গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
আসলে কেই বা এই গঙ্গাধর! কি এমন কীর্তি যা বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষের আয়ুর্বেদ ইতিহাসে আজও এক অন্যতম ব্যক্তিত্ব!
১২০৫ বঙ্গাব্দের ২৪ শে আষাঢ় যশোর জেলার মাগুরা গ্রামে এক বৈদ্যবংশে গঙ্গাধর রায়ের জন্ম। পিতা ভবানীপ্রসাদ রায় ছিলেন নাটোর রাজবাড়ী প্রধান আয়ুর্বেদ চিকিৎসক। বাল্যকালে যশোরে রামরতন চূড়ামনির কাছে অভিধান, কাব্য, অলঙ্কার অধ্যয়ন করেন এবং পরবর্তীতে রাজশাহীর সুপ্রসিদ্ধ কবিরাজ রমাকান্ত সেনের কাছে আয়ুর্বেদ অধ্যয়ন করেন। প্রথমে চিকিৎসাব্যবসা কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটে শুরু করলেও ক্রমাগত স্বাস্থ্যভগ্ন হওয়ার পাকাপাকি ভাবে সৈদাবাদে এসে পড়েন।
বহরমপুর শহরের উত্তরে মহারাজা মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী শহর গ্রন্থাগারের দিকে যেতে ডানদিকে রয়েছে ‘গঙ্গাধর কবিরাজ লেন’ যা এই আয়ুর্বেদ চিকিৎসকের কৃতিত্বের প্রতীক।
বিবিধ ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায় তৎকালের এই রাজবৈদ্য ছিলেন নাড়ি পরীক্ষায় বিশেষ দক্ষতার অধিকারী। তার চিকিৎসা নৈপুণ্য, বিশেষত পাচন চিকিৎসা, সহজ মুষ্টিযোগ দ্বারা কঠিন থেকে কঠিনতর রোগ নিরাময় তাকে খ্যাতির চূড়ায় উপনীত করেছিল। মহারানী স্বর্ণময়ীর রোগারোগ্য থেকে নবাব বাহাদুরের চিকিৎসায় গঙ্গাধর রায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
চিকিৎসার পাশাপাশি তিনি যে ঐতিহাসিক কাজটি করে গেছেন তা হলো, প্রায় দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে লক্ষাধিক সংস্কৃত শ্লোকে চরক সংহিতার উপর প্রায় পাঁচহাজার পাতার "জল্পকল্পতরু" নামে টীকা রচনা করেন যা এযাবৎ আধুনিক ও নির্ভুল টীকা হিসেবে ধরা হয়।যা তার জীবনের অমর সৃষ্টি। এই সৃষ্টি তাকে আয়ুর্বেদ ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করে গেছে। আনন্দ ও গর্বের বিষয় এই সুবৃহৎ বইটি তার পুত্র ধরণিধর রায় কবিরাজ সম্বৎ ১৯৩৫ সৈদাবাদে ছেপে বের করেন। তারপর তা দেশ দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও দুষ্প্রাপ্য ‘গঙ্গাধর মনীষা’ নামে বহরমপুর থেকে প্রকাশিত একটি মাসিকপত্রের উল্লেখও পাওয়া যায়। অন্যদিকে কবিরাজ গঙ্গাধর রায় সর্ব মোট প্রায় একশোর বেশি বই বিভিন্ন বিষয়ের উপর রচনা করে গেছেন যা আয়ুর্বেদ চিকিৎসাবিজ্ঞানের অমূল্য সম্পদ। চিকিৎসার পাশাপাশি বহরমপুরের শহরেই তিনি ‘গঙ্গাধর নিকেতন’ নামে একটি টোলের প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে বৃহৎসংখ্যক আয়ুর্বেদ বিদ্যার্থী বিনামূল্যে শিক্ষালাভ করতো ও হাতে কলমে ওষুধ নির্মাণ ও চিকিৎসার পাঠ নিয়ে পূর্ণাঙ্গরূপে বিদ্যালাভের পর সারা বাংলাজুড়ে ছড়িয়ে আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় নিযুক্ত হতেন।
এই "গঙ্গাধর নিকেতন" টোলটি বর্তমানে নবরূপে সৈদাবাদ আয়ুশ সুস্বাস্থ্য কেন্দ্র রূপে রয়েছে যেখানে আজও আয়ুর্বেদ চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা ও আয়ুর্বেদ ওষুধ বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। কিন্ত দুঃখের বিষয় এই নবরূপে সজ্জিত আয়ুশ সুস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বোর্ডে বা কোথাও গঙ্গাধর রায়ের নাম উল্লেখ নেই যা অনভিপ্রেত।
শেষজীবনে গঙ্গাধর রায় তার টোলের শিষ্যদের সঙ্গে গঙ্গাধর নিকেতনে বই লেখার কাজ চালিয়ে যেতেন বলে জানা যায় এবং স্বেচ্ছায় অন্তর্জলি যাত্রা চেয়েছিলেন অর্থাৎ সেই সময় মুমূর্ষু রোগীর পারলৌকিক মঙ্গলের জন্য নিম্নাঙ্গ গঙ্গাজলে নিমজ্জিত করার বিশেষ বিধি প্রচলিত ছিল। সেইমতো সৈদাবাদের গঙ্গাতীরস্থ আটচালার তাকে রাখা হয়েছিল। লোকারণ্য ভিড়ে ১২৯২ সালের ১২ জ্যেষ্ঠ প্রাণ প্রয়াণের অত্যল্পপূর্বে "আমার চরক..." এই শেষ কথা বলে এই মহামানব দেহ রাখেন। সামগ্রিকভাবে এই সৈদাবাদ ইতিহাস, আধ্যাত্মিকতা এবং আয়ুর্বেদের একটি অনন্য কীর্তির পুণ্যভূমি।