প্রকৃতির মাঝে, পাহাড়ের কোলে
কোভিড নাইন্টিন বিনোদনপ্রিয় বাঙালির দিনগুলোকেই আলুনি করে দিয়েছে। সিনেমা হল বন্ধ। করোনার জন্য ঘোরার প্ল্যানও বিশ বাঁও জলে। বদলে মাস্ক, স্যানিটাইজার, কন্টেইনমেন্ট জোন, হটস্পট শব্দগুলো সারাক্ষণ কান পচিয়ে দিল। লাগাতার পাঁচমাস ঘরে আর কাহাতক বসে থাকা যায়। নিয়মবিধির মধ্যে থেকে অনেকেই চাইছেন ছোট্ট ট্যুরে যদি কয়েকটা দিন প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে আসা যায়। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এমনই কয়েকটি হটস্পটের সন্ধান দিচ্ছেন বাপ্পাদিত্য রায়চৌধুরী।
লাটপাঞ্চার
এ এক অন্য দার্জিলিং। এখানে পাখিরা শাসন করে প্রকৃতি। আবার পাখিদেরও প্রশ্রয় দেয় প্রকৃতি। পাহাড়ের কোলে লেপ্টে থাকা এমনই স্নিগ্ধতার নাম লাটপাঞ্চার। এ এমন এক গ্রাম, যেখানে শাল, সেগুন আর পাইনে মাখামাখি। আর আছে রাশি রাশি সিঙ্কোনা। যাঁরা পাখি ভালোবাসেন, তাঁরা অনেকেই এসেছেন এখানে। আর যাঁরা আসেননি, তাঁদের জন্য দুয়ার খুলে রেখেছে লাটপাঞ্চার। এই অরণ্যে অন্তত ২৪০ রকমের পাখি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে নামডাক যে পাখির, তা হল রুফস নেকড হর্নবিল। রুফস কথার অর্থ খয়েরি ও লাল রঙের মিশ্রণ। এই হর্নবিল এখন বিলুপ্তপ্রায়। এখানে যাঁরা ভিড় জমান, তাঁদের নজর থাকে এই পাখিটির দিকেই। মহানন্দা অভয়ারণ্যের কোল ঘেঁষে এই গ্রাম। কাছাকাছি আছে একটি মাটির গুম্ফা, যা প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো। আর আছে নামথিং পোখরি। নিস্তব্ধ এক গা ছমছমে হ্রদ। আসলে, এখানে আছে অনেক কিছু, যা না এলে স্পর্শ করা যায় না। আসাটাও খুব সহজ। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে মাত্র ৪১ কিলোমিটার। বিমানে এলে, বাগডোগরা থেকে ৪৯ কিলোমিটার। লাটপাঞ্চারে থাকার জন্য আছে হোম স্টে। তার মধ্যে অন্যতম অহল হোম স্টে।
মংপু
জীবনসায়াহ্নে এসে বেশ কিছুদিন শৈলশহর মংপুতে কাটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে তিনি তিনবার এখানে এসেছিলেন মনমোহন সেন এবং মৈত্রেয়ী দেবীর অতিথি হয়ে। স্বয়ং কবিগুরু যেখানে শান্তির আশ্রয় পেতেন, সেই স্থান কি সুন্দর না হয়ে পারে? মূলত সিঙ্কোনা চাষ হয় এখানে। তবু এই মংপু নানারকমের অর্কিডের স্বর্গরাজ্য। এখান থেকে ১২ কিলোমিটার উজিয়ে ১০ নম্বর জাতীয় সড়কে পড়লেই, সেই রাস্তা ধরে সোজা সিকিমে পৌঁছনো যায়। আর ৩২ কিলোমিটার দূরে দার্জিলিংয়ের হাতছানি তো আছেই। এনজেপি থেকে ৫৪ কিলোমিটার দূরে এই মংপু। এখানে এলে যেমন সিঙ্কোনা কারখানা দেখা যায়, তেমনই আছে অর্কিড পার্ক ও সাহেবদের আমলের বাংলো। সব মিলিয়ে অল্প সময়ের জন্য ছুটি কাটানোর পক্ষে আদর্শ জায়গা মংপু। এখানকার সরিতা কুঞ্জ হোম স্টেতে থাকতে পারেন অতিথিরা।
রঙ্গারুন
সুদূর লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেস যে চায়ের তারিফ করে এসেছে যুগ যুগ ধরে, সেই ঐতিহ্যের দার্জিলিং চায়ের অন্যতম ঘাঁটি রঙ্গারুন। এখন থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে এমনভাবে দেখা যায়, যেন পাশের বাড়ির জানলা। প্রাচীনতম চা বাগানগুলির অন্যতম এখানকার চা বাগান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাত হাজার ফুট উপরে থাকা শহরের অন্যতম আকর্ষণ ঘুম স্টেশন। বিশ্বের উচ্চতম রেল স্টেশন। এখান থেকে দার্জিলিং শহর খুবই কাছে। টাইগার হিলও নাগালেই। রঙ্গারুণে সূর্যোদয় দেখাও এক মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা। খালিং কটেজে থেকে অবসর কাটানোর জন্য বারবার ফিরে আসতে হয় এই পাহাড়ি এলাকায়।
সিটং
সিটং এমন এক উপত্যকা, যেখানে বারবার আসা যায় শুধু কমলালেবুর টানে। সিটং আসলে লেপচাদের আপন দেশ, যেখানে দূষণ বলে কোনও শব্দ নেই। এখানে গাছ উজাড় করে ফলে কমলালেবু। আমরা সমতলে যে দার্জিলিংয়ের কমলালেবুর জন্য হাপিত্যেশ করি গোটা শীতকাল, তার আঁতুড়ঘর এই সিটং। আর আছে নানা অর্গানিক চাষাবাদ। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ৪ হাজার ৮০০ ফুট উঁচুতে রিয়াং নদীর ধারে এ এমন এক গ্রাম, যেখানে ইচ্ছে হলেই নেমে আসে তুরতুরে মেঘ। আছে লেপচাদের প্রাচীন চার্চ। আছে ঝরনা। যখন তখন উঁকি দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘা। এখান থেকে যাঁরা কাছাকাছি ঘুরে আসতে চান, তাঁদের জন্য নাগালে আছে সেঞ্চল আর মহানন্দা অভয়ারণ্য। আর আছে দিগন্ত বিস্তৃত চা বাগান। মংপুতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মিউজিয়াম এখান থেকে মাত্র আট কিলোমিটার। যাঁরা দিনের আলোয় এক চক্কর দার্জিলিং শহর ঘুরে আসতে চান, তাঁদের মাত্র ৩২ কিলোমিটার এগলেই হবে। যাওয়া যায় কালিম্পংও। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে এই সিটং গ্রামের দূরত্ব মাত্র ৬১ কিলোমিটার। বাগডোগরা থেকে ৬৯ কিলোমিটার। এখানে থাকার জন্য আছে বেশ কয়েকটি হোম স্টে। তার মধ্যে অন্যতম হ্যাংখিম, ছালাম কিয়ং, সিটং, পূজন, মুখিয়া, রিভার ক্র্যাব প্রভৃতি হোম স্টে।
তুকদা
এক সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর উপনিবেশ ছিল শৈলশহর তুকদা। এখনও যেন সেই ইতিহাস জীবন্ত। এই ক্যান্টনমেন্টে এখনও পরাধীন দেশের গন্ধ পাওয়া যায় যেন। ৩৬টি বাংলো আছে এখানে, যা শতাব্দী প্রাচীন। আর আছে অর্কিড বাগান। উত্তরবঙ্গে যত রকমের অর্কিড পাওয়া যায়, তার প্রায় সবক’টি প্রজাতি আছে এই বাগানে। শিলিগুড়ি শহর থেকে ৮৬ কিলোমিটার দূরে এই সুপ্রাচীন শহর। এখানে থাকার জন্য সাইহৃদয়ম হোম স্টে অন্যতম।
করোনা সংক্রমণের মধ্যে দূরে বেড়াতে যেতে চান না অনেকেই। তাঁদের জন্য নাগালের মধ্যে বেড়ানোর জায়গাগুলিকে নতুন করে চেনাচ্ছে ইন্ডিয়া ট্যুরিজম। কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রকের রিজিওনাল ডিরেক্টর (ইস্ট) সাগ্নিক চৌধুরীর কথায়, যাঁরা বাড়িতে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছেন, আমরা চাই এবার তাঁরা সাহস করে বেরিয়ে পড়ুন। সেক্ষেত্রে পর্যটক ও অতিথি নিবাসগুলিতে যে যে নিয়ম মানতে হবে, তা দেওয়া আছে tourism.gov.in-এ। এছাড়া ইন্ডিয়া ট্যুরিজম কলকাতার ফেসবুক পেজ, ইনস্টাগ্রাম এবং ইউটিউব চ্যানেলেও নজর রাখা যায়। সেখানেও রয়েছে বেড়াতে যাওয়ার অজস্র বর্ণনা। যাঁদের পায়ের তলায় সরষে, তাঁদের মন ভরানোর বার্তা দিতে তৈরি আমরাও।
06th September, 2020