বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
ভারতের শ্রমিকদের বেশিরভাগই অসংগঠিত। তাই নিখুঁত পরিসংখ্যান পাওয়া দুষ্কর। সরকারি, বেসরকারি নানা সূত্রে জানা যায় যে, ভারতে মোট শ্রমিক ৪৯ থেকে ৫০ কোটি (তাতে ফি বছর যোগ হয় গড়ে ৭০-৮০ লক্ষ)। তাঁদের প্রায় ২০ শতাংশ মাইগ্র্যান্ট বা পরিযায়ী। সংখ্যার হিসেবে প্রায় ১০ কোটি। এঁদের কাজের সুযোগটা মূলত মরশুমি। কৃষিপ্রধান ভারত। ফসল রোয়া ও কাটার সময় বাদ দিলে নিজ নিজ গ্রামে এঁদের হাতে কাজ বিশেষ থাকে না। পেট চালানোর জন্য বাকি সময়টা তাঁরা ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে যান। এঁদের ৪০ শতাংশের কাজ নির্মাণ শিল্পে। ২০ শতাংশ যুক্ত গৃহস্থালির কাজে। বাকিরা ইটভাটা, টেক্সটাইল, পরিবহণ পরিষেবা, গাড়ি নির্মাণ, খনি, বাগিচা প্রভৃতি ক্ষেত্রে যুক্ত। এঁদের কাজের সুযোগ সবচেয়ে বেশি দিল্লি, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, কেরল ও অন্ধ্রপ্রদেশে। ২৪ মার্চ রাতে মাত্র চার ঘণ্টার নোটিসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করলেন। তখনও এই মানুষগুলির জানা ছিল না, তাঁদের সামনে রাতের চেয়েও অন্ধকার সব দিন অপেক্ষা করে আছে!
আমাদের কাছে ‘মানুষ’ ব্যর্থ হয়েছে ‘মানবসম্পদ’ হয়ে উঠতে। ‘দেশ’ আর ‘মানুষ’ সমার্থক হয়ে ওঠেনি। দেশ মানে একটি মানচিত্র। একটি রাজনৈতিক ভূগোল। রাষ্ট্র মানে একটি কঠিন কঠোর নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা। সরকার মানে একচ্ছত্র ক্ষমতা। তার মন না-থাকলেও কিচ্ছুটি যায় আসে না। পরিযায়ী শ্রমিকদের যথাসময়ে বাড়ি ফেরার বাস্তবটি বিবেচনার মধ্যে না-নিয়েই লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। তারপর তাঁদের জন্য ন্যূনতম সুরক্ষার ব্যবস্থা করতেও ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র। ২৭ মার্চ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকে দিয়ে ১.৭ লক্ষ কোটি টাকার যে গালভরা আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করা হল এবং নিয়োগ সংস্থাগুলিকে সরকার যে নির্দেশিকা পাঠাল, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যে আর্জি জানালেন—পরিযায়ী শ্রমিকদের ক’জনের কাছে তার সুবিধা পৌঁছল? এর উত্তর ওই ক্ষুধাক্লান্ত শ্রমিকদের মুখের বাইরে খুঁজতে যাওয়া বাহুল্য।
বাস্তবে আমরা দেখলাম, লকডাউনকালে ৮০ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিকের বেতনের আর্জি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ভাড়া দিতে না-পারায় কোনওরকমে মাথাগোঁজার এক চিলতে ঘরটাও চলে গিয়েছে। সরকারের তরফে থাকার এবং রেশনের ব্যবস্থা হয়নি। নগদ টাকা পাননি। হাতেগাঁটে যা যৎসামান্য ছিল তা শেষ হয়ে গিয়েছিল প্রথম কয়েক দিনের ভিতরেই। অতএব তাঁদের সম্বল তখন এক পেট খিদে, এক বুক তৃষ্ণা, সামনে শেষ না-হওয়া পথ আর প্রিয় ঘরে ফিরে যাওয়ার কষ্টকল্পনা। মাইলের পর মাইল হেঁটে, কেউ-বা শিশুকে কোলেকাঁখে নিয়ে, কেউ-বা কাঁধে নিয়েছেন বৃদ্ধ অসুস্থ বাবা কিংবা মাকে। আমরা শিউরে উঠলাম, গত শুক্রবার আওরঙ্গাবাদে মালগাড়ির ধাক্কায় ১৬ জনের মৃত্যু সংবাদে, যে ক্লান্ত মানুষগুলি ‘নিশ্চিন্তে’ বিশ্রাম নিচ্ছিলেন রেললাইনের উপর। এছাড়া মুম্বই, দিল্লি, আমেদাবাদ-সহ নানা স্থানে ঘরমুখো মানুষ হেনস্তা, এমনকী পুলিসি নিগ্রহেরও শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন মানসিক প্রতিবন্ধীও! উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, কর্ণাটক, ওড়িশা প্রভৃতি কয়েকটি রাজ্য মহারাষ্ট্র থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরাতে রাজি ছিল না। বিহার প্রথমে ‘ব্ল্যাঙ্কেট কনসেন্ট’ দিয়েও প্রত্যাহার করে নেয়। নীতীশ সরকার বলল, ‘কেস টু কেস’ দেখে ব্যবস্থা নেবে। দিল্লি, গাজিয়াবাদে আটকে পড়া শ্রমিকদের নিজ নিজ জেলায় ফেরত পাঠানোর জন্য বাস দিয়েছিল অবশ্য যোগী সরকার। অন্যদিকে, দেরিতে হলেও বিচ্ছিন্নভাবে পশ্চিমবঙ্গ, কর্ণাটক প্রভৃতি দু-চারটি রাজ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের অন্য রাজ্যে ফেরত পাঠানোর বাসের ব্যবস্থা করেছে। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস প্রভৃতি বিরোধী দলের লাগাতার সমালোচনার জবাবে মোদি সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য অতি সম্প্রতি ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের কিছু প্রস্তাবই দিয়েছে কেবল। তাতে কোনও সমাধানই যে হওয়ার নয়, তা মোদিজির থেকে বেশি কারও জানা নেই।
পরিষ্কার ব্যাপার এই যে, পরিযায়ী শ্রমিকদের সেফটি ও সিকিউরিটির দায়িত্ব সরকার তাহলে কতটা নিল আর কতটা ব্যক্তি-নাগরিকের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হল? সব দেখেশুনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন আর একদল মানুষ—এঁরা দিল্লি, মুম্বই, আমেদাবাদ প্রভৃতি শহরে ছোটখাটো চাকরি করেন। লকডাউনের দু’-চারদিন আগেই অন্য প্রয়োজনে বাংলার বাড়িতে এসেছিলেন। আর ফিরতে পারেননি। যেমন এক যুবক দিল্লিতে এক ব্যবসায়ী পরিবারে গাড়ি চালক। এক প্রৌঢ়া মুম্বই শহরে ডাক্তার দম্পতির দু’বছরের কন্যার কেয়ার নেন। তাঁরা ফিরে এসেছেন যথাক্রমে বারুইপুরে ও পায়রাডাঙায়। লকডাউনের পর এঁরা বাংলাতেই ১০০ দিনের কাজ অথবা কুটির শিল্পে যুক্ত হয়ে নতুন জীবনের সন্ধানে নামবেন বলে ভাবছেন। আর জীবন বাজি রেখে এখন যাঁরা ফিরছেন এবং ফিরবেন? অপ্রবাসে শাকান্নে সুখে থাকার দর্শনে ডুব দিতে পারেন। প্রবাসজীবন সম্পর্কে বলছেন, ভিক্ষের দরকার নেই মা, কুকুর সামলাও!
লকডাউনকালে প্রবাসজীবনের বিভীষিকা এঁদের সবার পক্ষে এখনই ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে না। কিছু শিল্পকর্তার আশঙ্কা, লকডাউন উঠে যাওয়ার পর, এই কারণে, বহু শিল্প শ্রমিকসঙ্কটে পড়বে। ঘুরে দাঁড়াবার মুহূর্তেই মার খাবে উৎপাদন। যেমন বহুজাতিক অটোমোবাইল কোম্পানিগুলির দেশীয় ইউনিট, দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানি ক্ষেত্র অলঙ্কার নির্মাণ শিল্প। করোনা-পরবর্তী ভারতে শুধু বেকার বাড়বে না, সমস্ত জিনিসের হাহাকারও বাড়বে। জাহাজঘাটা ক্রেন পাবে না। ওয়াগনে মাল লোডিং আনলোডিংয়ের লোক অমিল হবে। কলকাতা মেট্রো রেলের মতো বহু চালু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বেসরকারি গণপরিবহণ প্রকল্প বিশবাঁও জলে পড়ে যাবে। অসমাপ্ত বাড়ি, অফিস শেষ করার সিমেন্ট, ইস্পাতের আকাল দেখা দেবে। একই সঙ্কটে পড়বে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম শিল্প। সিমলা, কাশ্মীর, নাগপুরে আপেল অথবা কমলা বাগিচায় শ্রমিক বাড়ন্ত হবে। ১৮৯৬-তে প্লেগের সময় পাইকারি হারে মানুষ বম্বের মতো একাধিক মহানগরী ছেড়ে পালিয়েছিল। পরে শ্রমিকদের ফেরাতে হয়েছিল ইনসেনটিভের লোভ দেখিয়ে। করোনা-পরবর্তী ভারতের শিল্প-বাণিজ্যের কর্ণধারদেরও কি তার পুনরাবৃত্তি করতে হবে?
শুধু অভ্যন্তরীণ মাইগ্রেশন নয়, ভারতের লেবার মার্কেট বহির্ভারতে মাইগ্রেশনের উপরেও বিশেষভাবে নির্ভরশীল। তার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয় ভারতের অর্থনীতি। সাম্প্রতিক একাধিক বছরের হিসাব থেকে দেখা যায়, এফডিআইয়ের মাধ্যমে যত বিদেশি মুদ্রা আসে তার তুলনায় দেড় গুণ বেশি আসে প্রবাসী ভারতীয় শ্রমিকদের মাধ্যমে। তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও ট্রেনিং যৎসামান্য। ১৮টি ইসিআর-ভুক্ত দেশ, ছয়টি উপসাগরীয় দেশ এবং ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতিতে তিন কোটির বেশি ভারতীয় নানা ধরনের চাকরি করেন। এই চাকরির ৯০ শতাংশ আরব দেশসমূহে। তাঁদের আয় ভারতের দেড় থেকে তিন গুণ। প্রবাসী শ্রমিকদের প্রায় তিনভাগের একভাগ উত্তরপ্রদেশের। বাকিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিহার, তামিলনাড়ু, কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব, রাজস্থান, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, ওড়িশা প্রভৃতি। সাম্প্রতিক অতীতে তেল অর্থনীতি যতবার ধাক্কা খেয়েছে ততবার চাকরি খুইয়েছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। করোনার ধাক্কায় তেল অর্থনীতির করুণ দশা। তাই সংশ্লিষ্ট শ্রমিক মহলের কপালে নতুন চিন্তার ভাঁজ। ২৪ মার্চ লকডাউন ঘোষণা যখন হল তখন দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৮ শতাংশের বেশি। সিএমআইই-র হিসাবে: ১১ মে তা বেড়ে হয়েছে ২৫ ছুঁই ছুঁই! অর্থনীতির বৃদ্ধির হার পুরোপুরি থমকে গিয়েছে, এমনকী নেগেটিভও হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদদের একাংশ। নুয়ে পড়া এই অর্থনীতি কি পারবে তাঁদের সহায় হতে?
দরিদ্র (লজ্জায় বলি ‘উন্নয়নশীল’) ভারতকে ‘উন্নত’ ভারতে রূপান্তরিত করার স্বপ্ন দেখিয়ে নিজ নিজ মেয়াদ পার করেছেন অতীতের প্রধানমন্ত্রীরা। তবু ভারত এখনও তিমিরেই! পরিযায়ী শ্রমিকদের এই দুর্দশা থেকে মোদিজি কি কোনও পাঠ নিলেন? দ্বিতীয় দফায় তিনি অনেক সময় পাবেন। দেখুন না, ভারতজুড়ে শিল্প গড়া যায় কি না। আগের মতো ‘আমার জায়গা’য় কয়েকটি শিল্প-পকেট নয়। আক্ষরিক অর্থেই বিকেন্দ্রীকরণ চাই। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোরও মৌলিক চাহিদা এটা। তবে, বিরোধীদের সবক শেখানোর কংগ্রেসি রাজনীতির ছেঁড়া জুতোয় পা গলালে হবে না। তার থেকে একটু ঊর্ধ্বে উঠতেই হবে। বিকেন্দ্রিত শিল্পায়ন ছাড়া লাখো লাখো শ্রমিকের ভিন রাজ্যে, ভিন দেশে ভাগ্যান্বেষণে গমন ঠেকানো অসম্ভব। অন্তত শুভ সূচনাও যদি আপনার হাতে হয়, হলফ করে বলতে পারি—মোদিজি, আপনার ফর্সা কুর্তা-চুড়িদারের পার্মানেন্ট ব্ল্যাক কালিও ম্যাজিকের মতো সাফ হয়ে যাবে।