বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
কলেজে এক মনে পড়িতে পারিতাম না, একবার পড়ার কথা মনে পড়িলে, পরক্ষণেই ভাবিতাম, মা বুঝি এখনও খান নাই; বাটীতে ফিরিয়া কী খাইব। এইসব ভাবনা মনে উত্থিত হইয়া পড়ার ব্যাঘাত ঘটিত।’ ছাত্রজীবনে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে কঠিন জীবন অতিবাহিত করার কথা এভাবেই বলে গিয়েছেন তিনি। অসামান্য মেধার জোরে সেই তিনিই পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েছেন নিজের নাম। নাম তাঁর রাধানাথ শিকদার।
কলকাতার জোড়াসাঁকোয় ১৮১৩ সালে জন্ম রাধানাথের। বাবা তিতুরাম শিকদার ও মা দেবকী দেবীর জ্যেষ্ঠ পুত্র তিনি। ১৮২৪ সালে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। বিজ্ঞান, গণিত প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর অসামান্য জ্ঞানের পরিচয় মেলে। তাঁর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হন ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের পথিকৃৎ হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। অচিরেই তিনি হয়ে ওঠেন ডিরোজিওর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র।
মাত্র আঠারো-উনিশ বছর বয়সে অঙ্কের নানা জটিল বিষয়ে পারদর্শিতা দেখিয়ে ছাত্রসমাজে নিজেকে অসামান্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করেন রাধানাথ। কলেজে পড়ার পাশাপাশি একটি অবৈতনিক বিদ্যালয়ে তিনি কিছুদিন শিক্ষকতা করেন।
রাধানাথ শিকদার ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। ১৮২৮ সালে অসাধারণ আবৃত্তি করে জিতে নেন ডেভিড হেয়ার, রাধাকান্ত দেব প্রমুখের স্বাক্ষরিত প্রশংসাপত্র। ছাত্রাবস্থায় অন্যতম সেরা প্রবন্ধ রচয়িতা হিসাবেও নির্বাচিত হন। তিনিই টাউন হলে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের একটি রচনাংশ পাঠ করে বিদ্যোৎসাহী মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। গ্রিক, লাতিন, ইংরেজি ভাষায় দখল ছিল তাঁর। সাহিত্যিক প্যারীচাঁদ মিত্রের সঙ্গে যৌথভাবে ‘মাসিক পত্রিকা’ নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা
করতেন তিনি।
রাধানাথ প্রকৃত অর্থেই ছিলেন মানবপ্রেমিক। একজন বিদেশি ম্যাজিস্ট্রেট রাধানাথের পরিচারক সহ কিছু মানুষকে বিনা পারিশ্রমিকে ব্যক্তিগত কাজ করিয়ে নিচ্ছেন শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি রুখে দাঁড়ান। এজন্য ম্যাজিস্ট্রেটের নালিশে কাঠগড়ায় উঠতে হয় তাঁকে। সেখানেও জোরালো ভাষায় এই জুলুমের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন তিনি। আদালতের রায়ে তাঁকে দু’শো টাকা জরিমানা দিতে হলেও এই ঘটনায় বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করানোর বিরুদ্ধে জনমত
গড়ে ওঠে।
রাধানাথ শিকদারের জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা নির্ণয়। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে বরফাচ্ছাদিত উত্তর-পূর্ব হিমালয়ের ‘পিক ফিফটিন’ শৃঙ্গটিকে ছয়টি পৃথক স্থান থেকে নিরীক্ষণ করে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে, এটিই বিশ্বের উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ। উচ্চতা ৮ হাজার ৮৪৮ মিটার। পরবর্তীকালে বহু গবেষণার পর রাধানাথের নির্ণয় অভ্রান্ত বলে স্বীকৃতি পায়। বর্তমানে এই শৃঙ্গটিই মাউন্ট এভারেস্ট নামে পরিচিত।
বিজ্ঞানী রাধানাথ শিকদার জ্যোতির্বিজ্ঞান, জনস্বাস্থ্য ও আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রভৃতি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। এই অকৃতদার স্বদেশ প্রেমিকের জীবনদীপ নির্বাপিত হয় ১৮৭০ সালে চন্দননগরে। তাঁর সম্পর্কে ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকার মূল্যায়ন— ‘তিনি গ্রিক ও লাতিন সাহিত্যপাঠে প্রভূত আনন্দ লাভ করিতেন এবং মাসিক পত্রিকার জন্য প্লুটার্ক ও জেনোফেন লিখিত গ্রন্থ হইতে কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন। তিনি কড়া ধরনের লোক ছিলেন এবং সদ্য সদ্য কর্মনির্বাহ করিতেন এবং কার্যকারণকালে ক্ষিপ্রকারিতার ন্যূনতা তাঁহাতে কখন পরিলক্ষিত হয় নাই। রাধানাথ অসাধারণ লোক ছিলেন এবং তাঁহার অনেক সদ্গুণ ছিল।’