কর্মপ্রার্থীদের কর্মলাভ কিছু বিলম্ব হবে। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য লাভ ঘটবে। বিবাহযোগ আছে। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় থেকে ... বিশদ
প্রবাদপ্রতিম শ্রী শম্ভু মিত্রের সাথে আমার প্রথম দেখা নান্দীকারে। নান্দীকার তখন মুদ্রারাক্ষস নাটক মঞ্চস্থ করতে চলেছে। চাণক্য চরিত্রে অভিনয় করতে আসবেন স্বয়ং শম্ভু মিত্র। আমাদের মধ্যে তখন প্রবল উত্তেজনা তাঁর সঙ্গে অভিনয় করার সুযোগ পাবো বলে। মুদ্রারাক্ষস নাটকে আমার আবার একটা বাড়তি দায়িত্ব ছিলো; আমি ছিলাম নাটকের প্রযোজনা নিয়ন্ত্রক। শম্ভুদাকে তাঁর পার্ক সার্কাসের বাড়ি থেকে নিয়ে আসতো দীপঙ্কর। ফেরার সময় শম্ভুদা বলতেন, তোমাদের তো এখনও রিহার্সাল হবে। আমাকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দাও, আমি চলে যাবো। আমরা ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে আসতাম। আর ট্যাক্সিতে ওঠার সময় ওনার হাতে পঁচিশ টাকা দিয়ে দিতাম। উনি চলে যেতেন। তারপরে আবার তিন- চার দিন পরে হয়তো মহলা। উনি দীপঙ্করের সঙ্গে আসতেন। আর এসে ট্যাক্সি থেকে নেমেই আমার হাতে একটা কাগজের মোড়ক দিতেন। আর আমি সেটা খুলে দেখতাম যে তাতে লেখা আছে – ‘আমার ঐদিন ট্যাক্সি ভাড়া লেগেছিলো ২২টাকা ৭৫ পয়সা, বাকি ২টাকা ২৫ পয়সা ফেরত।’ আমি অবাক হয়ে যেতাম— শম্ভু মিত্রকে গাড়িভাড়া বাবদ যে টাকা দিয়েছি তার হিসাব!! পরে বুঝেছি দলের প্রতিটি পাই-পয়সার হিসাব এভাবেই রাখতে হয়।
আস্তে আস্তে শম্ভুদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে থাকলাম। উনিও আমাকে খুব স্নেহ করতেন।
আর এক দিন। মুদ্রারাক্ষসের স্টেজ রিহার্সাল চলছে, অ্যাকাডেমিতে। আলো করছেন কণিস্ক সেন। চাণক্য-বেশী শম্ভুদার দৃশ্যের মহলা চলছে। হঠাত শম্ভুদা মহলা থামাতে বললেন রুদ্রদাকে। বললেন, ‘আচ্ছা কোথা থেকে একটা লাল আলো আসছে কেন? এখানে তো কোনও কালার থাকার কথা নয়!’ রুদ্রদা কনিস্কদাকে বললেন, কোথা থেকে লাল আলো দিচ্ছ? কনিস্কদা বললেন, না, কোনও লাল রঙ তো দেওয়া নেই! কিন্তু শম্ভুদা তখনও বলছেন যে উনি লাল আলো পাচ্ছেন। তারপর সমস্ত আলোর সোর্স পরীক্ষা করা হল। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে দেখা গেল, একটা স্পট-এ এক টুকরো লাল ফিলামেন্ট লেগে আছে। হয়তো আগের কোনও নাটকে ব্যবহার হয়েছিল, খুলতে গিয়ে এক টুকরো আটকে আছে। এই হচ্ছেন শম্ভু মিত্র। আমাদের এতগুলো চোখ যা দেখতে পেল না, তিনি কিন্তু পেলেন। অথচ সবাই বলতেন যে উনি চোখে ভালো দেখতে পান না। আমরা আমাদের ভালো চোখ নিয়ে যা দেখতে পেলাম না, উনি তা পেলেন। তাহলে কার চোখ খারাপ ?
একদিন কেয়াদির মা বললেন, আমি শম্ভু মিত্রের জন্য রান্না করে দেব, তুমি একটু দিয়ে আসবে? আমি সানন্দে রাজী হয়ে গেলাম। যথারীতি আমি টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে শম্ভুদার বাড়ি হাজির হলাম। উনি আমায় বললেন, তুমি একটু অপেক্ষা করো। তারপর পাশের ঘরে গিয়ে খাওয়া শেষ করে, পুরো টিফিন ক্যারিয়ারটা ধুয়ে আমায় দিলেন, এবং সঙ্গে কেয়াদির মা’কে লেখা একটা চিঠি দিলেন। তাতে উনি কত তৃপ্তি করে যে খেয়েছেন, সেটা উল্লেখ করেছিলেন।
তখন প্রায়ই আমি শম্ভুদার বাড়ি যেতাম। একদিন ওনাকে বললাম, এই সময়ের অনেকেই আপনার ‘রাজা অয়দিপাউস’ দেখে নি। যদি আপনি আবার করেন তাহলে তারা দেখতে পায়। এটা কিন্তু সকলেরই খুব ইচ্ছে। উনি খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, হ্যাঁ, জানো তো আমারও খুব ইচ্ছে ছিলো রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে ওনার কথা শুনবো; কিন্তু আমার সে ইচ্ছে পুরণ সম্ভব হয়নি, কী আর করা যাবে! সবাইকার সব ইচ্ছে পুরণ না হওয়াই ভালো।
১৯৮৮ সালে আমি নান্দীকার থেকে বেরিয়ে যুক্ত হই নান্দীপট নাটকের দলে। তখন মাঝে মাঝেই শম্ভুদার গোলপার্কের ফ্ল্যাটে যেতাম, ওনার কথা শুনতে। আমরা, শম্ভুদাকে একবার রবীন্দ্রসদনে আমাদের ‘শ্বেতসন্ত্রাস’ নাটক দেখাতে নিয়ে আসি। নাটকের নির্দেশক ছিলেন বিভাস চক্রবর্তী। শম্ভুদার খুব ভালো লেগেছিলো আমাদের নাটক, আর তার পর থেকে আমাদের প্রতি তাঁর স্নেহও আরও বেড়ে গেল। একদিন নানা কথা বলতে বলতে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, তোমরা যে নান্দীকার থেকে বেরিয়ে এলে, নিশ্চয়ই সেখানে এমন কিছু হচ্ছিল যা তোমাদের পছন্দ হচ্ছিল না, অথবা তোমরা এমন কিছু করতে চাইছিলে যা ওখানে করতে পারছিলে না? এখন তোমরা তোমাদের দলে কি সেটা করতে পারছ? সত্যি কথা বলতে কি নান্দীকার থেকে চলে আসার সময়, আমরা সবাই যে একই কারণে এসেছিলাম, তা তো নয়; আর এইভাবে কোনও দিন ভেবেও দেখিনি। আমাদের সবাইকে যেন উলঙ্গ করে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। এইভাবে তিনি আমাদের একটু একটু করে জীবনবোধ শেখাতেন।
১৯৯২ সালে আমরা ঠিক করলাম নাট্যোৎসব করব। দুই বাংলার নাটক, চলচিত্র, সঙ্গীত সবকিছু নিয়ে বিশাল হবে এই উৎসব। বিভাসদা ( চক্রবর্তী) বললেন, তোমার এই উৎসবের নাম দাও ‘পদ্মা গঙ্গা উৎসব’। ভাবনা তো হল, কিন্তু সেই ভাবনা রূপ পাবে কী করে? আমরা ঠিক করলাম এই উৎসব উদ্বোধন করবেন শম্ভুদা। থিয়েটারের সিনিয়ররা আমাদের সাবধান করলেন যে, এটা ওনাকে বলতে যাওয়াটা খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে! কিন্তু আমাদের খুব ইচ্ছে উনিই উদ্বোধন করুন। তা একদিন ভরসা করে গেলাম ওনার গোল পার্কের ফ্ল্যাটে। নানা কথার পরে আমাদের অনুরোধটা রাখলাম এবং উনি প্রথমেই ‘না’ বলে দিলেন। কিন্তু আমরাও ছাড়ার পাত্র নই, লেগে রইলাম। অবশেষে উনি বললেন, ঠিক আছে তোমরা দিন পনেরো বাদে এস, আমি একটু ভেবে দেখি। খুবই হতাশ হয়ে পড়লাম। আমি বললাম, আপনি ছাড়া আর কাউকেই আমরা এই উৎসবের উদ্বোধক হিসাবে ভাবতে পারছি না। আর সবচেয়ে বড় কথা আপনি রাজী হলে তবেই VST-ও আমাদের স্পন্সর করতে রাজি আছে, নাহলে নয়। উনি হেসে বললেন, ‘আমি কি অমিতাভ বচ্চন, যে আমার জন্য স্পন্সররা অপেক্ষা করে থাকবে?’ আমি বলে বসলাম, আপনি তো আমাদের থিয়েটারের অমিতাভ বচ্চন। উনি হেসে উঠে বললেন –‘যাও ; ঠিক আছে আমি রাজী। কিন্তু পনেরো দিন বাদে একবার এস। ‘পনেরো দিন বাদে আবার আমরা গেলাম। উনি জানতে চাইলেন, ‘আমাকে কী করতে হবে? প্রদীপ জ্বালাতে হবে না ফিতে কাটতে হবে?’ আমি বললাম, আপনাকে প্রদীপ জ্বালিয়ে উদ্বোধন করতে হবে। উনি বললেন, ‘বেশ, প্রদীপ জ্বালিয়ে বলব যে পদ্মা-গঙ্গা উৎসবের শুভসূচনা ঘোষণা হলো— এই তো?’ আমরা বললাম, না, সঙ্গে আরও কিছু বলবেন, সকলে আপনার কথা শুনতে চাইবে। উনি বললেন, ‘দ্যাখো, এই যে আমরা থিয়েটার করি, মাসের পর মাস রিহার্সাল দিচ্ছি, শ্রম দিচ্ছি, এতজন মানুষ নিয়ে। আর অভিনয়ের পরে, হল-মালিক টাকা পাচ্ছেন, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিচ্ছি, খবরের কাগজের মালিক টাকা পাচ্ছেন; যে সেট তৈরি করছে সে টাকা পাচ্ছে, যে আলো করছে বা আবহ প্রক্ষেপণ করছে সব্বাই টাকা পাচ্ছে। এমন কি যে ঠেলাওয়ালা সেট বয়ে নিয়ে আসছে সেও টাকা পাচ্ছে। আর আমরা, মানে অভিনেতারা কী পাচ্ছি? কিছুই না! আসলে আমরা ভাগচাষির দল। আমরা সবই করি কিন্তু আমাদের কিছুই জোটে না।’ আমরা বললাম, আপনি আপনার এই উপলব্ধির কথাই বলবেন। উনি হেসে বললেন, ‘ধুর্... এসব কথা তোমাদের বলা যায়, অন্যরা আর কে শুনবে?’ তবে উদ্বোধনের দিন কিন্তু উনি এই কষ্টের কথাগুলোই বললেন। আর শুধু উদ্বোধনই যে করলেন তা নয়, সাথে সাথে আমাদের ‘নান্দীপট’কেও একটা শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করালেন। কারণ সেই সময় VST আমাদের ওই উৎসবের জন্য যত টাকা স্পন্সর করেছিল, বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসের কোনও উৎসব, তখনও পর্যন্ত সেই পরিমাণ অনুদান পায়নি। আর সেটা সম্ভব হয়েছিল শম্ভু মিত্রের নামের জন্য।
উনি স্বপ্ন দেখতেন, নিজেদের একটা মঞ্চ হবে। তার জন্য তিনি বহু চেষ্টা করে গেছেন। উদয়শঙ্কর, রবিশঙ্কর, বিষ্ণু দে আর থিয়েটার দল হিসাবে বহুরূপী, নান্দীকার, রূপকার, অনামিকা— এদের নিয়ে ‘নাটমঞ্চ সমিতি’ গঠন করেছিলেন। নাটক করে, সঙ্গীতানুষ্ঠান করে, বিভিন্ন ভাবে টাকা তুলেছিলেন, যাতে একখণ্ড জমি কিনে মঞ্চ তৈরি করা যায়। কিন্তু তার সে স্বপ্ন সফল হয়নি, সরকার তার হাতে জমি দেয়নি। কাজেই তাঁর আর নিজস্ব মঞ্চ পাওয়াও হয়নি। এর পরেও উনি চেষ্টা করেছিলেন আরও একবার। রুদ্রদা, বিভাসদা, অরুণদা, জোছনদা, মোহিতদা সবাই মিলে তৈরি করলেন ‘কলকাতা নাট্যকেন্দ্র’। তৈরি হল ‘গালিলেওর জীবন’ নাটক। তখন শম্ভুদার নামে দর্শকরা টিকিট কাটার জন্য রাত জেগে লাইন দিত। পাঁচটা শো-এর টিকিট কাউন্টার খোলার তিন ঘন্টার মধ্যে হাউসফুল হয়ে যেত। উনি বলেছিলেন, ‘এখন তো আমার অভিনয় দেখতে লোকে পয়সা দিচ্ছে। তোমরা আমায় ব্যবহার করে নাও। এইবেলায় একটা ফান্ড তৈরি করে একটা নিজেদের মঞ্চ তৈরি করে নাও।’ তাও হয়নি। খুব অভিমান হয়েছিল শম্ভুদার। কারণ, তাঁর স্বপ্নটা সেদিনের থিয়েটারের মানুষজন বুঝতে পারেনি। যদি বুঝতে পারত, তাহলে হয়তো আজ থিয়েটারের অন্য একটা চেহারা আমরা দেখতে পারতাম।