সোনিয়া গান্ধী এখন অসুস্থ। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি অনেক দিন যাবৎ তেমন নজরে পড়ে না। তবে তিনি যখন রাজনীতিতে ফুলফর্মে এবং দেশজুড়ে কংগ্রেসের সর্বেসর্বা ছিলেন, তখনও তাঁর লোকদেখানো হম্বতম্বি নজরে পড়েনি। বিরোধীদের রাজনৈতিক আক্রমণের মোকাবিলা করেছেন তিনি রীতিমতো শিষ্টাচার মেনেই। তাঁর বিরুদ্ধে গেরুয়া শিবিরের আক্রমণ বারবার ব্যক্তিগত পর্যায়েই নেমে এসেছে। তবু সোনিয়া কখনওই নিজেকে অত নীচে নামাননি। রাজনৈতিক লড়াইয়ের সীমাবদ্ধতা তাঁকে কখনও শেখাতে হয়নি—না সংসদ, না নির্বাচন কমিশনকে। কিন্তু সোনিয়ার কংগ্রেসকে বিরোধী শিবির, বিশেষ করে সঙ্ঘের আদর্শে পরিচালিত বিজেপি কখনও ছেড়ে কথা বলেনি—নেতৃত্ব রাহুল গান্ধী, এমনকী মল্লিকার্জুন খাড়্গের হাতে ন্যস্ত হওয়ার পরও। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালকে পাশে রাখলে পরিষ্কার হয় যে, মোদির পার্টির আক্রমণের ধার এবারের সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষ্যে আরও তীব্র হয়েছে। তাই এবার সেই যথেষ্ট সহনশীলা সোনিয়াই অসুস্থতা সত্ত্বেও ‘গেরুয়া শিবিরের নয়নের মণি’ নরেন্দ্র মোদিকে ঝাঁঝালো ভাষায় আক্রমণ করেছেন। শনিবার রাজস্থানের জয়পুর থেকে প্রকাশিত হয় কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহার। মোদিকে রাজনৈতিক আক্রমণের জন্য সোনিয়া বেছে নেন ওই অনুষ্ঠানটিকেই। সেখানে জনসভা থেকেই তিনি আক্রমণ করেন মোদিতন্ত্রকে।
আমরা জানি, মোদির একদশকের শাসনকালে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ‘ইলেক্টোরাল অটোক্রেসি’ বা ‘সোনার পাথরবাটি’তে রূপান্তরিত হয়েছে। এজন্য ভারতবাসীর উপর যে নির্যাতন চলছে, তা নজর এড়ায়নি দেশ-বিদেশের বা আন্তর্জাতিক মহলের। আন্তর্জাতিক সমীক্ষক সংস্থার পাশাপাশি, জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একাধিক বিশেষ বন্ধু দেশও এজন্য মোদি সরকারের সমালোচনা করেছে। কিছু ক্ষেত্রে সতর্কও করা হয়েছে ভারতকে। নয়াদিল্লির তরফে ‘সব পশ্চিমা শক্তির কুৎসা’ বলে বারবার নস্যাৎ করার চেষ্টা হলেও দেশবাসী জানে, আন্তর্জাতিক মহল কালোকে কালো বলতে পরোয়া করে না। শনিবার কিছুটা ব্যতিক্রমীভাবেই যেন সোনিয়া গান্ধী হাতে তুলে নিলেন সেই অস্ত্রটাই। তিনি বলেন, ‘নিজেকে মহান প্রতিপন্ন করতে ব্যস্ত মোদিজি গণতন্ত্রের মর্যাদার বস্ত্রহরণ করছেন! ভারতকে একজোট হতে হবে। এবারের নির্বাচন আসলে গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই।’ সোনিয়া বলেন, ‘গত দশবছরে ভারতের বহু ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় লোকসান হয়েছে গণতন্ত্র আর সংবিধানের। ফের বিজেপি সরকার তৈরি হলে এই দুটির যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেটুকুও আর থাকবে না। নরেন্দ্র মোদি একদিকে গণতন্ত্র ধ্বংস করে চলেছেন, অন্যদিকে মতলব করছেন সংবিধানও বদলে ফেলার। গণতন্ত্র ও সংবিধান হল ভারত ও ভারতবাসীর আত্মা। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমাদের সকলকেই এই দুটি রক্ষা করতে হবে।’ সোনিয়ার তোপ, ‘গণতন্ত্র কোথায়? এখন তো স্বৈরতন্ত্র চলছে। আমাদের সকলকেই এর পাল্টা জবাব দিতে হবে এবং এই ভোটে।’ বিজেপি সরকারকে ‘বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি ও আর্থিক মন্দার কারিগর’ দেগে দিয়ে সোনিয়া বলেছেন, ‘মোদি জমানায় দেশে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে কর্মহীন যুবক-যুবতী এবং বৈষম্য। ধনী এবং গরিবের মধ্যে বৈষম্য মোদিযুগে চরম আকার নিয়েছে।’
দেরিতে হলেও, কোনও সন্দেহ নেই, সোনিয়া গান্ধীর এই বেনজির আক্রমণ বিরোধী শিবিরকে প্রাণিত করবে। এতদিন মূলত বাংলার জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই মোদির বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণ শানিয়ে এসেছেন। পরে তাঁরই সঙ্গে সংগত করতে বাধ্য হয়েছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল, হেমন্ত সোরেন, ডি কে শিবকুমার, এম কে স্ট্যালিন, উদ্ধব থ্যাকারে, আতিশী, তেজস্বী যাদব, অখিলেশ যাদব প্রমুখ। রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা ওয়াধেরা, মল্লিকার্জুন খাড়্গে প্রমুখ কংগ্রেস নেতৃত্বও মোদির বিরোধিতা করেছেন নানা প্রসঙ্গে। কিন্তু সেগুলির মধ্যে প্রকট হয়েছে বিরোধী ঐক্যের বার্তায় খামতি। রাজনৈতিক মহল বরং এটাই লক্ষ করেছে যে, বিশেষ করে বাংলার ক্ষেত্রে, স্থানীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের কিছু রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার প্রতি হাইকমান্ডের আপসের অলিখিত সিলমোহর পড়েছে। সব মিলিয়ে বিরোধীদের মহাজোট ‘ইন্ডিয়া’কে ‘মহাঘোঁট’ হিসেবে তাচ্ছিল্য করার অবকাশ বেড়েছে গেরুয়া শিবিরের। গণতন্ত্র এবং সংবিধানের উপর আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধিতে মোদির প্রশাসন এতটা বেপরোয়া হতে পেরেছে এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে। দেরিতে হলেও ঘুরে দাঁড়াবার বার্তা দিয়েছে কংগ্রেস, জাতীয় রাজনীতিতে সোনিয়া গান্ধীর গ্রহণযোগ্যতাকে পাথেয় করে। কোনও সংশয় নেই, তাদের এই কৌশল রাজনৈতিক মহলের প্রশংসা পাবে এবং একইসঙ্গে আশ্বস্ত হবে বহির্বঙ্গের দিশেহারা পদ্ম-বিরোধীরা। মোদিরাও সেটা বিলক্ষণ জানেন। তাই বিভাজনের রাজনীতির ধার আরও সূক্ষ্ম করে তোলার মরিয়া প্রয়াসে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেস দল এবং তাদের ইস্তাহারের একটা ‘বদনাম’ দিয়েছেন। ‘রামরাজ্যের’ নির্বাচনী জনসভা থেকে মোদি কংগ্রসের সঙ্গে তুলনা টেনেছেন পাকিস্তানের দাবিদার মুসলিম লিগের। তিনি ওইসঙ্গে দাবি করেছেন, কংগ্রেসের ইস্তাহারে রয়েছে লিগের ছাপ! যদিও প্রধানমন্ত্রী বিস্মৃত হয়েছেন তাঁরই দলের প্রতিষ্ঠাতা-পুরুষ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে লিগের বিশেষ হৃদ্যসম্পর্কের সত্যটি!