যাত্রার গব্বর সিং ছিলেন দিলীপ চট্টোপাধ্যায়
চলচ্চিত্রে ভিলেনের প্রসঙ্গ উঠলে যেমন ‘শোলে’র গব্বর সিংয়ের কথা আসবেই, তেমনই যাত্রায় ভিলেনের কথা আলোচনা হলে ভাবনা কাজির কথা আসবেই। তখনকার দিনে গ্রামবাংলার মায়েরা বাচ্চাদের ঘুম পাড়াত ভাবনা কাজির ভয় দেখিয়ে। ‘শিগগির ঘুমিয়ে পড় ওই ভাবনা কাজি আসছে।’ একেবারে ‘শোলে’র সংলাপের বাস্তব রূপ। কিন্তু ‘শোলে’র জন্মের অনেক আগে থেকেই গ্রামবাংলার মঞ্চ কাঁপিয়েছে ভাবনা কাজি। তার সংলাপ ‘গায়ের চামড়া খুলে নেব, ডালকুত্তা দিয়ে খাওয়াব’ শুনলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে উঠত। ভাবনা কাজি মানে বিশাল দশাশই চেহারা। মাথায় টাক। চোখে ক্রুর দৃষ্টি। ভয়ংকর অত্যাচারী এক মানুষ। নিষ্ঠুর ধরনের সংলাপ। হাতে তার সবসময় ধরা থাকে একটা চাবুক। তাই দিয়ে সে যাকে ইচ্ছে মারে। সবাই তার ভয়ে তটস্থ। এমনই এক চরিত্র ব্রজেন দে তৈরি করেছিলেন তাঁর ‘সোনাই দীঘি’ পালায়। সেই পালায় ভাবনা কাজির চরিত্রে অভিনয় করে অমর হয়ে আছেন দিলীপ চট্টোপাধ্যায়। দীর্ঘ প্রায় ২৭-২৮ বছর একই পালায় ভাবনা কাজির চরিত্রে তিনি অভিনয় করে গিয়েছেন। অথচ পালায় কিন্তু ভাবনা কাজিকে নাট্যকার এতটা প্রাধান্য দেননি। সেখানে প্রধান চরিত্র হিসাবে তিনি তৈরি করেছিলেন যাদব, মাধব, সোনাইকে।
সেই অপ্রধান চরিত্রকে অভিনয়ের গুণে প্রধান চরিত্র করে তুললেন দিলীপবাবু। কীভাবে সেই কাজ তিনি করেছিলেন, সেই কাহিনী বলেছিলেন দিলীপবাবুর সুযোগ্য অভিনেতা-পুত্র সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়। ‘১৯৫৯-এ সিজনের মাঝামাঝি সত্যম্বর অপেরায় নেমেছিল ‘সোনাই দীঘি’। সিজনের মাঝে সেভাবে রিহার্সালেরও সুযোগ ছিল না। দল যেখানে যেখানে ঘুরত, সকালবেলায় মুড়ি তেলেভাজা খেতে খেতে শিল্পীরা বসে বসে পার্ট বলতেন। যাকে বলা হতো মুখমিল করা। এভাবেই তখন তৈরি হয়েছে অনেক সুপারহিট পালা। সেভাবে নাট্য পরিচালক বলেও কিছু ছিল না। দলের ম্যানেজার এবং স্টার শিল্পী পার্ট বিলি করতেন এবং নিজেরাই ঠিক করে একটা নাটক দাঁড় করাতেন। সেই পালা প্রথম খুলল নাদনঘাটে।’
প্রথম বছরে সেই পালায় যাঁরা অভিনয় করেছিলেন, তাঁরা হলেন গুরুপদ ঘোষ (ভাটুক ঠাকুর), অমর বন্দ্যোপাধ্যায় (মাধব), মেন্টা বোস (যাদব), পান্না চক্রবর্তী (আজিম খাঁ, পরে তিনি যাদবও করেন), জ্যোৎস্না দত্ত (সোনাই), অঞ্জলি ভট্টাচার্য (মুক্তকেশী), মধু বড়াল বা মধুরানি (মল্লিকা), সত্য বাবাজি (নিশাচর) প্রমুখ। সেবার সত্যম্বরের দল পরিচালক ছিলেন হরিপদ বায়েন। পালা যখন ফেলা হল, তখন দিলীপবাবু ভেবেছিলেন তিনি দলের অন্যতম টপ শিল্পী। তিনি হয়তো যাদব চরিত্রটি পাবেন। কিন্তু তাঁকে দেওয়া হল ভাবনা কাজি চরিত্রটি। সে ব্যাপারে সন্দীপবাবু বলেছেন, ‘এই চরিত্রটা পেয়ে বাবা খুব একটা খুশি হতে পারেনি। কেন না চরিত্রটা অথর-ব্যাকিং ছিল না। কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ পার্ট পেয়েও বাবা দমে যায়নি। মনে মনে ঠিক করেছিল, এটাকেই এমন একটা রূপ দেবেন, যাতে সবাই ভাবনা কাজির নামই উচ্চারণ করে।’ ভাবনা কাজি চরিত্রটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবেই নিলেন দিলীপবাবু। সব সময় ভাবতেন কীভাবে চরিত্রটাকে তৈরি করা যায়। তার অ্যাপিয়ারেন্স, কথা বলা, হাঁটা, তাকানো সবকিছুর মধ্যে একটা নতুনত্ব আনতে চাইলেন। যাত্রার গতানুগতিক ভিলেনের বাইরে একটা চরিত্রসৃষ্টি। প্রতিনিয়ত মনের মধ্যে সেই চরিত্র নিয়ে ভাঙাগড়া চলতে লাগল। রিহার্সাল দেখে হরিপদ বায়েন এবং দলমালিক গৌরচন্দ্র দাস বলেছিলেন, ‘আপনার অভিনয় মানুষ নেবে না।’ দিলীপবাবু বলেছিলেন, ‘আমি যেমন ভেবেছি, সেভাবে করি। পালা নামুক। মানুষের পছন্দ না হলে আপনারা যেমনভাবে বলছেন, সেভাবেই করব।’ নাদনঘাটে পালা নামল। ভিড়ের মধ্যে মিশে থেকে গৌরবাবু মানুষের মন্তব্য শুনেছিলেন। পালা শেষ হওয়ার পর সকলের মুখে তখন একটাই নাম, ভাবনা কাজি। সাজঘরে এসে গৌরবাবু বলেছিলেন, ‘অপূর্ব হয়েছে। এমন অভিনয় মানুষ কোনওদিন ভুলবে না।’
সেই চরিত্রে দিলীপবাবু অভিনয় করেছিলেন ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত। তিনি যে দলে গিয়েছেন, সেই দলেই ‘সোনাই দীঘি’ পালার অভিনয় হতো। ভাবনা কাজি একই থাকতেন। বদলে যেত যাদব, মাধব, সোনাইয়ের অভিনেতা অভিনেত্রীরা। বর্ণালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম যাত্রায় আসা তরুণ অপেরায়। সেবার দিলীপবাবু সেই দলে। বর্ণালীও সোনাই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সেই স্মৃতি ফিরিয়ে এনে তিনি বললেন, ‘আমি তখন নতুন। ওনাকে সমীহ করতাম, শ্রদ্ধাও করতাম। আমরা মনপ্রাণ দিয়ে অভিনয় করতাম। কিন্তু ‘সোনাই দীঘি’ পালার সব হাততালি উনিই নিয়ে নিতেন।’
অথচ তাঁর যাত্রায় অভিনয় করার কোনও স্বপ্নই ছিল না। হুগলির চুঁচুড়ার চকবাজারের জমিদার বাড়ির ছেলে। যাত্রা দেখার শখ ছিল অবশ্য। পনেরো বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পর দিলীপবাবুর জগৎটা বদলে গেল। বাবার ছিল শেয়ার বাজারের কারবার। ধীরে ধীরে বিপরীতমুখী এক ঝোড়ো হাওয়ায় খসে পড়ল স্বাচ্ছন্দ্য। একে একে জমিদারির ঔজ্জ্বল্য নষ্ট হল। সংসারের প্রয়োজন মেটাতে তখন দরকার একটা চাকরি। জুটলো বটে, কিন্তু সেখানে থিতু হতে পারলেন না। বসের খারাপ ব্যবহার মেনে নিতে পারেননি। তাঁর নাকে এক ঘুষি মেরে সোজা দৌড়। আর কখনও চাকরিমুখো হননি। কিন্তু কিছু একটা করা দরকার। ১৯৫০ সালে তিনি যাত্রায় যোগ দিলেন। যোগ দিলেন নব রঞ্জন অপেরায়। সেবার পালা ছিল ‘ভক্ত ধ্রুব’ এবং ‘সতীর ঘাট’। এক বছর পর গেলেন সত্যম্বরে। সেখানে পেলেন যাত্রার এক দিকপাল শিল্পী গুরুপদ ঘোষকে। ‘পাষাণের মেয়ে’ পালায় গুরুপদ করতেন তারকাসুর এবং দিলীপবাবু ইন্দ্র। গুরুপদ ঘোষের অভিনয় থেকে অনেক কিছু শিখেছেন তিনি। ঘটনাক্রমে একদিন তাঁকেই তারকাসুরের অভিনয় করতে হল। সে এক কাহিনী। ম্যানেজারের উপর রাগ করে দল ছেড়ে চলে গেলেন দিলীপবাবু। তার কিছুদিন পর অসুস্থ হয়ে পড়লেন গুরুপদ ঘোষ। কে করবেন তারকাসুর! একদিন সত্যম্বরের মালিক গৌরবাবু তাঁর বাড়িতে হাজির। মান-অভিমানের শেষে আবার যাত্রায় ফিরে গেলেন। করলেন তারকাসুর। প্রচুর প্রশংসা পেলেন। সুযোগ পেয়ে প্রমাণ করলেন নিজেকে। এরপর পালা ‘রাজা লক্ষ্মণসেন’। গুরুপদ ঘোষ নামভূমিকায় এবং দিলীপবাবু অন্যতম প্রধান চরিত্র বখতিয়ার খিলজি।
১৯৬৪ সালে বিশ্বরূপা মঞ্চে যোগ দিন দিলীপবাবু। সঙ্গে সুজিৎ পাঠক। সেখানে অভিনয় হতো কর্ণার্জুন। দিলীপবাবু কর্ণ এবং সুজিৎ পাঠক অর্জুন। জয়শ্রী সেন দ্রৌপদী, রবি ঘোষ শকুনি। এক বছর পর আবার যাত্রায় প্রত্যাবর্তন।
পরের বছর তরুণ অপেরায় গেলেন। দলে ছিলেন বড় ফণী। তখনও শান্তিগোপাল স্টার হয়ে উঠতে পারেননি। পালা হয়েছিল ‘রক্তের নেশা’। আবার সত্যম্বরে প্রত্যাবর্তন। পালা ‘দীপ আজিও জ্বলে’। সঙ্গে ‘সোনাই দীঘি’। এখানে সোনাই করলেন সাহানা বোস। এরপর ভারতী অপেরা। সেই বছরই ভারতী অপেরার মালিক কালীপদ ঘোষ আরামবাগ থেকে এসে কলকাতায় গদিঘর করলেন। দিলীপবাবুর সঙ্গে সে বছর সেই দলে ছিলেন পান্না চক্রবর্তী, চিত্রা মল্লিক। এখানে সোনাই করতেন চিত্রা মল্লিক, পান্না করতেন যাদব। ব্রজেন দে’র ‘ভৈরবের ডাক’ নামল। দিলীপবাবু আওরঙ্গজেব। পান্না চক্রবর্তী ছত্রশাল, চিত্রা উদিপুরী বেগম। আর ছিলেন গুরুপদ ঘোষ। অনেক বড় অভিনেতা ছিলেন তিনি। সেটাই ছিল তাঁর যাত্রায় শেষ বছর। তিনি করতেন আফজল খাঁর চরিত্র।
পরের বছরও ভারতীতে। যাত্রায় নতুন এলেন শ্যামলী ভট্টাচার্য। শ্যামলীর সোনাই অভিনয় শুরু হল। জ্যোৎস্না দত্তের পর তিনিই সোনাই চরিত্রে বেশি অভিনয় করেছিলেন।
একদিন নিজে দল গড়লেন। শ্রীমা অপেরা। পালা ছিল ‘রক্তের পাপ’, ‘মুঘলে আজম’। এই পালায় দিলীপবাবু করতেন ইব্রাহিম লোদি এবং ননী ভট্ট করতেন বাবর। এরপর তিনি দলের নাম বদলে রাখলেন গণনাট্য। ১৯৭৫ সালে গণনাট্যের সুপারহিট পালা ছিল ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পঙ্গপাল’। এক আদর্শবাদী চরিত্র নিতাই মাস্টারের ভূমিকায় অভিনয় করে দিলীপবাবু প্রচুর খ্যাতি পেয়েছেন। সে বছর ওই চরিত্রের সুবাদে পেলেন ভারতশ্রেষ্ঠ গন্ধর্ব পুরস্কার। এরপর ‘তাজমহল’। সাজাহান চরিত্রও দাগ কাটল মানুষের মনে। তুষার বন্দ্যোপাধ্যায় করতেন আওরঙ্গজেব, শ্যামলী ভট্টাচার্য করতেন জাহানারা। গণনাট্য যেবার ‘চাণক্য’ পালা নামাল, সেবার চিৎপুরে তিনটি চাণক্য অভিনীত হয়েছিল। নট্ট কোম্পানির ‘কুবেরের পাশা’য় শেখর গঙ্গোপাধ্যায় করতেন চাণক্য। গণনাট্যে দিলীপবাবু করতেন চাণক্য এবং তপোবন নাট্য কোম্পানির ‘সম্রাট চাণক্য’ করতেন দুলাল চট্টোপাধ্যায়।
১৯৮৬ সালে ছেলে সন্দীপ চট্টোপাধ্যায় এলেন যাত্রায়। শুরু হল পিতাপুত্রের একসঙ্গে অভিনয়। পালা ছিল প্রসাদ ভট্টাচার্যের ‘সিরাজদৌল্লা’। সন্দীপবাবু সিরাজ এবং দিলীপবাবু মিরজাফর।
তাঁর অভিনীত অন্য পালাগুলি হল দ্বিতীয় পানিপথ, পুষ্পচন্দন, লৌহ প্রাচীর, কালাপাহাড়, ময়ূরমহল, সুলতান মামুদ, স্বর্ণলঙ্কা, মিশরকুমারী, রাতের বিভীষিকা, রজনী, অগ্নিসংকেত, বাদশা আলমগীর, কাস্তে হাতুড়ি তারা ইত্যাদি।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে অবসর নিলেন অভিনয় থেকে। তার কয়েক বছর পরে ১৯৯৮ সালে চলে গেলেন ‘নটসূর্য’। এই উপাধি তাঁকে দিয়েছিল বিশ্বরূপার নাট্য উন্নয়ন পরিষদ।
দিলীপ চট্টোপাধ্যায়ের অভিনীত চরিত্রের মধ্যে একটা দৃঢ়তা ছিল। চেহারা, কণ্ঠস্বর আর অভিনয় মিলে তৈরি হতো একটা বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসটা পৌঁছে যেত দর্শকদের মনের গভীরে এবং তৈরি হতো একটা ভালো লাগা। সে ভিলেন চরিত্রই হোক বা আদর্শবান কোনও চরিত্রই হোক। অভিনয়ে তিনি বারবার চরিত্রের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন। সেটাই তাঁকে দিয়েছে খ্যাতি এবং স্থায়িত্ব।
10th August, 2019