সম্প্রতি হাওড়া নাট্যজন মঞ্চস্থ করলো তাঁদের নতুন নাটক ‘দেবী চম্পক গন্ধা’। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস নাগিনী কন্যার কাহিনী অবলম্বনে এই নাটক রচনা করেছেন সমিত চৌধুরী। তিনি রাঢ় বাংলার সাঁতালি পাহাড়ের ঢালে সবুজ অরণ্যের ঘন ছায়ায় ব্যাপৃত অজগায়ে বসবাসকারী বেদে বেদেনীদের দৈনন্দিন সর্পিল জীবন জীবিকার ছবি এঁকেছেন।
হুগলি একক প্রয়াসের উদ্যোগে দুটি নাটক মঞ্চস্থ হল শিশির মঞ্চে। রঙ্গপীঠ প্রযোজিত নাটক ‘প্রাপ্তমনস্ক’ ও আয়োজক দলের ‘স্যান্ডুইচ’। এক অবৈধ সম্পর্কের পোস্টমর্টেম নিয়ে প্রাপ্তমনস্ক ও সাম্প্রতিক কালের রাজ্য রাজনীতির দুরবস্থার ওপর নির্মিত হয় স্যান্ডুইচ নাটকটি। রাকেশ বন্দ্যোপাধ্যায় একজন ব্যবসায়ী।
পাড়ার ভিতরে লোকজন বিহীন একটি গলি। যে গলিতে অনুষ্টুপ আর শিলাদিত্যের শৈশব কেটেছে। কী মধুর সেই শৈশবস্মৃতি! কিন্তু হঠাৎই কোথায় যেন হারিয়ে গেল শৈশবের মিষ্টি দিনগুলো। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল দুজনে। তারপর আর কেউ কারও খোঁজ রাখেনি।
সম্প্রতি ‘রং নাম্বার’ নাটকটি নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন রাকেশ বেদি। নাটক শেষে মঞ্চেই আড্ডা জমালেন আমাদের প্রতিনিধি কমলিনী চক্রবর্তীর সঙ্গে। নাটক, সিনেমা, অভিনয় ও ব্যক্তি রাকেশ উঠে এলেন সেই আড্ডায়।
পারিবারিক ঝামেলার সন্তোষজনক নিষ্পত্তি। প্রেম-প্রণয়ে শুভ। অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষে মানসিক চাপ বৃদ্ধি। প্রতিকার: আজ দই খেয়ে ... বিশদ
অর্ধ শতকের বেশি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে। বহু মানুষের রক্ত ও শহিদদের প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতা আমাদের কতটা স্বাধীন করেছে? আদৌও সত্যিকারের স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি কি? পরাধীনতার শিকল থেকে এখনও কি মুক্ত হয়েছি আমরা? এই প্রশ্ন কি জাগে না ভারতবাসীর মনে?
আমার আলোচ্য বিষয় যদিও সেটা নয়। তুবও স্বাধীনতার অলোচনায় কথাগুলি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। সম্প্রতি জ্ঞান মঞ্চে মঞ্চস্থ হওয়া ‘এবং নান্দিক’ প্রযোজিত নাটক ‘অনির্বাণ’ এমনই এক প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে এমন বহু মানুষ ছিলেন যাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন, এমনকি প্রাণ বিসর্জনও দিয়েছেন। ইতিহাস বা স্বাধীনোত্তর প্রজন্ম তেমনভাবে স্মরণে রাখেনি তাঁদের। আশি বছরের গিরিবালা সরকার এ নাটকের মুখ্য, প্রধান ও একক চরিত্র। হতদারিদ্রে নুব্জ বৃদ্ধা গিরিবালা এই বয়সেও ছেলে বউমার সংসারে ব্রাত্য কারণ স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে পেনশনটুকুও দাবী করতে চাননি কখনও, ওটা তাঁর কাছে বড় অপমানের, লজ্জার। অশীতিপর গিরিবালা সারাক্ষণ উঠানে বসে নিজের সঙ্গে কথা বলেন, আর ভাবেন তাঁর সহযোগী বিপ্লবী কুঞ্জরানী ভৌমিক, সুশীলাদিদি, মাস্টারদা, প্রীতিলতার কথা। আশা করেন এদের উত্তরপুরুষের কেউ না কেউ একদিন আসবে আর যে গৌরবগাঁথা সব বইতে লেখা আছে তা পড়ে শোনাবে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে এক মহান স্বাধীনতা কুঞ্জরানী ভৌমিকের লেখা স্মৃতিকথা উদ্ধার করে তাঁর নাতি অর্নিবাণ। তাঁর পাঠের মধ্যে দিয়ে উঠে আসে আর এক সংগ্রামী গিরিবালা সরকারের জীবনী। জানা যায় গিরিবালা ও কুঞ্জরানীর সাহসিকতার কথা। শহীদ হওয়া স্বামী সন্তানের স্মৃতি হাতড়ে, বয়সের ভারে নুয়ে পড়া গিরিবালার ঝাপসা দৃষ্টি, ও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা বার্ধর্ক্যের ছাপ স্পষ্ট হলেও সেদিনের কথা বলতে গিয়ে এখনও দু’চোখ ভেসে যায় জলে। কান্নায় ভেঙে পড়ে অচিরেই, আবার দৃপ্ত কণ্ঠে শোনায় প্রীতিলতা, সূর্য সেনদের বিপ্লব ও দেশভক্তির কথা।
এক সুন্দর মর্মগাঁথা আত্মত্যাগ, বলিদানের গল্প বর্ণিত হয় নাটকে। স্বাধীনোত্তর ভারতের সামাজিক চিত্র এবং গিরিবালাদেবীর বর্তমান অবস্থান নিয়ে একাঙ্ক নাটক অর্নিবাণ। শুধু একাঙ্ক বললে একটু ভুল হবে। কারণ নাটকে কথক, অভিনেত্রী এবং টুকরো টুকরোভাবে পার্শ্বচরিত্রগুলোর আনাগোনা বিষয়টির ব্যাখায় যথেষ্ট সহায়তা করেছে। টান টান বুনোটে চোখের সামনে ভেসে ওঠে পরাধীন ভারতের শিহরণ জাগানো কাহিনী। তাৎপর্যপূর্ণ গান ও মিউজিকের ব্যবহার সময় ও কালের গৌরবকে মহিমান্বিত করে। ভালো লাগে গিরিবালারূপী চরিত্রটিকে। অভিনয়ের দাপট ও ভাবভঙ্গিতে কখনও দেশপ্রেমিকের স্ত্রী, শহীদের মা আবার কখনও সহযোদ্ধার সহানুভূতিসম্পন্ন বান্ধবী। সবরূপেই তিনি অনন্য। আগুনের পরশমনি, কেন চেয়ে আছো গো মা, বন্দেমাতরম গানগুলির ব্যবহার মনে রাখার মতো। শুধু সাউন্ড বা শব্দ কখনও কণ্ঠস্বরকে ছপিয়ে যাওয়ায় সংলাপ বুঝতে একটু অসুবিধা হয়। এই সামান ত্রুটিটুকু শুধরে নিলে সর্বাঙ্গীন সুন্দর হতে পারে নাটকটি। ইন্দ্রনীল মন্ডল নির্দেশত নাটকটির নাট্যকার বিমলেন্দু দত্ত। অভিনয়ে ইন্দ্রনীল, অভি সিংহ রায় (অর্নিবাণ), গিরিবালা (জয়া চৌধুরি), অঙ্কিতা ঘোষ, গোপাল হালদার, দেবজ্যোতি গুঁই, সঞ্চিতা পাঠক, ইন্দায়ুধ পাঠক, সুব্রত দাসগুপ্ত, দীপা, শ্রুতি ঘোষ।
দ্বিতীয় নাটকটির বিষয় একেবারে অন্যরকম। বিজ্ঞাপনি মায়াজালে বাজারি পণ্যের নেশা কীভাবে ক্রেতাদের মস্তিষ্কে সেঁধিয়ে যায় আর তারপর সোনার আংটি তামার দরে বেচে বিপুল মুনাফা লাভ করে কুবের বাণিজ্যিক সংস্থারা। কীভাবে মধ্যমণি শিক্ষিত ফোরেরা বিজ্ঞাপন সংস্থার এজেন্টের মুখোশ পরে ফরাসী ওয়াইনে সাঁতার কাটে আর বোকা জনতা পুঙ্গ হয়ে মারা যায় তার একটা স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে ‘ল্যাঙড়া ধাবা’ নাটকটি।
হাইওয়ের ধারে হরিহর সামন্তর ধাবা এখন প্রায় অচল। সামনেই নতুন ওভারব্রিজের ওপর ডান্স বার, সিঙ্গার বারের নেশায় সব খদ্দের ওপারে চলে যায়। তাই হরিহরবাবুর ধাবায় আর তেমন লোকজন আসে না। অথচ ওই ধাবায় একটি ল্যাংড়া ছেলে কাজ করে যাকে ট্রাক ড্রাইভাররা খুব ভালোবাসে। একদিন রাস্তা পার হবার সময় ল্যাঙড়া বেসামাল হয়ে পরে যায়, সবাই ভাবে ল্যাংড়া মারা গেল বুঝি। কিন্তু ড্রাইভার হীর সিং এর তৎপরতায় সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যায়। নামী বিজ্ঞাপন সংস্থার এজেন্ট মিঃ ব্যানার্জি প্রতি সন্ধায় ওই ধাবায় সুরাপানে সময় কাটান। ল্যাঙড়ার ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেন এবং ল্যাংড়াকে আকাশকুসুম লোভ দেখিয়ে বলেন, যদি সে প্রতিদিন হাই রোডে হাইস্পিডে আসা গাড়ির সামনে পড়ে যেতে পারে, তাহলে তাকে মুম্বইতে গিয়ে গান গাওয়ার সুযোগ করে দেবে। মিঃ ব্যানার্জির উদ্দেশ্য না বুঝেই ল্যাংড়া রাজি হয়ে যায়। এরপর থেকে সে রোজ ট্রাকের সামনে পড়ে যায়, যাতে ট্রাক সাডেন ব্রেক কোষে। আর পরপর ট্রাকগুলি দাঁড়িয়ে যায় ধাবার সামনে। ধাবার সেল বেড়ে যায়। ধাবায় লগ্নি করানো হয়, চকচকে নতুন সাজে সেজে ওঠে।
হরিহর সামন্তের চরিত্রে পৃথ্বীপাল মাদাহার, ব্যানার্জির ভূমিকায় প্রবীর আদিত্য, ল্যাংড়ারূপী সুদীপ্ত মজুমদার সকলের নজর কাড়ে। অন্যান্য চরিত্রে গোপাল হালদার, অভিষেক, দেবজ্যোতি গুঁই, বাপন দাস যথাযথ। গানে সোহিনী ভট্টাচার্য, আবৃত্তি নন্দিনী দত্ত মন্ডল, সুকন্যা রায়, সুব্রত দাসগুপ্ত, রুমা ভট্টাচার্য। আবহ-রবীন দাস, শঙ্খ দত্ত, পার্থপ্রতীম পাল।
কলি ঘোষ
