বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
পক্ষে
সুকন্যা দাস, কলেজ ছাত্রী
বর্তমান সময়ে সন্তানের মোবাইল আসক্তির জন্য বাবা-মা সম্পূর্ণ না হলেও অনেকাংশেই দায়ী। খাওয়ানোর সময় তাদের ভুলিয়ে রাখার জন্য প্রতিদিন মোবাইলে কার্টুন, ভিডিও দেখানো অথবা সারাদিন কাজের সময় বাচ্চাদের দুষ্টুমির কারণে যাতে বিরক্ত না হতে হয় তাই হাতে দিয়ে দিচ্ছেন মোবাইল, সাময়িক স্বস্তির জন্য। বাবা-মায়ের এমন আচরণ সন্তানের ভবিষ্যতে মোবাইলে আসক্ত হওয়ার বড় কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মার অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি আসক্তি তাদের সন্তানদের মধ্যে ছড়াচ্ছে। কারণ তারা ছোট, বড়দের অনুকরণ করে শিখতে শিখতে তা তাদের স্বভাব হয়ে যায়। তাই সময়ের সঙ্গে তাল রেখে এগতে গিয়ে হোক বা ছোটদের দুষ্টুমির থেকে রেহাই পেতে হোক, বাবা-মা ই যেন তাদের সন্তানদের আসক্ত করে ফেলছেন মোবাইলে। এটা থেকে সহজে মুক্তি নেই।
পার্বতী মোদক, শিক্ষিকা
শিশুদের মানসিক ও চারিত্রিক বিকাশে মা-বাবার ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তার আশপাশের বড়রা, বিশেষ করে মা বাবা যা বলেন, যেটা করেন, শিশু হুবহু সেটাই বলতে এবং করতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবে, সন্তানকে সময় না দিয়ে নিজেরা মোবাইলে ব্যস্ত থাকলে, সেও এমনিতেই মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়বে। আবার নিজেদের কর্মব্যস্ততা, ক্লান্তি, দুষ্টুমি সহ্য করার ধৈর্যর অভাব বা নির্বিঘ্নে খাওয়ানোর জন্য অনেক মা-ই শিশুকে মোবাইল ধরিয়ে দেন। এতে চটজলদি শিশু শান্ত হয়ে গেলেও কিংবা বিনা ঝামেলায় খেয়ে নিলেও তাদের মধ্যে এর গভীর কুপ্রভাব পড়ে। ইদানীং অনেকে বাচ্চাকে নিয়ে ভ্লগ তৈরি করান। এই প্রবণতা পরবর্তীকালে শিশুকে মোবাইলের রঙিন জগতে আসক্ত করে তুলবেই।
শীর্ষা ঘোষ গঙ্গোপাধ্যায়, বেসরকারি কর্মচারী
মানুষ অভ্যাসের দাস। অভ্যাস গড়ে ওঠে তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে। যেহেতু একটি শিশুর পারিপার্শ্বিক পরিবেশে তার মা-বাবার উপস্থিতি সর্বাধিক, তাই তার আচার-ব্যবহারে বাবা-মায়ের প্রভাবই সর্বাধিক পরিলক্ষিত হবে। জন্মের পর থেকে কোনও শিশু যদি দেখে তার বাবা-মা মোবাইলটিকে শুধুমাত্র প্রয়োজনের জন্যই ব্যবহার করছেন তবে সে জানবে এটি প্রয়োজন ব্যতীত অন্য কোনও বিনোদনের জন্য ব্যবহার করার যন্ত্র নয়। সেই সঙ্গে শিশুটি যদি দেখে যে তার বাবা-মা অবসর সময় বই পড়ছেন কিংবা গান শুনছেন অথবা টিভি দেখছেন তবে শিশুটির মধ্যেও সেই স্বভাবটি সহজাতভাবে গড়ে উঠবে। সুতরাং সন্তানের মোবাইল এর প্রতি আকর্ষণের জন্য বাবা-মা অধিক দায়ী।
ঊর্মিমেখলা দাস, শারীরবিদ্যা বিভাগের গবেষক
বেশ কিছু বছর যাবত ধরে প্রত্যক্ষ করেছি যে এই প্রজন্মের বাবা-মা বেশিরভাগই কর্মরত। সেক্ষেত্রে মা-বাবা সন্তানকে সময় দিতে পারেন কম। এটা প্রত্যেক বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে হয়তো প্রযোজ্য নয়, কিন্তু কেউ কাছে না থাকার কারণে কোন জিনিসের সংস্পর্শ ভালো আর কোন জিনিস মন্দ, তা শিশু বুঝতে পারে না। আবার বাবা-মায়ের অনুপস্থিতি যাতে বাচ্চারা বুঝতে না পারে তাই তাদের মোবাইলমুখী করে তুলেছেন একাংশ মা-বাবা। এতে তাঁরা হয়তো বুঝতে পারছেন না যে তাঁদের সন্তান তাতে কতটা আসক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে বাচ্চারা স্কুলে যেতে অনীহা দেখাচ্ছে, আউটডোর গেম খেলতে ইচ্ছুক নয়, এমনকী বাবা-মা পরবর্তীতে তাকে সঙ্গ দিতে গেলেও সে মোবাইলেই সময় দিচ্ছে। ৭-১২ বছর বয়সিদের মধ্যে জেদ বেড়ে যাচ্ছে। পড়াশোনায় মন বসাতে পারছে না। পরীক্ষার ফলও খারাপ হচ্ছে। তাছাড়া কোভিড পরবর্তীতে এই আসক্তি আরও বেড়েছে অনলাইন ক্লাস বা পড়াশোনায় মধ্য দিয়ে। মা-বাবার সঙ্গর বিকল্প কখনও মোবাইল হতে পারে না। তাই এই চরম কর্মব্যস্ততার জীবনেও সন্তানের সঙ্গে যদি বাবা-মা সময় কাটান, তাদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন তাহলে মোবাইল আসক্তি রোধ করা সম্ভব হবে।
বিপক্ষে
পীযূষ কান্তি সরকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
সাল ২০২০। মার্চ মাস। করোনার দাপটে বন্ধ হয়ে গেল স্কুল-মহাবিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা। অনলাইনে পড়া চালু করতে মোবাইলের প্রয়োজনীয়তা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেল। সাধারণ মোবাইল ফোনের পরিবর্তে স্মার্টফোনের চাহিদা হল আকাশছোঁয়া। ঘরে ঘরে গরিব বাবা-মা সন্তানদের খাবার জোগাতেই যখন হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলেন তখনই পড়াশোনার জন্য তাঁদের কিনে দিতে হয়েছিল স্মার্টফোন। সরকার থেকেও অবশ্য একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য মোবাইল কেনার অর্থপ্রদান করা হয়। এইভাবে একধাক্কায় চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের মোবাইল আসক্তি গত চার বছরে বেড়ে গিয়েছে। বাবা-মাকে এক্ষেত্রে সর্বতোভাবে দায়ী করা যায় না।
সোহিনী রায়চৌধুরী
‘পাশাপাশি বসে একসাথে দেখা, একসাথে নয় আসলে যে একা...’ হ্যাঁ, বড্ড একা লাগে বাড়ির প্রবীণ সদস্যদের। চোখ ছলছল করে পাশে বসে থাকা পরবর্তী প্রজন্মকে দেখে! কোথায় সেই সহজ-সরল জীবনযাপন, চোখের দেখা, প্রাণের কথা? আগে কী সুন্দর দিন কাটাতেন তাঁরা! সত্যিই তো, তাঁদের বাবা-মায়ের আমলে ছিল না মোবাইল, তাঁরাও এই মোবাইলের ব্যবহারে হাত পাকাতে পারেননি তেমন। আসক্ত হওয়ার প্রশ্নই নেই। কিন্তু পরের প্রজন্ম? তাদের নেশাতুর চোখ ঝলমল করে মুঠোফোনের রঙিন আলোয়। পৃথিবীটা ছোট হতে হতে এখন তাদের মুঠোফোনেই বন্দি! এ এক অদ্ভুত আকর্ষণ! তারা ভাবে, ‘ঘরে বসে সারা দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোতে...আ-হা...!’ আধুনিক যুগে এটিই হল বিজ্ঞানের আশীর্বাদ, তাদের মুশকিল আসান! এমন বন্ধু আর কে আছে! আমরা জানি বাবা-মা সন্তানের প্রথম গুরু। তাহলে মোবাইলে অনাসক্ত বাবা-মায়ের ছত্রছায়ায় থেকেও কেন এই হাল? মনে রাখা দরকার, কেবল বাবা-মা নয়। কাল, পরিস্থিতি, পরিপার্শ্বও আমাদের শিক্ষা দেয়। তাই বাবা-মাকে সবক্ষেত্রে দায়ী করা অযৌক্তিক! বাবা-মা যেমন পথ দেখাবেন, সন্তানকেও তেমন সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে শিক্ষাগ্রহণের জন্য। মোবাইল আসক্তি বড়-ছোট নির্বিশেষ সকলেরই হতে পারে। মোবাইলের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে সবাইকেই সচেতন হতে হবে। আমরা যদি এর উপকারিতা এবং অপকারিতা নিয়ে ওয়াকিবহাল হই এবং আসক্তি রোধ করার উপযুক্ত পদক্ষেপ নিই, তবেই ‘স্ক্রিন টাইম’ এবং পরিবারের সঙ্গে ‘কোয়ালিটি টাইম’ কাটানোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারব।
শিক্ষিকা
কুশল দত্ত, রাজ্য সরকারি কর্মী
পূর্বতন সমাজে পিতামাতা সন্তানকে মোবাইল কিনে দিতেন নির্দিষ্ট বয়সের পর। কিন্তু করোনা পরবর্তী সময়ে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা চালু হওয়ার পর পিতামাতা ছেলেমেয়ের হাতে মোবাইল তুলে দিলেন যাতে তাদের শিক্ষা বাধাপ্রাপ্ত না হয়। কোনও পিতামাতা নিশ্চয় চাইবেন না তার সন্তান অল্পবয়সে মোবাইল আসক্ত হয়ে জীবনের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হোক। বহির্জগতের আনন্দ আস্বাদন করার বাসনা শিশুর সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু সেটা যখন লাগামছাড়া হয়ে পড়ে তার দায় পিতামাতার উপর চাপিয়ে দেওয়া মোটেই সমীচীন নয়। সন্তানের মনোবৃত্তির গঠনে পিতামাতার সঙ্গে বিদ্যালয়, বন্ধুবান্ধবের ভূমিকা কম নয়। এখন শিশুর বেশির ভাগ সময় কাটে স্কুল ও টিউশনে। তাই মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল আসক্তি নিয়ন্ত্রণে তাদেরও ভূমিকা অনেক। পিতামাতা, শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষক-শিক্ষিকা সকলকে একসঙ্গে পড়াশোনা ব্যতীত মোবাইল অতিরিক্ত ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখতে হবে শিশুকে। দায়ভার শুধু পিতামাতার উপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়।
অরিজিৎ দাস অধিকারী, শিক্ষক, আশপুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়
তীব্র বিরোধিতা করছি। শিশুরা বাবা-মায়ের থেকে মোবাইলে আসক্ত হয় না। শহর গ্রামের আনাচেকানাচে, সিরিয়ালের এপিসোডে এপিসোডে মোবাইলেরই মাতব্বরি। প্রযুক্তির বিশ্বায়নে, অ্যাপে আটক জনজীবন, শৈশবই বাদ থাকবে কেন? শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। শিশুর পরিবেশে বাবা-মা ছাড়াও অনেক পরিজনের মেলবন্ধন। সবাই মোবাইল নির্ভর। তা থেকেই শিশুদের মোবাইলে আসক্ত। অনেক ক্ষেত্রেই, মা-বাবারা মোবাইলের বিন্দুবিসর্গ জানেন না, মোবাইলের নানা সমস্যায় তাঁরাই দ্বারস্থ হন আত্মজদের কাছে। এই দৃষ্টান্ত গ্রাম-শহরে প্রবলভাবে প্রকট। শিশুদের মোবাইল প্রীতির জন্য শুধুমাত্র মা-বাবা নয়, আধুনিক উন্নত সমাজযাপনই দায়ী।
ছবি: ভাস্কর মুখোপাধ্যায়