রাজনীতিক ও পেশাদারদের ব্যস্ততা বাড়বে। বয়স্করা শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিন। ধনযোগ আছে। ... বিশদ
থিয়েলাইটের নবতম প্রযোজনা ‘শয়তান’ একটি বিরহমূলক ছোট আয়তনের নাটক। নাটকের মুখ্য চরিত্র অনি— অতনু সরকার শুরু করে গল্প বলা। সে তার পিসিমার দেওরের মেয়ে সোহাগের সঙ্গে কৈশোর-প্রেমে হাবুডুবু খায়। তাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন চলে তথাকথিত গোপন সম্পর্ককে নিয়ে। সোহাগ কখনও অনিকে ভাইফোঁটা দেয়নি। যদিও সে লতায়-পাতায় অনির বোন। তারা নবীন বয়সে প্রবীণতার ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে নির্জনে ছোটদের পক্ষে অপাঠযোগ্য বই— পর্ণগ্রাফি নয়— ন হন্যতে, চতুরঙ্গ, শেষের কবিতা পাঠ করতে শেখে একসঙ্গে। যদিও যৌনতার তাড়না তাদেরকে প্রাথমিকভাবে ব্যতিব্যস্ত করেনি, কিন্তু যৌনতার আবেদনের মানে তারা বুঝতে শিখে যায় অতি অল্প বয়সেই। তাদের আশি কিম্বা নব্বই-এর দশকের কৈশোর, মাধুরী-সলমনের চটুল বাণিজ্যিক প্রেমে মজে যায় অচিরেই। অন্ধকার ঘরে গভীর রাতে রোমান্টিক ছায়াছবি দেখতে দেখতে কিশোর-কিশোরী অশরীরী প্রেমের মধ্যে বম্বের নায়ক-নায়িকার তথাকথিত অযৌন-চুম্বন অন্য এক কৌতূহলের ইঙ্গিত হয়ে খেলা করে। এদিকে তারা কিন্তু বখে যাওয়া ছেলেমেয়ে নয় মোটেও, রীতিমত পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষিত হয়ে ওঠার লক্ষ্য দু’জনেরই সাধারণ মানসিকতা। কিন্তু সেই লক্ষ্য ক্রমশ সাফল্যের আদর্শকে হারাতে থাকে। সে কি শুধুমাত্র প্রেমেরই পরিণতির অসাফল্যে? একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে সুন্দরী অহঙ্কারী সোহাগের বিয়ে ঠিক হয় অন্য এক ‘সফল’ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে এবং অনি হয়ে পড়ে একা। জীবনের একটি বিশেষ সন্ধিলগ্নে এসে তার সম্বল হয়ে ওঠে অসাফল্যের হাহাকার, কেবল মাত্র হাহাকার। অসফল সে কেরিয়ার গঠনে, অসফল সে প্রিয়া-মিলনে। এরপরই অনি ক্রমশ লেডি-কিলার ইন্টারনেট গেমে আসক্ত হয়ে পড়ে এবং মানসিক রোগীতে পরিণত হয়। তার অন্তিম ঠিকানা হয় মেন্টাল হসপিটাল। এটুকু পড়ে মনে হতে পারে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ব্যর্থ প্রেমিকের উন্মাদ হয়ে যাওয়ার চিরাচরিত গল্প। কিন্তু নাট্যশৈলীতে এখানেই টুইস্ট এনেছেন নির্দেশক তথা এই নাট্যের মুখ্য অভিনেতা অতনু সরকার। সে কথা এখানে আলোচনা করলে নাটক দেখার আকর্ষণে ভাটা পড়তে পারে। তবে যেভাবে থানা রূপান্তরিত হয়ে ওঠে এসাইলামে, এই দৃশ্য সত্যিই ম্যাজিক! বিয়োগান্তক নাট্যের শেষ দৃশ্যে প্রায় কোমায় চলে যাওয়া বিকারগ্রস্ত অনির অবচেতনে যখন সোহাগ এসে ধরা দেয় তাদের স্মৃতি নিয়ে, তখন জলের শব্দ আর ধূসর নীল আলো মিশে যে মূর্ছনা সৃষ্টি হয়, তা ভাবতে বাধ্য করায় যে অনির মস্তিষ্ক জল হয়ে যাচ্ছে— অপূর্ব ব্যঞ্জনা।
অনির্বাণ বসুর লেখা এই নাটক ভীষণ পরিণত। পরিচালনা ও ‘অনি’র চরিত্রে নাট্য-পরিচালক অতনু সরকার। এক কথায় তিনিই একা অটোবায়োগ্রাফি বলার ঢঙে গোটা নাটকটিকে এগিয়ে নিয়ে যান। ইদানীংকালে অতনুর করা অভিনয় থেকে এ নাট্যে সম্পূর্ণ অন্য ঢংয়ে নিজেকে অন্য উচ্চতায় মেলে ধরেছে অতনু। একবারের জন্যেও মনে হয়নি তিনি অভিনয় করছেন, কী সাবলীলভাবে এক মানসিক রোগীর যন্ত্রণা সূক্ষাতিসূক্ষ্ম স্বাত্ত্বিক অভিনয় দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন আর এ কাজে তাঁকে যোগ্য সঙ্গত করেছেন সোহাগ চরিত্রে তাঁর সহধর্মিনী-সহঅভিনেত্রী শম্পা দাস সরকার। কী নীরব চাহনী, স্বর ক্ষেপণে যেমন পারদর্শী তেমন ছোট ছোট অভিব্যক্তি দিয়ে মেলে ধরেছেন বয়ঃসন্ধির উন্মাদনা। অন্তরঙ্গ মুহূর্তে যে সাবলীল চলন তা প্রমাণ করে শম্পা একজন জাত অভিনেত্রী।
অন্যান্য কুশীলবরা দৃশ্যায়নের স্বার্থে মাঝেমধ্যে উঁকিঝুঁকি মেরেছেন বটে, কিন্তু তাঁরা তাঁদের প্রয়োজনীয় কাজটুকু ঠিক ঠিক সময়ে ঠিক ঠিক ভাবে করে গেছেন বলে কখনও তাঁদেরকে পার্শ্ব-চরিত্র বলে মনে হয়নি। বরং আলো এবং সেটের সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্তে তাঁরা সম্পৃক্ত থেকে গিয়েছেন। বাবার চরিত্রে সৌতিন্দ্র কৃষ্ণ দেবের অভিনয় প্রশংসনীয়। সোহাগের ভাইয়ের ছোট্ট চরিত্রে কিশোর অভিনেতা সালোক্য দাশ যথোপযুক্ত। বলার অপেক্ষা রাখে না পরিচালক নাটকের ডিজাইনে একশো শতাংশ সফল। জালের ঘেরাটোপের সেট এই প্রযোজনাকে আলাদা উচ্চতা দিয়েছে, বিমুগ্ধকর আলোক ভাবনায় শঙ্কু কুমার দাসের চিন্তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে আলোক প্রেক্ষাপনে আরও সতর্ক থাকা ও যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। একই কথা প্রযোজ্য শব্দ প্রেক্ষাপনের ক্ষেত্রেও। কারিগরী সমস্যায় শব্দ মাঝে মধ্যেই মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে এদিনের অভিনয়ে। আবহ ভাবনায় সামসন মাথুর চক্রবর্তী। সব মিলিয়ে প্রযোজনাটি সত্যিই অভিনব।