গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
বন্ধুরা, আগামী কালই দোল। হয়তো অনেকেই তোমরা যাবে শান্তিনিকেতনে। সেখানে ডাণ্ডিয়া নাচকে একটু অন্যভাবে তোমরা দেখতে পাবে। দুই হাতে কাঠি নিয়ে নাচতে থাকা ছাত্রছাত্রীদের মুখে শুনতে পাবে একটি গান। সেটি হল— ‘ওরে গৃহবাসী খোল, দ্বার খোল, লাগল যে দোল।/স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।’ যারা সবেমাত্র প্রাইমারি থেকে হাই স্কুলে ক্লাস ফাইভে উঠেছ তারা বাংলা বই খুলে গানটি দেখে নিতেই পার। ভাবছ, দোলের দিন আবার পড়াশোনা কীসের!
যাই হোক গানটায় লেখা কথাগুলোর সঙ্গে বাইরের পরিবেশের মিল খুব সহজেই পেয়ে যাবে। চারদিকে এই সময়টায় ফোটা অশোক, পলাশ ফুলের মধ্যে যেন সত্যি সত্যি ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি’ মিশে রয়েছে। পাকুড় বা অশ্বত্থ গাছের লালচে কচি পাতাগুলোতে জেগে ওঠা ‘রাঙা হিল্লোল’কে সহজেই দেখা যায়। পরম শান্তির দখিনা বাতাসে বাঁশবনের মর্মর শব্দ, ঘাসে ঘাসে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতি, মাধবীবিতানের ফুলের বর্ণে-গন্ধে মন বিভোর হয়ে যায়।
দোলের এই গানটির বয়স কিন্তু তিরানব্বই বছর। ১৯৩১ সালের ‘নবীন’ নাটকের গান এটি। এছাড়াও আমাদের প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসন্ত উৎসব নিয়ে লিখেছেন নানা গান, কবিতা, নাটক। ১৯১০ সালে দোল উপলক্ষ্যেই তিনি লিখেছিলেন ‘রাজা’ নাটক। এই নাটকের মধ্যেও রাজাকে আমরা বসন্ত উৎসবে মেতে উঠতে দেখি। ১৯১৬ সালে লেখা ‘ফাল্গুনী’ নাটকের ‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে’ গান আমাদের শুনতে ভালোই লাগে। বিশ্বকবি ১৯২৩ সালে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করেছিলেন ‘বসন্ত’ নাটক।
শান্তিনিকেতনের যে বসন্ত উৎসবের আজ জগৎজোড়া নাম, তা কিন্তু রবীন্দ্রনাথ চালু করেননি। কাজটা প্রথম করেছিলেন তাঁর ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে তা দোল বা হোলির দিনে করেননি কিন্তু। সেই উৎসব হয়েছিল সরস্বতী পুজোর দিনে। বহু যুগ আগে ওই দিনটিকেই বসন্তের শুরু ধরা হতো এবং ওই দিনেই পালন করা হতো বসন্তোৎসব। শান্তিনিকেতনে গেলেই তোমরা আশ্রমে যে আমবাগান দেখতে পাও তা আম্রকুঞ্জ নামে পরিচিত। শান্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বর্ধমানের মহারাজা একজন মালী পাঠিয়েছিলেন। তার হাতেই এই বাগান তৈরি হয়েছিল। সেখানে কবি গিয়ে দোলের দিন দাঁড়াতেন। চারপাশে নানা মাটির সরায় সাজানো থাকত আবির, পলাশ এবং আমাদের কাছে কিছুটা অপরিচিত শালফুল। আশ্রমের যাঁরা তোমাদের মতো বা তোমাদের থেকে একটু বেশি বয়সের থাকতেন, তাঁরা প্রত্যেকে বাড়িতে বাড়িতে ফাগ ছড়াতে ছড়াতে আম্রকুঞ্জে আসার ডাক দিতেন। সবশেষে সকলে সেখানে গিয়ে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে প্রণাম করতেন। ঠিক যেমন দোলের দিন তোমরা বড়দের পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম জানাও তেমনই।
তখন দোলের আগে এখনকার মতো এত রং,আবির, টুপি, গেঞ্জি, জামার দোকান বসত না। তাই সকলে প্রাকৃতিক রং যেমন বাটা হলুদের সঙ্গে তেঁতুলগোলা জল গুলে নিজেদের যে কোনও একটি জামাকাপড় রাঙিয়ে নিতেন।
তোমরা কত অল্পতেই মাঝে মাঝে দুঃখ পেয়ে মুখ ভার করে বসে থাক। কিন্তু বড় বড় বিপদকে মেনে নিয়ে হাসতে হাসতে পাশ কাটিয়ে চলাই যায়, চলতে হয়। এ শিক্ষা তোমরা রবীন্দ্রনাথের কাছেই শিখে নিতে পার। সময়টা প্রায় একশো বছর আগে। ১৯২৫ সালের দোলপূর্ণিমা উপলক্ষ্যে আশ্রমিকরা আম্রকুঞ্জকে খুব সুন্দরভাবে সাজিয়ে তুলেছিলেন। গাছের ডালে ডালে ছিল কবিতা লেখা। এমনকী রবি ঠাকুরও সেখানে কবিতা লিখে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিকাল থেকে শুরু হল প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি। সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। সকলেই কষ্ট পেলেন। কিন্তু ঝড়ঝঞ্ঝা থেমে গেলে রবীন্দ্রনাথ সকলকে নিয়ে চলে গেলেন তখনকার লাইব্রেরি অর্থাৎ এখনকার পাঠভবনে। সেখানে জ্যোৎস্নারাতে ছোট্ট করে ‘সুন্দর’ নাটকের অভিনয় হয়েছিল।
তাই দুঃখ নয়, এসো সকলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানেই বসন্ত উৎসবে মেতে উঠি, হইহই করি— ‘ওরে আয় রে তবে, মাত রে সবে আনন্দে/ আজ নবীন প্রাণের বসন্তে।।’
সপ্তম শ্রেণি, দিল্লি ওয়ার্ল্ড পাবলিক স্কুল, কল্যাণী