বহু প্রতীক্ষিত চর্চিত লোকসভা ভোট শুরু হয়েছে শুক্রবার। এই ভোট শেষ হতে মে মাস গড়িয়ে যাবে। একদিকে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে এনডিএ-র তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টা, অন্যদিকে বিরোধীদের জোট ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের শাসন ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার লড়াইয়ের উত্তাপ যেন প্রবল দাবদাহকেও হার মানাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভোট মানে তো পরস্পর বিরোধী নীতি-আদর্শের লড়াই। প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মাধ্যমে জনসমর্থন আদায়ের মরিয়া চেষ্টা। কিন্তু এই চিরায়ত রীতির বাইরে এবারের নির্বাচনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ইডি, সিবিআই, আইটি’র মতো কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির ভূমিকা। কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দেশের সব বিরোধী দলের অন্যতম প্রধান অভিযোগ হল, এই তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে ব্যবহার করছেন ‘মোদি অ্যান্ড কোম্পানি’। তথ্য দিয়ে তারা বোঝাতে চাইছে, মোদি জমানায় যত মামলা করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি, তার ৯৫ শতাংশই হল বিরোধী দলের নেতা-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। এমনকী বিরোধীদের মনোবল ভাঙতে ভোটের আগে দিল্লি ও ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীকে (প্রাক্তন) গ্রেপ্তার করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চাইছে মোদি সরকার। স্বাধীন কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি ন্যক্কারজনকভাবে মোদি-শাহদের অঙ্গুলিহেলনে চলছে বলে অভিযোগ। বিরোধী দমনে রাজনৈতিক ‘অস্ত্র’ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে ইডি-সিবিআইকে। বিরোধীদের এই সম্মিলিত অভিযোগ অবশ্য ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী! সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে তাঁর সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইডি এখনও পর্যন্ত যত মামলা করেছে তার মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশের মতো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বা রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রী। বাকিরা হয় দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি আধিকারিক বা দুষ্কৃতী। তাই বিরোধীদের টার্গেট করে ইডি-সিবিআইকে কাজে লাগানোর অভিযোগের কোনও ভিত্তি নেই। কিন্তু সত্যিই কি তাই?
যে অভিযোগ নিয়ে গত এক দশক গোটা দেশ তোলপাড়, তা নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া এমন তথ্য সামনে এলে নড়েচড়ে বসতেই হয়। আর তা করতে গিয়েই দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী অর্ধসত্য বলেছেন। দেখা যাচ্ছে, মোদির এই পরিসংখ্যান ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ইডির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বলা। কিন্তু তার পরেও পনেরো মাসে যে ঘটনা ঘটেছে, সেই আপডেট দেননি প্রধানমন্ত্রী। তাছাড়া এই পরিসংখ্যানের শুরু ২০০৫ থেকে, যখন কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল ইউপিএ। অর্থাৎ, ২০০৫ থেকে ২০২৩-এর ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত আর্থিক তছরুপের অভিযোগে মোট ৫ হাজার ৯০৬টি মামলা করেছে ইডি। এর মধ্যে মাত্র ১৭৬টি মামলা হয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে, যা ৩ শতাংশের কম। মোদি তাঁর সাক্ষাৎকারে সিবিআইয়ের মামলা নিয়ে একটি কথাও বলেননি। হয়তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই। সব মিলিয়ে তাই প্রধানমন্ত্রীর এই দাবি বড়সড় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তথ্য বলছে, ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ইউপিএ আমলে ২৬ জন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছিল ইডি। এর মধ্যে ১৪ জন অর্থাৎ ৫৩ শতাংশ বিরোধী দলের নেতানেত্রী ছিলেন। ওই সময়কালে ৭২ জন রাজনৈতিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করেছিল সিবিআই। এর মধ্যে ৪৩ জন বা ৬০ শতাংশ ছিল বিরোধী শিবিরের। পক্ষান্তরে ২০১৪-২৪ সাল পর্যন্ত মোদি জমানায় ১২১ জন রাজনৈতিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছে ইডি। এর মধ্যে ১১৫ জন বা ৯৫ শতাংশই বিরোধী শিবিবের। এই সময়ে ১২৪ জন রাজনৈতিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে সিবিআই। যার মধ্যে ১১৮ জন বা ৯৫ শতাংশই বিরোধী দলগুলির নেতা-মন্ত্রী। ইউপিএ আমলে ইডি-সিবিআইয়ের তদন্ত চলাকালীন কাউকে গ্রেপ্তার করা না হলেও মোদি জমানায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৯ জন। বিরোধী যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে ইডি, সিবিআই তাঁদের মধ্যে একজন মুখ্যমন্ত্রী, ১৪ জন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, ১৯ জন মন্ত্রী, ২৪ জন সাংসদ, ৭ জন প্রাক্তন সাংসদ, ২১ জন বিধায়ক, ১১ জন প্রাক্তন বিধায়কের নাম উল্লেখযোগ্য।
বিরোধীদের অভিযোগ, আর্থিক তছরুপের দায়ে বা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত যাঁরা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন তাঁদের বিরুদ্ধে ইডি সিবিআইয়ের মামলা হয় বন্ধ করা হয়েছে অথবা ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী, অশোক চ্যবন, প্রফুল্ল প্যাটেল সহ অনেকে। বিজেপির ‘ওয়াশিং মেশিনে’ এঁরা সবাই ‘ক্লিনচিট’ পেয়েছেন! অথচ প্রধানমন্ত্রী তাঁর সাক্ষাৎকারে এই নিয়ে টুঁ শব্দটিও করেননি! দুর্নীতিতে অভিযুক্ত বিজেপি নেতারা কীভাবে নিশ্চিন্তে রয়েছেন তা বোঝাতে গিয়ে মহারাষ্ট্রের এক নেতা বলেছেন, ‘ইডি আমার পিছনে আসবে না। কারণ আমি একজন বিজেপি সাংসদ।’ এসব দেখে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সঠিকভাবেই বলেছেন, নির্বাচনের আগে এজেন্সিকে কাজে লাগিয়ে ‘ম্যাচ ফিক্সিং’ করছেন মোদি। আর মোদির হুঁশিয়ারি, ভোটে জিতে ফিরলে এজেন্সির অভিযান আরও গতি পাবে। এ তো প্রচ্ছন্ন হুমকি। তবে কি আগামী দিনে বড় মাপের প্রায় সব বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের ঠিকানা হবে জেল? উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ। কিন্তু মোদির রাজত্বে এই আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।