অতিরিক্ত কর্মের চাপ গ্রহণ করে বেকায়দায় পড়তে পারেন। নতুন কর্মলাভের সম্ভাবনা। আয় বাড়বে। ... বিশদ
নীলাচলে এই প্রথম জগন্নাথ-দর্শন শ্রীচৈতন্যের। আর প্রভুকে দর্শন মাত্রই স্তব্ধ, প্রেমাবিষ্ট হলেন তিনি। দু’চোখে তাঁর আনন্দাশ্রু। প্রাণের ঠাকুরকে আলিঙ্গন করার জন্য দারুবিগ্রহকে লক্ষ্য করে যে মুহূর্তে ছুটে যেতে চাইলেন সঙ্গে সঙ্গে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন। ‘হায় জগন্নাথ’ বলে যখন মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন, সেই মুহূর্তেই মহাপ্রভুর অনন্ত কৃষ্ণভাব জগন্নাথদেবের শ্রীঅঙ্গে চিরতরে বিলীন হয়ে গেল। শুধু রাধাভাব রয়ে গেল তাঁর। শ্রীরাধিকার সেই কৃষ্ণপ্রেমই কলিযুগে এক আশ্চর্য ভক্তিমার্গের দিশা খুঁজে পেয়েছে অবতার স্বরূপ শ্রীচৈতন্যের হৃদয়ে। চব্বিশ বছর বয়সে সন্ন্যাস। জীবনের বাকি চব্বিশ বছরের মধ্যে আঠারো বছরই পুরীতে অতিবাহিত করেন শ্রীচৈতন্য। বাকি ছয় বছরে দাক্ষিণাত্য মথুরা, বৃন্দাবন সহ ছয়টি ধর্মযাত্রা। ‘অষ্টাদশ বর্ষ কৈল নীলাচলে স্থিতি।/ আপনি আচরি জীবে শিখাইল ভক্তি।।’ (শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত)
পুরীর রথযাত্রার আজ যে এত খ্যাতি তার প্রধান কারণ, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানে এই রথযাত্রা এক অনন্য মর্যাদা লাভ করে। শ্রীচৈতন্যকে নিয়ে রচিত বিভিন্ন গ্রন্থে সেকথা সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। বিশেষ করে ষোড়শ শতকের বঙ্গদেশের বাঙালিরা পথের বিপদ-আপদ তুচ্ছজ্ঞান করে পুরীর রথযাত্রায় যোগদান করেছেন একমাত্র মহাপ্রভুর আকর্ষণে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের লোকজন বারবার ছুটে গিয়েছেন পুরীর রথে।
এমনকী ‘পথি বিবর্জিতা নারী’ এই আপ্তবাক্যকে পরোয়া না করে বিপদসংকুল পথ নির্ভয়ে অতিক্রম করে পুরীর রথে শামিল হয়েছেন সে যুগের মহিলারাও। কারণ, সেই এক। জগন্নাথদেব এবং শ্রীচৈতন্যের অমোঘ আকর্ষণ। মহাপ্রভুও অপার আনন্দলাভ করেছেন ভক্তদের সান্নিধ্যে।
চৈতন্যদেবের নিত্যলীলা নীলাচলে। তাঁর দৈবলীলা চাক্ষুষ করে ধন্য নীলাচলবাসী। মহাপ্রভুর হঠাৎ ইচ্ছা হল যে, তিনি আসন্ন রথযাত্রায় গুণ্ডিচা মন্দির-মার্জনা সেবা করবেন। তিনি মনে করেন গুণ্ডিচা মন্দির যেন সেই বৃন্দাবন যেখানে রাধাকৃষ্ণের পারস্পরিক ভক্তিরসের মিলন হয়েছিল। মহাপ্রভু নিজেও রাধাভাবে বিভাবিত। বৃন্দাবনসম ওই গুণ্ডিচা মন্দিরেই শ্রীকৃষ্ণকে আবার নিজের মতো করে পাবেন তিনি। পুরীর মন্দির হচ্ছে জগন্নাথদেবের ঐশ্বর্যলীলার প্রতীক। তিনি হলেন রাজাধিরাজ। এই মন্দিরে তাঁর পুজো-অর্চনা, ভোগ, বেশবাস সব কিছুতেই বৈভবের ছড়াছড়ি। গুণ্ডিচা মন্দির হল জগন্নাথদেবের মাধুর্যলীলার প্রতীক। রথযাত্রায় জগন্নাথরূপী শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা থেকে বৃন্দাবনে যান।
গুণ্ডিচা মন্দির শ্রীকৃষ্ণের কুঞ্জবন। সেই কুঞ্জবনে তাঁর শুভাগমন হবে। ‘কাল আসবে প্রাণবন্ধুয়া/ আজ কুঞ্জ সাজ গো।’ যত দ্রুত সম্ভব এই কুঞ্জবনকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলা একান্ত দরকার। সেই কাজটিই সুষ্ঠুভাবে করার জন্য ব্যগ্রতার শেষ নেই মহাপ্রভুর। পরদিন প্রভাতেই সঙ্গীসাথীদের নিয়ে গুণ্ডিচা মন্দিরে পৌঁছে গেলেন। ইতিমধ্যে জগন্নাথ মন্দিরের এক পরিছা গুণ্ডিচা মন্দিরে একশো মাটির ঘট আনিয়ে রেখেছেন। গুণ্ডিচা মন্দিরে পৌঁছানোর পর শ্রীচৈতন্য প্রত্যেকের হাতে তুলে দিলেন একটি করে মার্জনী। তিনিই প্রথমে মন্দিরের অভ্যন্তর মার্জন শুরু করলেন। যে রত্নবেদিতে জগন্নাথদেব, বলভদ্র ও সুভদ্রা বিরাজ করবেন সেই বেদিটিও নিজের হাতে মার্জন করলেন। এখন একে শোধন করা বলে।
সঙ্গীসাথীরা কে কতটা কাজ করছে সেদিকেও তীক্ষ্ণ নজর মহাপ্রভুর। ‘প্রভু কহে কে কত করিয়াছে মার্জন/ তৃণ-ধূলি পরিমাণে জানিব পরিশ্রম।’ কীভাবে কত সুন্দর করে মার্জন করা সম্ভব সেটা ভক্তদের নিজেই দেখিয়ে দেন। কৃষ্ণনামের সঙ্গে মন্দির মার্জনের কাজ পুরোদমে চলতে থাকে। কেউ ভালোভাবে মার্জন করছে দেখে মুক্তকণ্ঠে তার প্রশংসা করেন মহাপ্রভু। আবার কেউ ফাঁকি দিচ্ছে দেখলে মৃদু হেসে তাকে ভর্ৎসনাও করেছেন। শ্রীচৈতন্যই কর্তব্য পালনের গুরুত্ব সম্বন্ধে শিষ্যদের শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর মার্জনের ধরন এতটাই নিখুঁত যে, সূক্ষ্মধূলি, তৃণ, কাঁকর সব দূরীভূত হল। ‘ভালমত শোধ সব প্রভুর অন্তঃপুর।’
ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবরের জলে গুণ্ডিচা মন্দির দু’বার শোধন করার পর চৈতন্যদেব তাঁর পরিধেয় বস্ত্রের অংশ দিয়ে রত্নবেদি প্রক্ষালন করলেন। ভক্তরাও হাতে হাতে জলভরা ঘট এগিয়ে দেন মহাপ্রভুকে। ‘কেহ জলঘট দেয় মহাপ্রভুর করে।/ কেহ জল দেয় তাঁর চরণ উপরে।।’’ গুণ্ডিচা মন্দির ভালোভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ায় শ্রীচৈতন্যের মনে আনন্দ ধরে না। কুঞ্জবন প্রস্তুত। কৃষ্ণের কথা ভাবতে ভাবতে মহাপ্রভু মহাভাবে বিভোর।
রথযাত্রার দিন ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যাত্যাগ করলেন চৈতন্যদেব। ভক্তগণসহ স্নান-প্রাতঃকৃত্যাদি সারলেন। অহরহ শ্রীমুখে কৃষ্ণনাম তাঁর। ভক্ত পরিবৃত কলিযুগের কৃষ্ণাবতার এসে উপস্থিত হলেন মন্দিরের সিংহদ্বারের সামনে। জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রাকে তখন রথে তোলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এই মহা আয়োজন অত্যন্ত প্রসন্ন মনে দেখতে থাকেন মহাপ্রভু। ইতিমধ্যে রাজা প্রতাপরুদ্র সোনার ঝাড়ু দিয়ে জগন্নাথদেবের যাত্রাপথ পরিষ্কার করতে শুরু করেছেন। চন্দন মিশ্রিত জলে পথ ধোওয়ানো হচ্ছে। আর এইসব দৃশ্য অবলোকন করে মহাপ্রভুর মনে আবারও মহাভাবের উদয় হয়। তিনি ‘মণিমা’ বলে উচ্চধ্বনি করে ওঠেন। ওড়িয়াতে ‘মণিমা’ কথার অর্থ প্রভু। শ্রীচৈতন্য বেশিরভাগ সময় একটা ঘোরের মধ্যে থাকতেন। এ হল এক অপূর্ব দিব্যোন্মাদ অবস্থা!
তিনটি রথেরই সাজসজ্জা দেখে লোকজনের মনে আনন্দের শেষ নেই। নানা রঙিন বস্ত্রে রথগুলি বিভূষিত। রথের মাথায় পতাকা উড়ছে। ‘লীলায় চড়িলা ঈশ্বর (জগন্নাথদেব) রথের উপর/ আর দুই রথে চড়ে শুভদ্রা হলধর।’ ‘জয় জগন্নাথ’ বলে জগন্নাথদেবের নামে জয়ধ্বনি করে ওঠে কয়েক হাজার ভক্ত। রথযাত্রার এই বিশেষ দিনটিকে কেন্দ্র করে পাঁচশো বছর আগে চৈতন্যের যুগেও জনসাধারণের উৎসাহ ও উদ্দীপনায় কোনও ঘাটতি ছিল না।
রথাযাত্রার শুভমুহূর্ত সমাগত। দুন্দুভি বাজল। কাঁসর-ঘণ্টা বাজল। মহাপ্রভু ভক্তদের কপালে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দিলেন। প্রত্যেকের গলায় পরিয়ে দিলেন ফুলের মালা পরমানন্দপুরী, ভারতী ব্রহ্মানন্দ, অদ্বৈত আচার্য, নিত্যানন্দপ্রভু এঁরা মহাপ্রভুর পাশে। যাঁরা কীর্তন করবেন তাঁদেরও মালা-চন্দন দিলেন মহাপ্রভু। এঁদের দলনেতা স্বরূপ দামোদর ও শ্রীবাস। চার সম্প্রদায়ের ছয়জন করে মোট ২৪ জন গায়ক। দু’জন করে চার সম্প্রদায়ের মোট ৮ জন মৃদঙ্গবাদক। ৩২ জনকে চারটি দলে বিভক্ত করা হল মহাপ্রভুর ইচ্ছাতেই। রথের আগে চার সম্প্রদায়ের কীর্তনীয়ারা গাইছেন আর নৃত্য করছেন। রথের দু’পাশে আরও দুই সম্প্রদায়ের লোকজন নৃত্যরত। রথের পিছনে অন্য একটি সম্প্রদায়ের লোকজন। সাত সম্প্রদায়ের চোদ্দোটি মাদল বাজতে থাকে। মহাপ্রভুও মহানন্দে ‘হরি হরি’ বলে ওঠেন। ‘জয় জগন্নাথ’ বলে নাচতে থাকেন। ধীরে ধীরে রথ এগিয়ে চলে।
পাঁচশো বছর আগে পুরীর মন্দির থেকে গুণ্ডিচা মন্দিরের যাত্রাপথ তো আর আজকের মতো ছিল না। দু’পাশে তাল আর নারকেল গাছ। অন্য গাছগাছালি। ফুলের বাগান যেন শ্যামলিমায় ঢাকা প্রাচীন বৃন্দাবনেরই ভক্তিরসসিক্ত ভক্তজনের পথ। এই রথযাত্রায় রাজা প্রতাপরুদ্রকে বুকে টেনে নেন শ্রীচৈতন্য।
মহাপ্রভুর নৃত্য-গীত দেখে জগন্নাথের রথটানা মাঝে মাঝেই থেমে যায়। পথে ভিড় করা লোকজন অনিমেষ নয়নে শ্রীচৈতন্যের দিকে তাকিয়ে। আনন্দে বিহ্বল তারা। কৃষ্ণপ্রেমে উচ্ছল সকলের মনপ্রাণ। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে রয়েছে— ‘উদ্দণ্ড নৃত্যে প্রভুর অদ্ভুত বিকার।/ অষ্ট সাত্ত্বিক ভাবোদয় হয় সমকাল।।/ কভু স্তম্ভ কভু প্রভু ভূমিতে পড়য়।/ শুষ্ককাষ্ঠসম হস্ত পদ না চলয়।’ আবার রথের রশিতে টান পড়ে। নৃত্যগীত সহযোগে ভক্তদের শোভাযাত্রাও এগিয়ে চলে আর এদিকে জগন্নাথে মগ্ন মহাপ্রভু দু’হাত মাথায় তুলে নাচতে নাচতে এগিয়ে চলেন। ‘নাচিতে নাচিতে প্রভুর হৈল ভাবান্তর/ হস্ত তুলি শ্লোক পড়ে করি উচ্চস্বর।’ উল্টোরথেও সেই একই চৈতন্যময় চিত্র।