১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম চার দফায় ৩৭৯টি আসনে ভোট হয়ে গিয়েছে। এই ভোট যতটা উদ্বেগে রেখেছে শাসক বিজেপিকে, ততটাই চাপে পড়েছে নির্বাচন কমিশন। কারণ, ভোটদানের হার। বিস্তর টালবাহানার পর কমিশনের দেওয়া তথ্যে জানা যাচ্ছে, চার দফা মিলিয়ে মোট ভোট পড়েছে প্রায় ৬৭ শতাংশ। ভোটদানের কথা ছিল ৬৭ কোটি ৩৬ লক্ষ মানুষের। ভোট দিয়েছেন ৪৫ কোটি ১০ লক্ষ। তার মানে, ভোট দেননি ২২ কোটি ২৬ লক্ষ মানুষ। সহজ অঙ্কে যা ৩৩ শতাংশের সামান্য বেশি। এবারের নির্বাচনের আরও তিন দফা ভোট বাকি। তাতে আরও প্রায় ৩০ কোটি নাগরিকের ভোটদানের কথা। কিন্তু প্রথম চার দফার ধারা মানলে এবারে ভোট না দেওয়া মানুষের সংখ্যা ৩২ কোটির কাছাকাছি দাঁড়াতে পারে বলে অনুমান বিশেষজ্ঞদের। সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের উৎসবে দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষের ভোটদানে অনীহা প্রবল চাপে রেখেছে যুগপৎ শাসকদল ও নির্বাচন কমিশনকে। মূলত ধর্মের ভিত্তিতে সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ছড়িয়ে ভোটের হার বাড়ানোর কৌশল নিয়েছিলেন মোদি-শাহরা। কিন্তু সেই কৌশল ব্যর্থ হওয়ায় ভোটের মাঝপথে গেরুয়া শিবিরের অন্দরে সরকার গঠনের সম্ভাবনা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন চিহ্ন দেখা দিয়েছে। সরকার গঠনের ‘ম্যাজিক সংখ্যা’ ২৭২টি আসন বিজেপি তথা এনডিএ দখল করতে পারবে কি না, সেই চিন্তায় ঘুম ছুটেছে গেরুয়া শিবিরের। ভোটের হার বাড়াতে নানারকম প্রচারের আয়োজন করেছে কমিশন। কিন্তু তা যে কার্যত ভস্মে ঘি ঢালা হয়েছে, চার দফার পরিসংখ্যানই তা বলে দিচ্ছে। উদ্বিগ্ন কমিশন তাই বাকি তিন দফার জন্য কিছু নতুন পরিকল্পনা নিয়েছে। যেমন, ভোটারদের ফোনে শচীন তেণ্ডুলকরের রেকর্ডেড বার্তা পৌঁছে দেওয়া, খেলার মাঠে, ট্রেন বাস, রেডিওতে প্রচার বাড়ানো হবে। আবার অনলাইন খাবারের অ্যাপ, এটিএম সহ ২৬টি উপায়ে প্রচারের পরিকল্পনা করেছে কমিশন। তবু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, এত আয়োজনের পরেও ভোটের হার বাড়বে কি? ভোটদানে অনীহার কারণ প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কি না তা নিয়ে সংশয়ে গেরুয়া শিবির। গতবারের তুলনায় এবার ভোটার সংখ্যা ৬ কোটি বাড়লেও এবং কোটি কোটি টাকা খরচ করে এত আয়োজন সত্ত্বেও কেন ভোটারদের একটা অংশ বুথমুখো হচ্ছেন না তা নিয়ে উদ্বেগে শাসক শিবির। এই কারণে তাদের রক্তচাপ যেমন বাড়ছে, তেমনই চাপ বাড়ছে কমিশনেরও। ভোটের হার নিয়ে তথ্য প্রকাশে কমিশনের টালবাহানা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা।
তবে ভোটদানে অনীহার রোগটা অবশ্য কয়েক দশকের পুরনো। বলা ভালো, ভোট দেওয়ায় অনীহা এদেশে এখন ক্রনিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এমন প্রবণতা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক। ভারতের নির্বাচন মণ্ডলী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চার গুণ, ইংল্যান্ডের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ এবং পাকিস্তানের চেয়ে সাত গুণ বড়। চলতি লোকসভায় ভোটারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৬.৮ কোটি। দেখা যাচ্ছে, ১৯৫১ সালে প্রথম লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন ৪৫.৬৭ শতাংশ মানুষ। তারপর ভোটদানের হার একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে ২০০৪-এ ৫৭.৯৮ শতাংশ, ২০০৯-এ ৫৮.১৪ শতাংশ হয়। মোদি যেবার প্রথম ক্ষমতায় এলেন সেই ২০১৪-তে ৬৬.৪৪ শতাংশ এবং ২০১৯-এ প্রায় ৬৭ শতাংশ ভোট পড়ে। এই পরিসংখ্যানে স্পষ্ট প্রতি দশকেই ভোটের হার বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রতি নির্বাচনেই একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ ভোটদানে বিরত থেকেছেন। এও দেখা গিয়েছে, ভোটে জিতে যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন তাঁদের পিছনে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন নেই। ২০১৪ সালে বিজেপি এককভাবে ২৮২টি আসন পেয়েছিল, তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল মাত্র ৩১.৩৪ শতাংশ। ২০১৯-এ তারা পায় ৩০৩টি আসন। ভোট পায় ৩৭.৭৬ শতাংশ। লড়াই ত্রিমুখী, চতুর্মুখী হওয়ার সুযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট না পেয়েই ক্ষমতা দখল করে বিজেপি। গণতন্ত্রের এ এক নিষ্ঠুর পরিহাস।
এত বিপুল সংখ্যক নাগরিকের ভোট দিতে কেন অনীহা থাকে, তা নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ কম হয়নি। চমকপ্রদ তথ্য হল, গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষের মধ্যে ভোটদানের অনীহা বেশি। বিশেষজ্ঞরা যাকে ‘শহুরে উদাসীনতা’ বলছেন। ভোট দিয়ে কী হবে, কোনও দলই মানুষের কথা ভাবে না, যেই লঙ্কায় যায় সেই রাবণ, ক্ষমতায় এলে রাজনীতিকরা আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকেন—জাতীয় মানসিকতা ভোট না দেওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। এবারের অতিরিক্ত গরমও ভোট কম পড়ার কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু শুধু নির্বাচনের সময় মানুষকে সচেতন করলে ভোটদানের হার বাড়বে কি না সে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকের মতে, দুটি নির্বাচনের মাঝে পাঁচ বছর সময় থাকে। যাঁরা ভোট দিলেন না তাঁদের চিহ্নিত করে ভোট না দেওয়ার কারণ জানতে চাওয়া এবং সচেতন করার জন্য এই মধ্যবর্তী সময়টাকে ব্যবহার করা যেতে পারে। এজন্য কমিশনের সুসংহত পরিকল্পনা দরকার। দুঃখের বিষয় হল, এই দায় কমিশন বা শাসক কেউই নিতে নারাজ। তাই ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।