বিষয় সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে শরিকি বিবাদ চরম আকার ধারণ করতে পারে। কর্মে উন্নতি হবে। অপব্যয়ের ... বিশদ
ভিড় আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। তবে সকলে একসঙ্গে নয়। একজন দু’জন করে যেন খুব সন্তর্পণে এবং আগাম পরিকল্পনা করে উঠে যাচ্ছে বেঞ্চ ছেড়ে। বেশিরভাগ মানুষই পিছনের বেঞ্চে বসেছে। যাতে সহজেই উঠে চলে যাওয়া যায়। জোয়েল আর মার্থা সামনের দিকের বেঞ্চে বসলেও তাঁরা লক্ষ করেছেন তাঁদের ছেলে জর্জ আর মেয়ে নোরা এখানে এলেই সবসময় পিছন দিকে গিয়ে বসে। আর নির্দিষ্ট একটা সময়ের পর উঠে বাইরের প্রশস্ত প্রাঙ্গণে চলে যায়। দৌড়ঝাঁপ করে অন্য বাচ্চাগুলোর সঙ্গে। বিরক্ত জোয়েল। এসব কী? প্রেয়ার আর তারপর ফাদারের উপদেশ কিংবা বাইবেল পাঠ শেষ হওয়ার আগেই এরা দু’জন বেরিয়ে আসে কেন? এভাবে তো প্রভু যিশুর বাণী আত্মস্থ করা যাবে না! ছোট থেকেই যদি প্রভুর উপদেশাবলির বিশ্লেষণ উপলব্ধি করে নিতে না পারে, তাহলে বড় হলে চলবে কীভাবে?
স্বামীর রাগ দেখে মুখ টিপে হাসে মার্থা। সে জানে কারণটা। আসলে বাবা মায়ের পাশে বসতে আপত্তি নেই ছেলেমেয়ের। কিন্তু জর্জ আর মার্থা ভয় পায় পরীক্ষা দিতে। পাদ্রিসাহেব বাইবেল নিজে তো পড়েনই, হঠাৎ করে প্রশ্ন করে বসেন, এই যে তুমি, বল তো মোজেসের ব্যাপারে কী বললাম? এই যে তুমি উঠে এসো। গত সপ্তাহে প্রভুর যে চারটি বাণীর কথা পড়েছিলে এখানে, সেটা এবার না দেখে বল।
জর্জ আর নোরার মনে থাকে না। ৭ আর ১১ বছর বয়সের ভাইবোন অন্যদের সামনে লজ্জিত হতে চায় না। তাই পালায় আগে আগেই। তবে আব্বু বকে এরকম করলে! আব্বু? জর্জ, মার্থা, জোয়েল, নোরা এসব তো খ্রিস্টান নাম? আব্বু আবার কী?
পুরনো দিল্লির তুর্কমান গেটের বাঁদিকের রাস্তার নাম ফাজিল রোড। ঢুকেই বাঁদিকে যে বড় কাঠের দরজা। ওটা পেরলেই গির্জা। সামনেই এক বড়সড় কোর্টইয়ার্ড। যাকে ঘিরে আশপাশে একঝাঁক ঘর। বোঝাই যাচ্ছে, একটি বাসস্থানের মহল্লা। এই হল হোলি ট্রিনিটি চার্চ। চারদিকে মুসলিম মহল্লা। রয়েছে হিন্দু পাড়াও। মাঝখানে এই তুর্কমান গেট লাগোয়া পাড়ায় রয়েছে আপাতত ৩৪টি খ্রিস্টান পরিবার। কতজন ছিল? জোয়েল বলল, ছিল তো শুনেছি অনেক! প্রায় নাকি ২০০! আস্তে আস্তে সবাই চলে গিয়েছে। আপনাকে আপনার ছেলে আব্বু বলে কেন?
হেসে ফেলে জোয়েল। এই চত্বরে যত খ্রিস্টান দেখছেন এরা সকলেই হয় হিন্দু নয়তো মুসলিম ছিল আগে। মানে আমাদের বাপ ঠাকুরদার আমলে। তো আমার দাদু তো মুসলিম থেকে খ্রিস্টান হয়েছে। কিন্তু আচার আচরণ তহজিব আর জুবান সব তো আর বদল হয়নি। ওই তো দেখুন দীনা আন্টিকে। ওই যে গ্যারাজের সামনে ঘুমাচ্ছে। পাশের টুলে জলের বোতল আর বাইবেল রাখা দেখতে পাচ্ছেন? ওই বাইবেল কিন্তু উর্দুতে লেখা। ইংরেজি আর আমরা শিখলাম কোথায়। আমাদের এই পাড়ার বয়স্করা উর্দুতেই বাইবেল পড়ে। আর আমরা হিন্দিতে। আমার ছেলেমেয়ে আমাকে বলে আব্বু।
এখানে লাল। ওখানে নীল। সেখানে হলুদ। ওখানে সাতরঙা বেলুন। সামনে নীল রঙের স্টার ঝুলছে। এরকম রংচঙে চার্চ আর কোথায় আছে? বুধবার সন্ধ্যায় যেদিন সার্ভিস থাকবে, সেদিন দেখা যাবে চার্চের মধ্যে পোডিয়ামে প্যাস্টর যখন পাঠ করছেন কিংবা কোনও একটি বালক-বালিকা বাইবেল পড়ছে, অথবা ভায়োলিন বাজাচ্ছে, সেই পর্ব হয়ে যাওয়ার পর পাদ্রি সাহেব (এই নামেই ডাকা হয়) সকলকেই উর্দুতে খোদার দুয়া প্রার্থনা করে সকলকে বলছেন প্রভু যিশু মেসি কী জয়...। সকলে সমস্বরে বলে উঠছে জয়!
এখানে মুসলিম লবজ মিশে গিয়েছে বাইবেলে। এখানে খ্রিস্টান মায়ের কাছে মার্থা আবদার করছে সেও মঙ্গলবার রোজা রাখবে। তার বন্ধুরা তো রাখছে। ১৯০৪ সালে তুর্কমান গেটের কাছে তৈরি হয়েছিল এই চার্চ। ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে দিল্লিতে চারজন যাজক ঘুরে ঘুরে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার করছিলেন। তবে নির্দিষ্ট কোনও স্থান পাচ্ছিলেন না তাঁরা, যেখানে তৈরি করা হবে প্রার্থনাগৃহ। হঠাৎ পাওয়া গেল দিল্লির চার প্রান্তে চারটি জমি। তারই একটি এই ফাজিল রোডে। তৈরি হয়ে গেল চার্চ। শুধু চার্চ থাকলেই তো আর হবে না। ভক্তরা কোথায়? সাধারণত গরিব মুসলিম আর দলিত হিন্দুর দল ধর্মান্তরিত হয়েছিল। তাদের আবার ধর্ম বদল! নিজেদের ধর্মের লোক তাচ্ছিল্য করত। অতএব তার থেকে এখানেই জায়গা পাওয়া গেলে সকলে না হয় প্রভু যিশুর চোখের সামনে মিলেমিশে থাকবে। প্রার্থনা করবে। আর কাজকর্ম করে খাবে। সেই শুরু। সবথেকে প্রবীণা ওই দীনা ম্যাথিউজ। জোয়েলের দীনা আন্টি। উর্দু বাইবেল পাশে রেখে এখন রোদে পিঠ পেতে ঘুমাচ্ছেন। বয়স কত? হল প্রায় ৮৩!
পাশেই হোলি ট্রিনিটি স্কুল। দীনা ম্যাথিউজের শ্বশুর ওই স্কুলে যখন কাজ করেছেন, তখন ছিলেন ব্রিটিশ হেডমাস্টার। আর তারপর তো দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর ব্রিটিশরা আর রইল না। তন্দ্রা ভেঙেছে। দীনা বললেন, ‘কোথা থেকে আসছেন? আসবেন...আসবেন মাঝেমধ্যে!’ বলে আবার চোখ বোজেন।
অফিসঘর আছে তো একটা? হ্যাঁ আছে? বললেন জন আন্দ্রিয়াজ লাজার! মাত্র এক কিলোমিটার দূরে বুলবুলখানা। যেখানে শুয়ে আছেন রাজিয়া সুলতানা। পাশেই তুর্কমান গেট। বিখ্যাত তুর্কমান বায়াবনি দরগা। এসবের মধ্যে এই চার্চ কীভাবে গড়ে উঠল? গল্পটা কী?
জন বললেন, আমার ঠাকুরদার বাবা অ্যান্ড্রুজ লাজার। তিনি সেই প্রথম যুগের মানুষ। একটা ব্রোশিওর আছে। অফিসের গুদামে রাখা আছে। এখন জলে ভেজা। শুকিয়ে নিতে হবে। আসবেন। আমি রেখে দেব! আপনি বাঙালি তো? গোমতীর সঙ্গে দেখা করে যাবেন। গোমতী আবার কে? ওই যে চার নম্বর ঘরে। বহুকাল আগে কলকাতা থেকে এসেছিল। টোনিকে বিয়ে করে। তারপর থেকে এখানে! বাংলা জানে! আসবেন কিন্তু প্রভু যিশুর...।
বললাম, জয়!
হাসলেন জন আন্দ্রিয়াজ লাজার! হোলি ট্রিনিটি চার্চের ঘড়িতে আটটা বাজে। দিল্লি পুলিসের কনস্টেবল এসে বসলেন গেটের সামনে। পাহারায়! জন বললেন, সালাম মিশিরজি!