ আনছে। বৃদ্ধ ও আর্থিকভাবে দুর্বল বাবা মায়ের প্রতি কত্যব্য পালন না করলে আর্থিক জরিমানা ও জেলের বিধান থাকছে এই বিলে। আইন কার্যকর করতে প্রতিটি থানায় থাকবেন একজন নোডাল পুলিস অফিসার।
কিন্তু, এমনটাও তো হওয়ার কথা ছিল না। সনাতন ভারতের শিক্ষা তো অন্য রকম। মুনি ঋষি থেকে কবি, গীতা থেকে উপনিষদ আমাদের ত্যাগ ও সেবার শিক্ষাই দেয়। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু থেকে স্বামী বিবেকানন্দ সকলেই সেই ক্ষমা ও ত্যাগের কথাই বলেছেন। ভারতের এই সনাতনী শিক্ষা ও ত্যাগের আদর্শ গোটা বিশ্বে সমাদৃত। প্রায় সমস্ত উন্নত দেশের মানুষ ভারতের এই ত্যাগের সংস্কৃতিকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। কারণ তাঁরাও বুঝেছেন, ভোগে নয়, ত্যাগেই মুক্তি। তাই দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, গৌতম বুদ্ধের বাণী। মানসিক প্রশান্তির ও মোহ মুক্তির পথ দেখাচ্ছে এই সমস্ত মহামানবের আদর্শ।
অপ্রিয় হলেও সত্যি, ভারতবর্ষের বুকে তার ঠিক উল্টোটাই ঘটে চলেছে। পাশ্চাত্যের ভোগবাদী জীবনকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছি। চলছে বিলাসবহুল জীবনকে ছোঁয়ার মরিয়া চেষ্টা। প্রতিষ্ঠালাভের আশায় সন্তানদের শামিল করা হচ্ছে ইঁদুর দৌড়ে। প্রতিটি মুহূর্ত টার্গেট পূরণের চেষ্টা। লক্ষ্যভেদই একমাত্র লক্ষ্য। সেখানে মূল্যবোধ, সততা, আদর্শ গৌণ। চলছে মনুষ্যত্বহীন মানুষ তৈরির এক ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা।
পরিবর্তন অনস্বীকারর্য। তারই হাত ধরেই যৌথ পরিবার আজ ‘নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি’। প্রতিষ্ঠা এবং প্রয়োজনের তাগিদে এই ভাঙন ছিল অবশ্যম্ভাবী। তবে একান্নবর্তী পরিবারের এই ভাঙনের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ক্ষুদ্র স্বার্থপরতার বীজ। ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার আশায় পাহাড়প্রমাণ চাপ নিয়েই চলছে দৌড়। এর শুরু আছে, শেষ নেই।
ভবিষ্যৎ সর্বদাই অনিশ্চিত। তবুও ভবিষ্যৎ গড়ার অবিরাম চেষ্টা। আর তাতেই আলগা হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। দায়িত্ব, কর্তব্য, দায়বদ্ধতা, এখন অনেকের কাছেই ‘বার্ডেন’। সম্পর্ক এখন প্রয়োজন ভিত্তিক। তৈরি হওয়া ও ভাঙা দুই-ই। যে সম্পর্ক লাভজনক নয়, তা হয়ে যাচ্ছে মূল্যহীন। তাই ‘আত্মিক সম্পর্ক’ শব্দটা আজ ‘ব্যাক ডেটেড’। গুরুত্ব পাচ্ছে কেরিয়ার। ঝলমলে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানিতে উপড়ে যাচ্ছে মূল। মূল্যবোধও। শিকড়ের টান বলে আর এখন কিছু হয় না। বৃদ্ধ বাবা, মা একাকীত্বে ভুগলেও নয়। নিঃসঙ্গ জীবন বড় অসহনীয়। তাই বৃদ্ধাশ্রমের রমরমা।
দিন দিন বাড়ছে বৃদ্ধাশ্রম। কিন্তু যাঁদের বৃদ্ধাশ্রমে থাকার রসদ নেই, কিংবা রয়েছে লোকলজ্জার ভয়, তাঁদের অবস্থা আরও করুণ। কেউ ছেলের বউমার অত্যাচারে আশ্রয় নিচ্ছেন বাপের বাড়িতে। আবার কেউ লাঞ্ছনা, গঞ্জনায় অতিষ্ঠ হয়ে আত্মঘাতী হচ্ছেন। সেই সাহস যাঁদের নেই তাঁদের ভাতের স্বাদ বড়ই লবণাক্ত। অন্নগ্রহণ পর্বে চোখের জল ফেলা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বৃদ্ধ বাবা মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনাও প্রচুর। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বাড়িতে ফিরতে পারছেন। কিন্তু তাতেও নির্যাতনের মাত্রা কমছে না। ভাতের তুলনায় মুখ ঝামটা অনেক বেশি। নিজের বাড়িতে, নিজের সংসারে, নিজের সন্তানের কাছে দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জন্য পুলিসের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। হায় রে কপাল! গৃহবধূর ছদ্মবেশধারী মা অন্নপূর্ণাকে নদী পার করেছিলেন ঈশ্বরী পাটনী। দেবী অন্নপূর্ণা সন্তুষ্ট হয়ে ঈশ্বরী পাটনীকে বর প্রার্থনা করতে বলেছিলেন। তিনি নিজের জন্য কিছু চাননি, চেয়েছিলেন সন্তানের জন্য। ঈশ্বরী পাটনী বলেছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের এই ক’টি লাইনেই ফুটে ওঠে সন্তানের প্রতি অসীম মমত্বের ছবি।
ভারতচন্দ্র যুগসন্ধির কবি। মধ্যযুগ পেরিয়ে আজ আমরা আধুনিক যুগে। যুগের বদল হলেও সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের ভাবনা একই থেকে গিয়েছে। আজও ঘরে ঘরে ঈশ্বরী পাটনীরা প্রভুর কাছে করজোড়ে সন্তানের মঙ্গল কামনাই করেন। ক্ষমা, ধৈর্য, ত্যাগ, উদারতার মতো ভারসাম্য বজায় রাখতে পারাও এ যুগে একটা বড় গুণ। স্নেহের সঙ্গে শাসনের ভারসাম্য। আজকাল সন্তানের সংখ্যা এক বা দুই। ফলে প্রায় সব বাড়িতেই অঢেল স্নেহ আর আদর। কথায় আছে, আদরে বাঁদর হয়। আর বাঁদর হয়ে গেলে সহ্য করতে হয় বাঁদরামি। তাই স্নেহের সঙ্গে শাসনের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সেটা যাঁরা পারেন তাঁদের বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় না। তখন বাড়িই হয়ে যায় ‘আনন্দাশ্রম’।
‘সন্তান যদি ছেলে হয়, সে ছেলে থাকে বিয়ে পর্যন্ত। আর মেয়ে... আজীবন।’ সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার সম্পর্কিত এক মামলায় রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অরুণ মিশ্রের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ এমন মন্তব্যই করেছে।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মহামান্য বিচারপতিদের এই মন্তব্য যুগান্তকারী বলে অনেকে মনে করছেন। তাই পুত্রসন্তানদের ভাবার সময় এসেছে। ভাবতে হবে, কেন এই মন্তব্য? ভাবতে হবে, কেন বাবা-মায়ের ভরণপোষণের জন্য আনতে হচ্ছে আরও কঠোর আইন!
দরকার আত্মসমালোচনার। সেই সব সন্তানের, যাঁদের জন্য বাবা মাকে ফেলতে হয় চোখের জল। একমাত্র আত্মসমালোচনাই খুলে দিতে পারে মূ্ল্যবোধের দরজা। দূর করতে পারে যাবতীয় সঙ্কীর্ণতা। শুধু আইন করে এই জটিল সামাজিক ব্যাধির নিরাময় সম্ভব নয়। জেলে পোরার ভয় দেখিয়ে হয়তো ক্রিমিনালকে শায়েস্তা করা যায়, কিন্তু সন্তানের মূল্যবোধ তৈরি করা যায় না। তার জন্য প্রয়োজন ‘সেলফ ক্রিটিসিজিম’।