পারিপার্শ্বিক কোনও ঘটনা চিন্তা বাড়াতে পারে। সাংস্কৃতিক কর্মে যোগদান ও মানসিক তৃপ্তিলাভ। শরীরের খেয়াল রাখুন। ... বিশদ
একে তো ফাগুন মাস! কিন্তু ফাগুনই যে আগুন ধরাচ্ছে। এই গরমে আরাম দিতে পারে কোটা দোরিয়া। তাই অনেকেই হাল্কা ফুরফুরে গায়ে লেগে থাকা এই ফ্যাব্রিক পছন্দ করেন। সুতি কোটা দোরিয়া বলতে আগে শাড়িই বুঝত সবাই। এখন কাল বদলেছে। কোটা দোরিয়ার ওড়না থেকে শুরু করে কুর্তিও এসেছে বাজারে। শাড়িতে স্বচ্ছন্দ না হলে বেছে নিতে পারেন এই ধরনের কুর্তি।
রাজস্থানের কোটা জেলার কৈথুনে তৈরি হয় এই হাল্কা কাপড়টি। গ্রাফ পেপারের মতো ছোট্ট ছোট্ট স্কোয়্যার বা খোপ (যাকে বলে খত) হাতে বুনে তৈরি হয় কোটা শাড়ি। শুধু কৈথুন নয়, আশপাশের আরও কিছু গ্রামে তাঁতিরা কোটার শাড়ি বোনেন। শুধু সুতি নয়, কোটার কাজ হয় সিল্কেও। সিল্কের শাড়িতেও ছোট ছোট বর্গাকার প্যাটার্ন থাকে। হাল্কা এবং আরামদায়ক বলেই ভারতে এত জনপ্রিয়
কোটা দোরিয়া।
জানা যায়, ১৭০০ সালের মাঝামাঝি কোটা সেনার কম্যান্ডার জালিম সিং ঝালা নাকি কর্ণাটকের মাইসোর (তদানীন্তন মহীশূর) থেকে তাঁতিদের নিয়ে এসেছিলেন নিজের জেলায়। তাঁতিদের কাছে এই বুনন দেখে তাঁর মনে হয়েছিল এই কোটা দোরিয়া কাপড় দিয়ে মাথায় পাগড়ির মতো বেঁধে রাখলে গরমে কষ্ট কম হবে। রাও কিশোর সিংয়ের শাসনের সময়কালে তাঁর উৎসাহে এই বুনন জনপ্রিয় হয়। ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রাণ হারান রাও কিশোর। রয়ে যায় তাঁর ভালোবাসার কোটা দোরিয়া।
রাজস্থানে এমনিই গরম থেকে বাঁচতে মাথায় কাপড় জড়িয়ে রাখেন পুরুষরা। এই সূত্রে মাইসোর থেকে বর্গাকৃতি খোপবিশিষ্ট কাপড়ের বুননশিল্পীরা চলে এলেন কোটায়। বোনা শুরু হল কোটা দোরিয়া। প্রথমে বলা হতো কোটা মাসুরিয়া, যেহেতু মাইসোর থেকে তাঁতিরা এসে বুনতেন পাগড়ির কাপড়। মাত্র আট ইঞ্চি চওড়া তাঁতে বোনা হতো ঐতিহ্যবাহী পাগ বা পাগড়ি। এই কাপড়ের আরাম দেখে পাগড়ি থেকে ক্রমে ক্রমে এই ফ্যাব্রিকে শুরু হল শাড়ি বোনা। এল বড় মাপের তাঁত। আনুমানিক ২০ : ৮০ অনুপাতে সুতির সঙ্গে মিশল সিল্ক, যাতে এ শাড়ি একটু পোক্ত হয়। এখন শুধুমাত্র সিল্কেও কোটা দোরিয়া হাতে বোনা হচ্ছে।
এই ফ্যাব্রিকের মধ্যে মোটিফ বলতে শুরুতে থাকত ছোট বুটি। পরে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসেছে নানারকম আধুনিক মোটিফ এবং রং। আসল এবং ভালো কোটা দোরিয়া শাড়ি বুনতে সময় লাগে প্রায় এক মাস। সুরাত এবং বেনারসে এখন পাওয়ার লুম-এ তৈরি হচ্ছে কোটা শাড়ি। তাতে কখনও থাকছে হ্যান্ড ব্লক প্রিন্ট, কখনও এমব্রয়ডারি। এই ধরনের কোটা দিয়ে মূলত তৈরি হচ্ছে কুর্তি, ফ্যাশনেবল লং ড্রেস এবং দোপাট্টা।
কোটা দোরিয়া বোনা প্রথমে যেভাবে শুরু হয়েছিল অঞ্চলভেদে তার নকশা কিছুটা বদলাল। উত্তর ভারতের সিল্কে ছোট ছোট খোপ আরও ঘন হল, কিন্তু দক্ষিণের সিল্কে কোটার এই খত তুলনায় কিছুটা বড় বড়ই রইল। রাজস্থানী সিল্ক কোটা শাড়িতে মোটিফ হিসেবে এখন দেখতে পাবেন আঙুরফুল লতা, পেজলি, এবং টেম্পল বর্ডার। এছাড়াও রাজস্থানী সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে আছে উজ্জ্বল রঙ্গোলি প্রিন্ট, জ্যামিতিক নকশা ইত্যাদি। প্রিন্টেড কোটা ডিজাইনার শাড়িতে দেখতে পাবেন বর্তমানে জনপ্রিয় বাগরু ব্লক প্রিন্ট, ডাবু মাড এবং গোটা পাত্তি। এই শাড়িতে অনেক সময় তৈরি করা হয় জরি দেওয়া একটি করে লাইন। রোজকার কোটা শাড়ির পরিবর্তে এই শাড়ি তখন আনুষ্ঠানিক সাজেও অপরিহার্য
হয়ে ওঠে।
এখন শাড়ির পাশাপাশি আধুনিক প্রজন্মের ব্যবহারের জন্য কোটার ওড়না ও কুর্তি তৈরি হচ্ছে। তাতে যোগ করা হচ্ছে চোখের আরাম দেওয়া সামার প্রিন্টস। কখনও ডাই করে ফ্যাব্রিকে আনা হচ্ছে প্যাস্টেল শেডস। সাদা, অফ-হোয়াইট, পাউডার পিঙ্ক, সাধারণ গোলাপি, মাস্টার্ড ইয়েলো, ওশেন ব্লু-হোয়াইট মিলিয়ে মিশিয়ে এমন নানা না চোখজুড়ানো রঙে তৈরি হচ্ছে কুর্তি। অফিসে হোক বা গ্রীষ্মের সকালবেলার কোনও কাজে এধরনের কুর্তি খুব মানানসই। গরমের সকালে যেন চোখজ্বলা একটা অনুভূতি গ্রাস করে। এধরনের ফ্যাব্রিক পরলে মনও ভালো হয়। আর দাবদাহ থেকে আরাম তো অতিরিক্ত পাওনা। এই ধরনের কুর্তির সঙ্গে ম্যাচিং দোপাট্টা বা ওড়নাও তৈরি হচ্ছে আড়াই মিটার লম্বা। এই ওড়নাগুলোও ভীষণ আরামাদায়ক। নরম কাপড়ের পাগড়ি মাথায় জড়ানোর মতোই মেয়েদের ক্ষেত্রে এই কাপড় গলায় জড়িয়ে নেওয়া ওড়না হিসেবে, গ্রীষ্মের তাপ থেকে অনেকটা রেহাই দেয়। কুর্তির মতো লং বা মিডিয়াম লেন্থ কোটা দোরিয়া কটন ড্রেসও তৈরি হচ্ছে এখন। যাঁরা ড্রেস পরতে ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য এধরনের পোশাক একইরকম ফ্যাশনদুরস্ত।
তবে কোটা দোরিয়া শাড়ি, দোপাট্টা, কুর্তি বা ড্রেস— সবই যত্নে রাখতে হয়। নাহলে এই ফ্যাব্রিক ভালো থাকবে না। যা পরে এত আরাম তাকেও তো আরাম দিতে হবে! এই ধরনের ফ্যাব্রিক নিয়মিত ব্যবহার করা গেলেও ধোওয়ার ক্ষেত্রে একটু সতর্ক থাকতে হবে। ফ্যাব্রিক নতুনের মতো রাখতে প্রথম দিকে বেশ কয়েকবার ড্রাই ক্লিন করিয়ে নেওয়াই ভালো। পরের দিকে বাড়িতে ঠান্ডা জলে কাচা হলেও ব্যবহার করতে হবে একেবারে হাল্কা লিক্যুইড ডিটারজেন্ট এবং অবশ্যই হাতে হাল্কা করে ধুয়ে নিতে হবে। মেশিন ওয়াশ তো প্রশ্নই নেই। এই ফ্যাব্রিক ভীষণই পরিবেশবান্ধব। টিস্যু পেপারে মুড়ে একটা সুতির ব্যাগে ভরে রাখুন কোটা দোরিয়া।