বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
দুই রাজ্যেই বিজেপি কান ঘেঁষে সরকার গড়লেও শক্তি কমে যাওয়ায় ও ছোট দলের উপর নির্ভরতা বাড়ায় আগাগোড়াই যথেষ্ট চাপে থাকবে। প্রতিনিয়ত দর কষাকষি চলবে সহযোগী আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে। সেই ইঙ্গিত শুরুতেই দিয়ে রেখেছেন শিবসেনা প্রধান উদ্ধব থ্যাকারে। সেখানে ছেলে আদিত্যকে বাজি রেখেছেন তিনি। হরিয়ানায় কোনও দলই এবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বিজেপি সেখানে গতবারের তুলনায় ছ’টি আসন কম পেয়েছে। ফলে, বিধায়ক কেনাবেচার হাট সেখানে জমে উঠতে বাধ্য। আর মহারাষ্ট্রে গতবার যেখানে জোটের আসন ১৮৫ ছিল সেখান থেকে কমে এবার দাঁড়িয়েছে ১৬১। নিশ্চিতভাবে বলা যায় দেশের মানুষ ধীরে ধীরে মোদি-অমিত শাহ জুটির বিরুদ্ধে ভোটের বাক্সে মতামত জানাতে শুরু করেছে। সেইসঙ্গে বিভিন্ন সরকারি এজেন্সিকে দিয়ে ভয় দেখিয়ে দল ভাঙানো ও সেই পথে ক্ষমতা দখলের যে মরিয়া রাজনীতি গত কয়েক বছর ধরে বিজেপি ও তার সহযোগীরা আমদানি করেছে, মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার ফল তার বিরুদ্ধেও বজ্রনির্ঘোষ প্রতিবাদ তুলে ধরছে। গুজরাতে কংগ্রেস ভেঙে বিজেপিতে যোগ-দেওয়া অল্পেশ ঠাকুরের উপনির্বাচনে পরাজয় সেইদিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
দেখা যাচ্ছে, সোনিয়া, রাহুল গান্ধীর দিশাহীন ছন্নছাড়া নেতৃত্ব সত্ত্বেও দুই রাজ্যেই কংগ্রেস আসন বাড়িয়েছে। এ তো আসলে সেই নেগেটিভ ভোট। আরও বড় কথা, ভোটের কয়েকদিন আগে যেভাবে শারদ পাওয়ারের দলের বিরুদ্ধে দাউদ ইব্রাহিমকে জড়িয়ে সরব হয়েছিল গেরুয়া শিবির তাও হালে পানি পায়নি। উল্টে শিবসেনার আসনসংখ্যা মহারাষ্ট্রে কংগ্রেসকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। বুড়ো বয়সেও আবার এনসিপি’র পালে কিছুটা হলেও হাওয়া টানতে পেরেছেন শারদ পাওয়ার। এসবই দিগ্নির্দেশ করছে উচ্চকিত দেশপ্রেমের ধ্বজা উড়িয়ে ছোট ছোট স্থানীয় সমস্যা, অর্থনীতির সঙ্কট এবং বেনজির মন্দা থেকে দেশের মানুষের চোখ ঘোরানো দীর্ঘমেয়াদে আর সম্ভব হবে না। শুধু পাকিস্তান পাকিস্তান করে আর ৩৭০ ধারা বিলোপের বড়াই করে নির্বাচনী ময়দানে, বিশেষত বিধানসভা ভোটে, খুব বেশি লাভ তোলা কঠিন। তাই রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশের প্রতিধ্বনিই যেন শোনা গেল মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায়।
অথচ এবার দুই রাজ্যের নির্বাচনে মোদি-অমিত শাহ জুটির কাছে কার্যত ম্লান হয়ে গিয়েছিল তামাম বিরোধীরা। প্রচারেও বিরোধীদের তেমন করে দেখাই যায়নি। সোনিয়া-রাহুল গান্ধী সভা করেছেন নামমাত্র। একদিকে ৩৭০ ধারার বিলোপ এবং মাঝে মাঝেই সীমান্তে গুলিগোলা চালিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ আবহ তৈরি করে বিরোধীদের কার্যত নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ারই পটভূমি তৈরি করেছিলেন মোদি-অমিত শাহ জুটি।
কিন্তু বালাকোট-পুলওয়ামার বীরগাথা বিধানসভা ভোটে যে কাজ করে না তা আবারও প্রমাণ হয়ে গেল। এরপর আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসের বিহার, দিল্লি ও ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা নির্বাচনেও শুধু নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তিকে ব্যবহার করে বাজিমাত করা কঠিনই হবে। কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, স্থানীয় নেতৃত্বে কারা তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যের মানুষের কাছে তাঁরা কতটা গ্রহণযোগ্য তা খতিয়ে দেখতে হবে। না-হলে বিমান থেকে নেমে প্রচার আর সভা শেষ করেই দিল্লি ফিরে যাওয়ার ম্যাজিকে মানুষ মজবে না। সেই জন্যই বলছি, লোকসভা ভোটের ফর্মুলায় শুধু মোদিকে সামনে রেখে ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখোমুখি হতে বিজেপি নেতৃত্বকে সাতবার ভাবতে হবে। কারণ, মোদিজি তো আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হতে আসবেন না। আর মমতাকে ধারে ভারে মোকাবিলা করার মতো রাজনৈতিক কোনও নেতানেত্রী বিজেপির শিবিরে এখনও নেই। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি তার সাংগঠনিক প্রসারে তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ অংশের উপরেই ভরসা করছে। কিন্তু তৃণমূল খারাপ আর মুকুল রায়, অর্জুন সিং ভালো, এই রাজনৈতিক ভাঁওতাবাজি রাজ্যের মানুষ বেশিদিন সহ্য করবে বলে মনে হয় না। ভাটপাড়া জগদ্দল তাই রং বদলেও দ্রুত আবার পুরনো পথেই ফিরছে। ফিরেছে গারুলিয়াও। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে তৃণমূলের ড্যামেজ কন্ট্রোলে কাজ হতে শুরু করেছে। রাজ্যের প্রতিটি জেলায়, মহকুমায়, ব্লকে এখনও মমতার ডাকে লক্ষ লক্ষ মানুষ জড়ো হন। তাই জনপ্রিয়তায় এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টিতে মমতাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো নেতা বা নেত্রী বিপক্ষ শিবিরের হাতে নেই। বলা বাহুল্য, বিধানসভা ভোট অনেকটাই পরিচালিত হয় স্থানীয় ইস্যুতে। সেখানে বার বার প্রধানমন্ত্রীকে মুখ করে এনে প্রচারে ঢেউ তোলা যায় না। গত লোকসভা নির্বাচনে প্রশ্নটা ছিল ভিন্ন। মোদি ফের প্রধানমন্ত্রী হবেন না, বিরোধীরা মসনদে বসবেন এই প্রশ্ন এখন আর নেই। নিচুতলার কিছু নেতার ভুল-ত্রুটি সত্ত্বেও এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই রাজ্য এবং এই রাজ্যের মানুষকে যতটা হাতের তালুর মতো চেনেন তাদের সুখে-দুঃখে বুক চিতিয়ে লড়েন তার কোনও বিকল্প পাওয়া কঠিন।
বিজেপি কিন্তু ইতিমধ্যেই জেলায় জেলায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ হতে শুরু করেছে। তার উপর যে উত্তরবঙ্গ থেকে গত লোকসভা নির্বাচনে তারা বেশি আসন জিতল সেই উত্তরবঙ্গে এনআরসি ইস্যু ভয়ঙ্করভাবে সাধারণ মানুষের মনে ভয়ঙ্কর দাগ কেটেছে। এভাবে মানুষে মানুষে বিভেদ করে এবং নিজের দেশেই এক বিরাট শ্রেণীর মানুষকে পরবাসী করে ডিটেনশন ক্যাম্পে ভরে দেওয়ার পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে বাধ্য। অসম দেরিতে হলেও বুঝছে। আর পশ্চিমবঙ্গ এনআরসি নিয়ে ইতিমধ্যেই ক্ষোভে, আতঙ্কে ফুঁসতে শুরু করেছে। এর উপর একের পর এক জেলায় দল ভাঙানোর খেলা বিজেপির কাছে বুমেরাং হচ্ছে। অর্জুন সিংয়ের খাসতালুক জগদ্দল, হালিশহর, নৈহাটি, কাঁচড়াপাড়া প্রথমটায় তৃণমূলে ভাঙন ধরলেও এখন আবার দ্রুত সবাই দলে ফিরে আসছে। লোকসভা ভোটের ঝড় যে তাৎক্ষণিক তা আপামর জনসাধারণ উপলব্ধি করতে পারছে।
মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় কান ঘেঁষে বিজেপির রাজ্যপাট বজায় থাকলেও আগামী দিনে দিল্লি, বিহার ও ঝাড়খণ্ডে কিন্তু লড়াই কঠিন হবে। অর্থনৈতিক মন্দা সাধারণ মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অনেক সংস্থাই মন্দার জন্য নিয়মিত বেতন পর্যন্ত দিতে পারছে না। একের পর এক শিল্পে ছাঁটাই শুরু হয়ে গিয়েছে। অনেক নামকরা সরকারি সংস্থায়ও কর্মীরা সঙ্কটে। গত বৃহস্পতিবারই রুগ্ন বিএসএনএলের পুনরুজ্জীবনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এক বিরাট প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এজন্য প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দও করা হয়েছে। একদা দেশের প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান বিএসএনএলে গত একবছরে বেতন হয়ে গিয়েছিল অনিয়মিত। এবার ভিআরএস দিয়ে সিংহভাগ কর্মীকে বিদায় জানানোর ফর্মুলা তৈরি হচ্ছে। তাতেও সংস্থা আগামী দিনে ঘুরে দাঁড়াবে কি না তা ভবিষ্যৎই একমাত্র বলতে পারে। এয়ার ইন্ডিয়ার কোনও ক্রেতা এখনও মেলেনি। আরও বেশকিছু অলাভজনক সরকারি সংস্থা নিয়েও সরকার ভাবনা-চিন্তা করছে। কিন্তু চাহিদা না বাড়ানো গেলে, বাজারে টাকার জোগান না বাড়লে শুধু প্যাকেজ ঘোষণা করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা সম্ভব নয়। নোট বাতিল ও জিএসটি দেশীয় শিল্পের সেই যে সর্বনাশ করেছে তার ঘা এখনও শুকোয়নি। গাড়ি শিল্পে নাভিশ্বাস উঠেছে। নির্মাণ শিল্প ধুঁকছে। বহু মানুষ কাজ হারাচ্ছেন। এই অবস্থায় শুধু উচ্চকিত দেশপ্রেম আর ক্রমাগত সীমান্তে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা দেশের মানুষের আসল সমস্যার সমাধান করতে পারবে কি? যদি না-পারে তাহলে আগামী দিনে মোদি-অমিত শাহ জুটির গেরুয়া ম্যাজিক ফিকে হতে বাধ্য। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার ফল যদি সুস্পষ্টভাবে জাতীয় রাজনীতিতে ফের বিরোধীদের প্রত্যাবর্তনের রাস্তাকে সুগম করে তাহলে নতুন করে ক্ষমতার পাটিগণিত বদলাতে শুরু করবে। যে পাটিগণিতের সূত্র ধরেই পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ সালে তৃতীয়বারের মতো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয় সুনিশ্চিত করতে পারে। তার উপর বিজেপির স্থানীয় স্তরে খেয়োখেয়ি বাড়ছে। পুরনো নেতা-কর্মী, না দল-ভেঙে-আসা, কাদের হাতে নেতৃত্ব থাকবে, তা নিয়ে গোলমাল যত বাড়বে ততই মানুষের মোহভঙ্গ হতে থাকবে। সেইদিক দিয়ে ষোলো আনা বাংলা ও বাঙালির দল হিসেবে আগামী নির্বাচনে তৃণমূল কিন্তু সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে।