বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
এসবের সঙ্গেই চলেছে মাসের শেষ রবিবার সকালে নিয়ম করে রেডিওতে তাঁর একান্তআত্ম কথনের মেগা সিরিয়াল ‘মন কি বাত’। গত রবিবারই তার টানটান ৬৬টি এপিসোড পার হয়ে গিয়েছে। সর্বশেষ এপিসোডের ঠিক ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই গত মঙ্গলবার ছিল করোনা মরশুমে তাঁর ষষ্ঠবার দেশবাসীকে সম্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণ। সেখানেই তিনি ছটপুজো পর্যন্ত দেশের অন্নদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন বিহারের ভোটকে কুনজরে রেখে। কিন্তু এ তো প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনার সামান্য মেয়াদ বৃদ্ধি ছাড়া কিছুই নয়। মাত্র ওইটুকুর জন্য রাষ্ট্রনেতার জাতির উদ্দেশে ভাষণ? তারও পর সবটাই এরাজ্যে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল যখন মোদির ওই ভাষণের আধ ঘণ্টার মধ্যেই সাংবাদিক সম্মেলন করলেন বাংলার অগ্নিকন্যা। জানালেন, নভেম্বর নয়, পরের বছরের জুন মাস পর্যন্ত বিনামূল্যে রাজ্যে রেশন দেওয়া হবে। স্বাধীন ভারতে এক অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গোটা দেশের প্রধানমন্ত্রীর এমন বিস্ময়কর ‘পরাজয়’ কেউ কোনওদিন দেখেছে! মনে পড়ে না।
যুদ্ধ নয়, প্রলয় নয়, বড় কোনও জাতীয় বিপর্যয় বা সাংবিধানিক সঙ্কটও নয়, শুধুমাত্র একটি যোজনার মেয়াদ নভেম্বর পর্যন্ত বাড়াতে রাষ্ট্রকে সম্বোধনের এমন বর্ণাঢ্য আয়োজন! তাহলে তো এরপর থেকে রোজ কোনও সিদ্ধান্ত হলেই রাত আটটার স্লট ধীরে ধীরে মোদিজির জন্য পাকা হবে। ড্রইংরুমে বোকাবাক্সের সামনে কোনও আসন ফাঁকা থাকার জো নেই যে! এরকম চললে ধীরে ধীরে সব জনপ্রিয় মেগা সিরিয়ালের বাজার তিনি একাই শেষ করে দেবেন!
যখনই মোদিজির রাষ্ট্রকে ভাষণ দেওয়ার কথা ওঠে তখনই মনে পড়ে যায় প্রায় ৪৪ মাস আগের নোট বাতিলের সেই ভয়ঙ্কর অভিশপ্ত রাতের কথা। ৮ নভেম্বর ২০১৬। সেদিনের মতো রাত আটটার প্রাইম স্লটে এমন লোমহর্ষক আগাগোড়া বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে স্ক্রিপ্ট পড়তে আর কাউকে কোনওদিন দেখেনি টেলিপ্রেমী দেশবাসী। এক নিমেষে গরিব থেকে আমির সবার পকেট ফাঁকা করে দেওয়ার এমন ম্যাজিক আগে কোনও জাদুকর দেখাননি তাঁদের স্বপ্নের ইন্দ্রজালে। কালো টাকা ধরতে আর গরিবি মুছতে সেদিন দেশের সব ৫০০ ও হাজার টাকার নোট ‘ভ্যানিশ’ করে দিয়েছিলেন তিনি। তবে কাজের কাজ কিচ্ছু হয়নি। দুঃসহ গরিবি ও কালো টাকার দাপট আজও কিন্তু সমানে চলছে। কমেনি, বরং বেড়েছে। তাঁর ওই ঘোষণার বিষময় ফল আজও আমরা প্রত্যেকেই কম বেশি বয়ে বেড়াচ্ছি। নোটবন্দির গভীর ক্ষতটা আমাদের শিরায় উপশিরায় অর্থনীতির পরতে পরতে জমাট বাঁধা রক্তের মতো চেপে বসে আছে। অনেক ওষুধ দিয়েও তাকে আবার আগের মতো পুরনো ধমনীতে প্রবাহিত করা যাচ্ছে না।
এরকম করোনা আবহেই গত ৩ এপ্রিল প্রথমবার সকাল ৯টার স্লটে মাত্র সাড়ে ১১ মিনিটের ভাষণ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ওটাই ছিল চলতি প্যানডেমিক মরশুমে তাঁর সবচেয়ে কম সময়ের জাতির উদ্দেশে ভাষণ। সম্ভবত স্বাধীন ভারতের ইতিহাসেও। সেদিন দেশবাসীকে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে করোনা যোদ্ধাদের মনোবল বাড়াতে প্রদীপ জ্বালানোর আহ্বান করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। জানি না, শুধু এইটুকু বলার জন্য তাঁর কোনও পূর্বসূরি হাঁকডাক করে রাষ্ট্রকে সম্বোধনের কথা কখনও ভেবেছেন কি না! তাঁদের ভাগ্যে ১৫ আগস্ট লালকেল্লার ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের বাইরে এমন চড়া সুরে জাতিকে সম্বোধন তো দূর কল্পনাতেও কখনও ছিল না! আর সেই কারণেই অনেক আগেই সংখ্যার নিরিখে নেহরু, ইন্দিরা, বাজপেয়ির মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাষ্ট্রনেতাদের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন তিনি। আর এখন যে গতিতে তিনি ছুটছেন তাতে ২০২৪ সালের আগে এই সংক্রান্ত যাবতীয় আর্ন্তজাতিক রেকর্ডও নিশ্চিতভাবে তাঁর পায়ে তলায় মুখ থুবড়ে পড়বে। কারণ বিশ্ব রাজনীতির খেলায় তাঁর প্রধান চ্যালেঞ্জোর ট্রাম্প সাহেব মার্কিন নির্বাচনের প্রাক্কালে আকস্মিক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। হঠাৎ যেন মার্কিন মুলুকে সমীকরণ অদ্ভুতভাবে বদলাচ্ছে। আর মার্কিন মুলুকে হাওয়া ঘুরলে ধুরন্ধর মোদিও কি ‘নমস্তে বিডেন’-এর মতো নয়া কোনও ইভেন্টের জন্য তৈরি হতে খুব একটা বিলম্ব করবেন, মনে হয় না।
ঠিক যেমন আমাদের দেশের সাংবিধানিক কাঠামোটাই হয়তো আমূল বদলে যাবে, রাজ্যসভায় একবার গেরুয়া শিবির গরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে। লোকসভা তো আছেই, রাজ্যসভাও তখন মোদি, অমিত শাহদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। খেলার ছলে পাশ হবে বিতর্কিত সব বিল। প্রতিবাদ হবে, আন্দোলন তীব্র হবে। কিন্তু পাল্লা দিয়ে অযোধ্যার মন্দিরের সঙ্গে ছুটবে হিন্দুত্বের রথও। এখনও পর্যন্ত গত সাত দশকে আম্বেদকর সাহেব প্রণীত ভারতীয় সংবিধানের সংশোধন হয়েছে ১০৪ বার। ঐতিহাসিক জিএসটি চালু হয়েছে ১০১তম সংশোধনের মাধ্যমে। কিন্তু মোদিজি যেভাবে এগচ্ছেন তাতে শীঘ্রই ‘মন কি বাত’-এর মোট সংখ্যা সেঞ্চুরি পেরিয়ে ৭০ বছরের সংবিধান সংশোধনের সংখ্যাকেও টপকে যাবে অবলীলায়। কারণ, মাসে একটা করে সংবিধান সংশোধন কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। আর এখন তো উনি মাসে দু’টো কখনও তিনটে পর্যন্ত ভাষণ দিচ্ছেন অক্লেশে। এই ঘুমিয়ে থাকা ঝিম ধরা বাজারে নিউজ চ্যানেলের টিআরপি বাড়ানোরও ওটাই শ্রেষ্ঠ দাওয়াই। কিন্তু প্রশ্ন করি, গোটা বিষয়টির তাৎপর্য এতে কমে যাচ্ছে না কি?
এরকমই আর একবার জাতিকে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন ১২ মে রাত আটটায়। সেদিনও অনেক অপেক্ষা আর টানাপোড়েনের পর শুধু একটা প্যাকেজ দিয়েই ভাষণ শেষ করলেন মোদিজি। ভাষণের মেয়াদ ছিল ৩৪ মিনিট ৫ সেকেন্ড। অতিমারী মরশুমের দীর্ঘতম। তবু প্রায় স্তব্ধ হয়ে যাওয়া ছোট, মাঝারি উদ্যোগকে চাঙ্গা করতে তিনি ২০ লাখ টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করলেও সেই রাতে মিলল না আর কোনও খতিয়ান। শুরু হল অনন্ত অপেক্ষা। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী চিদম্বরম সাহেব পরদিন কৌতুক করে বলেছিলেন, আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী শুধু হেডলাইনটা দিয়েছেন। ওইটুকু নিয়েই দেশবাসী খুশি থাকুন। বাকিটা ক্রমশ প্রকাশ্য। বিস্তারিতটা বলবেন অর্থমন্ত্রী। ঠিক তাই হল। মোদিজির জাতির উদ্দেশে ভাষণের ব্যাখ্যা দিতে প্রায় একসপ্তাহ টানা বিকেল ৪টেয় বসতে হল অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে। তবু ধোঁয়াশা কাটল না। মিলল না তেমন কোনও সুরাহাও। শুধু দু’শো ঋণের ফিরিস্তি। অথচ প্রতি বছরই ফেব্রুয়ারির শেষে সাধারণ বাজেট পড়া শেষ হয়ে যায় মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টায়। বড়জোর দু’ঘণ্টায়। বাজেটের আগে প্রধানমন্ত্রীকে জাতিকে সম্বোধন করতে হয় না। আর সামান্য করোনা প্যাকেজ ব্যাখ্যা করতেই সরকারের কেটে গেল প্রায় এক সপ্তাহ। প্রথমটায় জাতিকে শুধু হেডলাইনটা দিয়েই থামলেন প্রধানমন্ত্রী। তারপর কিস্তিতে কিস্তিতে ঝেড়ে কাশলেন দেশের বিত্তমন্ত্রী। তবু ওই প্যাকেজের পর গত দেড় মাসে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াল কি?
১৯ মার্চ, ২০২০। করোনা পরিস্থিতিতে সেদিনই প্রথম টিভির পর্দায় আসেন দেশের মহামান্য নেতা। নিদান দেন জনতা কার্ফু পালনের। আর সন্ধ্যায় যে যার বাড়ির বারান্দা থেকে থালা বাটি বাজিয়ে করোনার বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ লড়াইয়ের শপথ নেওয়ার। নিঃসন্দেহে অভিনব উদ্যোগ, কিন্তু ২৮ মিনিট ৫৪ সেকেন্ডের ভাষণের নিট প্রাপ্তি শুধু এইটুকুই। ভয় হয় ভ্যাকসিন বেরলে কতবার রাষ্ট্রকে ব্যাখ্যা করতে টিভি চ্যানেলে আবির্ভূত হবেন তিনি!
স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, প্রধানমন্ত্রী জাতিকে সম্বোধন করেন কখন? উত্তর সহজ, বিরাট কোনও জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হলে তবেই। সম্ভবত মোদিজির পূর্বসূরিরা ভাবতেও পারতেন না মাসে কখনও দুটো কখনও তিনটে রাষ্ট্রীয় সম্বোধনের কথা। দপ্তরের মন্ত্রীকে দিয়ে কিম্বা সামান্য একটা বিজ্ঞপ্তি জারি করেই যা বলে দেওয়া যায়, তার জন্য ঢাক ঢোল পিটিয়ে জাতির উদ্দেশে সম্ভাষণ। কিন্তু ভদ্রলোকের নাম যখন নরেন্দ্র মোদি তখন জনসংযোগের সামান্যতম সুযোগ হাতছাড়া করতে কোনও অবস্থাতেই রাজি নন তিনি। এসবই ছোট থেকে আরএসএসের শিক্ষা ও আদর্শে বড় হয়ে ওঠার ফল। রাতদিন পরিশ্রমও করতে পারেন অসম্ভব। কিন্তু ওই যে বললাম, অতি ব্যবহারে সব অস্ত্রই ভোঁতা হয়ে যায়। গুরুত্ব হারায়। গোটা বিষয়টির তাৎপর্যও অনেকটা লঘু হয়ে যায়। অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনেই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন রাষ্ট্রনেতারা। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, অর্থনৈতিক কোনও সঙ্কট, ক্ষমতা বদল কিম্বা বড় কোনও সাংবিধানিক সঙ্কটের পরিস্থিতি তৈরি হলেই এ ধরনের ভাষণের প্রয়োজন দেখা দেয়। সরকার কী করতে যাচ্ছে তা দেশের মানুষকে আগাম জানিয়ে তবেই পদক্ষেপ করে সরকার। কিন্তু তা বলে অনেক অপেক্ষার পরও যদি দেখা যায়, মামুলি কিছু কথা বলেই বক্তব্য শেষ হয়ে গেল, তেমন বড় কোনও ঘোষণা হল না। মিলল না তেমন কোনও সুরাহাও। তাহলে মহামান্য দেশনেতার জাতির উদ্দেশে ভাষণের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রীর যত দ্রুত এই আত্মোপলব্ধিটা হয়, ততই দেশের মঙ্গল। সম্ভবত সেই জন্যই আব্রাহাম লিঙ্কন বলে গিয়েছেন, সব মানুষকে সব সময়ের জন্য বোকা বানানো যায় না।