বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
“জিতং সর্ব্বং জিতে রসে”।
রসনা বিজয়ে বাসনা বিজয়, বাসনা বিজয়ে জন্মমৃত্যুময় সংসার চিরতরে ক্ষয় প্রাপ্ত হইয়া যায়। সংসার উচ্ছেদ করিবার হেতু একমাত্র স্বীয় জিহ্বাকে দৃঢ়রূপে সংযত রাখা। দুর্ব্বার ভোগ প্রবৃত্তির নিয়ামিকা মায়ের লোলরসনা ঐ যে সুদৃঢ় দন্তচাপে আবদ্ধ। সুদৃঢ় চাপে বদ্ধ রসনা মোক্ষমার্গে উপনীত করে জীবকে। চিত্র সহায়ে ইহা শিক্ষা দিয়াছেন ঋষি। বস্তুতঃ যাহাদের রসনা অসংযত, অতি ভাষণে ও অতি ভোজনে তাহাদেরই হয় দুরাগ্রহ। অতি ভাষণে বাক্যের অপচয়-তাহাতে ঘটে চলচ্চিত্ততা, ফলে পরনিন্দা ও পরচর্চ্চা করিবার অভ্যাস বাড়িয়া উঠে দ্রুত। আলোচিত অবগুণে গুণান্বিত জীবের অনিবার্য্য গতি হয় নরকে। অন্যদিকে অতি ভোজনের কুফলও ফলিয়া থাকে সত্তর। ইহাতে চিত্ত হয় লোভাতুর। অত্যাহারে হয় রসবৃদ্ধি, রসে কাম, কামে রাগ, রাগে বুদ্ধিভ্রংশ হয় সুনিশ্চিত।
কাম, ক্রোধ ও লোভ এই তিনটি নরকের দ্বার। কিন্তু বিচার করিলে দেখা যাইবে উহাদের মূলে রহিয়াছে আমাদের মহাশত্রু জিহ্বা। জিহ্বা সকল ইন্দ্রিয়ের গতিদাতা। জিহ্বাবেগ সম্বরণ করা যায় না। জিহ্বা দুর্দ্দমণীয়, গুরু লঘু বিচার থাকেনা বলিতে। ঐ যে অসংগত ভাষণ, ইহা মানীজনের উপর বজ্রাঘাতের ন্যায় কার্য্য করে। পক্ষান্তরে কটুবাক্যপ্রয়োগকারীকেও অন্যের নিকট লঘু হইতে হয়। কর্কশভাষী সজ্জন সমাজে চিরদিনই অনাদরের পাত্র। জীবনের বাস্তবক্ষেত্রে আমরা এই সমস্ত সত্য উপলব্ধি করিতে পারি। সুদৃঢ় দন্তচাপে আবদ্ধ রসনা দর্শনে আমরা স্মরণ করিতে পারি ঋষি গাথা—
“স্বীয় জিহ্বা শাসনে রাখিবে।”
কি চমৎকার পরিকল্পনা! চিত্র সহায়ে শিক্ষা দিয়াছেন ঋষি কত সহজে।
অতঃপর আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কর্ণদুলরূপে দোদুল্যমান ঐ শব যুগল। শব-যুগলে কি ভাব নিহিত! দর্শনেই জাগে জিজ্ঞাসা, ইহারা কি?
দিকে দিকে রহিয়াছে অনন্তজীব; কেহ ভোগবিলাসী কেহ মোক্ষাভিলাষী। ভোগে ভোগে ক্ষরিত, ব্যয়িত ও রূপায়িত হইয়া যায় বলিয়া ভোগী ক্ষরপুরুষ। বিবিধভোগ করিতে গিয়া ভোগী পায় মরণের পর মরণ, মরণে নব জন্ম, নিত্যনূতন ভোগদেহ। স্থূল জগতে মহাকাশের তলে ভোগীর এইভাবে হয় গতাগতি। আর সূক্ষ্ম জগতে চিত্তাকাশে জীব সূক্ষ্মাভিমানী। ভোগে ভোগে ইহাদের ক্ষরণ নাই বলিয়া ইহারা অক্ষর পুরুষ। কেননা ইহারা যোগাভিলাষী মুমুক্ষু। মুমুক্ষু আপনার অপরিণামী অব্যয় অক্ষয় সুসূক্ষ্ম ব্রহ্মরূপ ভাবনায় মগ্ন হইয়া প্রাপ্ত হয় সাধনসুলভ আলোক, ঐ আলোকে দিব্যদেহ এবং দিব্যদেহ লইয়া আনন্দে যাপন করেন ভূতলে আনন্দপূর্ণ নিরাময় দিব্যজীবন। উভয় জগতে উভয় আকাশের তলে উক্ত ক্ষর ও অক্ষর পুরুষ স্বকীয় কর্ম্মগুণে নিত্য দীপ্যমান। ইঁহারাই শবযুগল। ঋষিশিল্পে এই শবযুগল মায়ের কর্ণদুল।
জগৎ দ্বিবিধ-স্থূল ও সূক্ষ্ম। উভয় জগৎ রচিত হইয়াছে আকাশে। আকাশ শব্দ, গুণ, সমস্ত নাম ও রূপের নির্ব্বাহক। স্থূল শব্দ স্থূলজগতে হয় মহাকাশে এবং সূক্ষ্ম শব্দ সূক্ষ্মজগতে হয় অন্তরাকাশে। কর্ণ সর্ব্ব শব্দের এক আয়তন। শ্রবণশক্তি স্থূল ও সূক্ষ্ম ভেদে উক্ত দ্বিবিধ শক্তিরই অনুগ্রাহক। শ্রবণশক্তির দেবতা হইতেছেন দিক্। অন্তর ও বহিরাকাশ লইয়া অন্তর ও বর্হিমুখী এই দিক্ দুইটি সৃষ্টিরূপিণী মায়ের শব্দায়তন কর্ণযুগলরূপে পরিকল্পিত। এই উভয়দিকে অবস্থিত ক্ষর ও অক্ষর পুরুষ ইঁহারা মায়ের কর্ণযুগলে শবযুগল-অবতংশরূপে কর্ণশোভা। যদিও ইঁহাদেরে স্বাধীওব্যবহারসম্পন্ন বলিয়া মনে হয়, তত্ত্বতঃ ইঁহারা স্বাধীন নহেন। ইঁহারা পরাধীন, ঋষিদৃষ্টিতে শব-নিষ্ক্রিয় জড় মাত্র। মা সর্ব্বাত্মশক্তি সর্ব্বজীবের জীবনরূপিনী। বিশ্ব-জননীর প্রাণশক্তিতে জীব প্রাণময়, কর্ম্মশক্তিতে কর্ম্মময় এবং জ্ঞান শক্তিতে জ্ঞানময়।