বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
নারী স্বাধীনতা একটা মনোভাব। আর সেই মনোভাবটা যে পুরোপুরি নারীর স্বনির্ভরতা থেকেই আসে তা কিন্তু নয়। নারী স্বাধীনতা আসলে একটা মানসিকতা। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যে আমরা বহু আগে থেকেই এই মনোভাবের পরিচয় পাই। কিন্তু এই মনোভাবের পাশাপাশি নারীর যে উত্তরণ সেটা ক্রমশ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর পত্রে মৃণালকে স্বাধীনচেতা করে তুললেও তাকে স্বনির্ভর করতে পারেননি। কেন? না সমাজ তখনও নারীকে স্বনির্ভর বা চাকরিরতা হিসেবে দেখতে প্রস্তুত ছিল না। মৃণাল কাঁধে ব্যাগ নিয়ে অফিস পাড়ায় চাকরি করতে যেতে পারেনি। তাই বলে তার মনে কোনও পরাধীনতার ছাপ ছিল না। আর ছিল না বলেই সে তথাকথিত পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পেরেছে। পুরুষতন্ত্রের অধীনে নারীর অবস্থানকে ভবিতব্য বলে মেনে নেয়নি। পরবর্তীতে কিন্তু নারীর স্বনির্ভরতা স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে ওঠে যখন নরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর অবতরনিকা গল্পে আরতিকে সংসারে স্বাচ্ছল্য আনতে চাকরি করতে পাঠান বা সন্তোষকুমার ঘোষ তাঁর সুধার শহর উপন্যাসে সুধাকে স্বনির্ভর করে তোলেন। নারীর এই পরনির্ভরতা থেকে স্বনির্ভরতায় উত্তরণটা সমাজেও হয়েছিল বলেই সাহিত্যে তার প্রতিফলন দেখতে পাই। পাশ্চাত্যে এই উত্তরণ আরও আগে এসেছে। উনবিংশ শতকেই ইবসেন তাঁর ডলস হাউস নাটকে নোরার চরিত্রে অনায়াস স্বনির্ভরতা নিয়ে এসেছেন যেখানে সে নিজের ইচ্ছায় কাজ করতে চায়। আর পাঁচজন সাধারণ নারীর মতো পুরুষের ইচ্ছায় কাজ করতে সে অক্ষম। তাই সে চাকরিরত না হয়েও অনায়সে স্বামীর সংসারের স্বাচ্ছল্য ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারে। কেন না, এমন স্বাচ্ছল্যে তার কাছে অপ্রয়োজনীয় যেখানে তার মতামতের কোনও দাম নেই। ইবসেন যখন ডলস হাউস নাটকটি লিখেছিলেন তখন পশ্চিমেও কিন্তু নারী স্বধীনতা একটা অভূতপূর্ব ভাবনা। যে কারণে নোরার সেই স্বাধীনতার দাবিতে অবাক হয় নোরার স্বামী স্বয়ং। ক্রমশ সমাজ যত পরিবর্তিত হয়েছে ততই নারী স্বাধীনতা অন্য পর্যায় পৌঁছেছে। তাই তো বিশ শতকে যখন ভারজিনিয়া উল্ফ তাঁর ‘রুম অব ওয়ানস ওন’ বইতে নারী স্বাধীনতার কথা বলেছেন, তখন সেই স্বাধীনতা অনায়াসেই আর্থিক ও মানসিক পর্যায় পৌঁছেছে। তাতে সমাজের কোনও হস্তক্ষেপ বা কটাক্ষ চোখে পড়ে না। তবু এখনও নারীর স্বনির্ভরতাকেই তার স্বাধীনতার সঙ্গে এক করে দেখা হয় আমাদের সমাজে।
এই স্বনির্ভতা আসলে নারী স্বাধীনতার একটা টুকরো মাত্র। উনবিংশ, বিংশ পেরিয়ে এই একবিংশ শতকে এসেও নারী সঠিক অর্থে স্বাধীন হয়ে ওঠেনি। তবে নারীর পথচলার পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে ধীরে হলেও নারী মনে একটা বদল ঘটছে। এখনও হয়তো অনেকাংশেই স্বনির্ভরতা সত্ত্বেও নারী পথচলায় পুরুষের সঙ্গ চায় সারাক্ষণ। বিয়ের পর অন্যায়ের শিকার হলেও সহজে মুখ খোলে না। একটা অজানা ভয় তার মনে মনে কাজ করে। ডিভোর্স হলে (সে যে কারণেই হোক না কেন) সমাজে তার অবস্থান পরিবর্তিত হয়ে যাবে। বাপের বাড়িতে হেনস্তা হতে হবে... এমন কত যে অজানা শঙ্কা নারীর মনে তা বলে শেষ করা যাবে না। তবু সমাজের এক শতাংশ মহিলার চিন্তাধারায় একটা বদল লক্ষ করা যায়।
মহিলাকেন্দ্রিক বিভিন্ন এন জি ও-র সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে গিয়ে বারবারই দেখেছি মেয়েরা শুধু শ্বশুরবাড়িতেই নয়, বাপেরবাড়িতে, কর্মক্ষেত্রে, রাস্তাঘাটে নির্যাতনের শিকার হয়, সহ্য করে, প্রতিবাদ করে না। এই ভয়টা আসলে মানসিক একটা ব্লক। এমন একটা চিন্তা যেখানে পুরুষ ব্যতীত নারীর অস্তিত্ব সংকটে। সে নারী চাকরিরতা হলেও সংকটে। আর না হলে তো কথাই নেই। এমনই একটি নারীকেন্দ্রিক এন জি ও মারফতই ঘটনাটার সাক্ষী হলাম। ধরা যাক মেয়েটির নাম অনন্যা। গ্রামের একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। শাশুড়ির গঞ্জনা সহ্য করে, কেন না ‘মেয়েছেলের অত বিদ্যার ভড়ং কীসের?’ স্বামীও মায়ের সঙ্গে গলা মেলায়, তবে সর্বসমক্ষে নয়। আড়ালে স্ত্রীকে সে বলে, ‘কী আশ্চর্য? তুমি না মাস্টারনি অথচ এই সহজ ব্যাপারটা বুঝতে এত সময় লাগছে।’ অথবা ‘এটুকুও জান না! তা ইস্কুলে বাচ্চাগুলোকে কী শেখাও?’ অথচ অনন্যা কোনও প্রতিবাদ করে না। তাকে সাহায্য করতে চাইলে সেই সাহায্য নিতেও সে নারাজ। কেন? না, ‘একটু কটু কথাই তো বলে, গায়ে তো আর হাত তোলে না।’ অর্থাৎ নারী মনে ধারণাটা বদ্ধমূল যে নির্যাতনটা শারীরিক ও মাত্রাছাড়া হলে তবেই সেটা নির্যাতন আর মানসিক হলে নির্যাতনের পর্যায়ে তাকে ফেলা যাবে না। এমন ধারণা নিয়ে মেয়েরা, এমনকী রোজগেরে মেয়েরাও গোটা বিশ শতক জুড়েই পথ চলেছে। আসলে সমাজ মেয়েদের একা পথ চলতে দেখতে অভ্যস্ত ছিল না। ব্যতিক্রম যে হয়নি তা নয়। তবু একা মানেই বোকা এই ধারণাটা মেয়েদের মনে বদ্ধমূল হয়ে বসেছিল একটা গোটা শতক জুড়ে। আশার কথা এই যে পরিবর্তন আসছে। গত বছর নারী নির্যাতন পক্ষে বিভিন্ন এন জি ও-র সঙ্গে কথা বলে মনে হল মেয়েরা একা পথ চলতে মানসিকভাবে প্রস্তুত। অত্যাচারের ধরনটা তাই শারীরিক পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই তারা প্রতিবাদে মুখর হচ্ছে। আর নারী স্বাধীনতা যে একটা বোধ এই ধরনাটাও মেয়েদের মনে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
তাই তো পিংকের মতো প্রতিবাদী ছবির পাশাপাশি কুইনের মতো ছবিও আমরা উৎসাহের সঙ্গে দেখছি। যেখানে নায়কের দ্বারা প্রত্যাক্ষাত হওয়ার পর নায়িকা দমে যাচ্ছে না, মুশরেও পড়ছে না। আবার বিরাট প্রতিবাদও করছে না। বরং একাকী জীবনের নতুন দিশা খুঁজে নিচ্ছে নির্ভয়ে। আর তাকে সেই দিশা খোঁজার পথে ঠেলে দিয়েছে বলে সে নায়কের সঙ্গে দেখা করতে আসছে শুধু একটাই কথা বলার জন্য ‘থ্যাংক ইউ।’ আশা করব নারীর মানসিক উন্নয়ন ক্রমশ বাড়বে। ‘মেয়েমানুষের’ খোলস ছেড়ে আমরা মেয়েরা ক্রমশ ‘মানুষ’ হয়ে উঠব।