সফল অভিযান। উত্তরকাশীর মরণফাঁদের অতল থেকে অবশেষে উদ্ধার করা গিয়েছে ৪১ জনকেই। সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায়। মঙ্গলবার রাতে অবসান হয়েছে টানা ১৭ দিনের এক রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের। শুধু ওই শ্রমিকরা এবং তাঁদের পরিবারগুলিই নয়, হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে সারা ভারতও। ওইসঙ্গে চিক চিক করে উঠেছে দু’চোখের কোণ এবং মুখে ফুটেছে হাসি। এরপর ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন, কাকে বলে আনন্দাশ্রু এবং শেষ হাসি। শেষ হাসি চওড়া হওয়াই কাম্য। সারা দেশ একসঙ্গে এমন চওড়া হাসি এর আগে কবে হেসেছে, তা বলা মুশকিল। এই জয় শুধু উদ্ধাকারী দল বা সরকারের নয়, সমগ্র শ্রমিক শ্রেণির, মানুষের ও মানবিকতার। এই জয় ভারতের এবং সারা পৃথিবীরও। কারণ টানেল বিপর্যের ইতিহাস প্রাচীন। আমেরিকা, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, ডেনমার্ক, ইতালি, রাশিয়া, আজারবাইজান, জাপান, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশকেও এমন বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ওইসব বিপর্যয়ে বস্তুত কোনও দেশই প্রাণহানি এড়াতে পারেনি। বহু মানুষের প্রাণের বিনিময়েই ‘সাফল্য’ পেয়েছে তারা। সেখানে ভারতে উত্তরকাশীর উদ্ধার অভিযান হল একটি চূড়ান্ত সাফল্যের দৃষ্টান্ত। পূর্বোক্ত ঘটনাগুলির সাফল্য, এমনকী ব্যর্থতার পাঠ থেকেও শিক্ষা নেওয়া হয়েছে নিশ্চয়। উত্তরকাশীর ঘটনায় সহায়তা নেওয়া হয়েছে দেশ-বিদেশের বহু সংস্থা ও বিশেষজ্ঞের। গোড়ার দিকে একের পর এক ব্যর্থতা আমাদের সকলের মন ভেঙে দিয়েছে।
তবে আটক শ্রমিকসহ সকলেরই মনোবল ছিল অটুট। তার ফলে নতুন নতুন পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া গিয়েছে এবং একটু দেরিতে হলেও মিলেছে চূড়ান্ত সাফল্য। এর কৃতিত্ব সংশ্লিষ্ট সকলের, এমনকী প্রথম দিকের একাধিক পর্বে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেও যাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন তাঁদেরও। ভূতাত্ত্বিকদের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে, হিমালয় অঞ্চলের শিলা অত্যন্ত ভঙ্গুর। সেটা কতক্ষণ একস্থানে স্থির থাকে বলা মুশকিল। ফলে অঞ্চলটি এমনই এক ভয়াবহ সমস্যায় প্রতিনিয়ত জর্জরিত। অতএব সিল্কিয়ারায় যে বিপদটি ঘটেছে সেটি নতুন নয়। এই ধরনের ভূখণ্ডে রাস্তা বা সুড়ঙ্গ নির্মাণের সময়, বিপর্যয়ের পর বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতা হতেই থাকে। ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটির অধীনে দেশজুড়ে ২৯টি বড় টানেল নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে রয়েছে হিমাচল প্রদেশে ১২টি, জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলে ছয়টি এবং বাকি ১১টি তৈরি হচ্ছে উত্তরাখণ্ড-সহ অন্য একাধিক রাজ্যে। সিল্কিয়ারার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার আরও সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। এই সমস্ত বিপজ্জনক জায়গায় টানেল বা সুড়ঙ্গ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণের আগে ‘প্রপার সাইট ইনসপেকশন’ খুবই জরুরি। শিলার গঠন কেমন, পাহাড়ি এলাকায় নির্মাণের আগে সেটা বুঝে নিতে প্রাইমারি স্টাডি করা উচিত বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। উত্তরকাশীর প্রকল্পে ইতিমধ্যেই বিরাট গাফলতি চিহ্নিত হয়েছে—তিন কিমির অধিক দৈর্ঘ্যের সুড়ঙ্গ নির্মাণের ক্ষেত্রে বিকল্প এক বা একাধিক রাস্তা প্রস্তুত রাখতে হয়, যাতে বিপৎকালে শ্রমিকরা নিরাপদ স্থানে চটজলদি সরে যেতে পারেন। নির্মাণ-পরবর্তী জরুরিকালেও এই ধরনের রাস্তার উপযোগিতা রয়ে যায়। এই প্রকল্পের নকশায় এমন রাস্তা রাখতে বলা হলেও বাস্তবে তা উপেক্ষা করা হয়েছে বলে অভিযোগ। উদ্ধার কাজ এজন্যই জটিলতর হয়ে উঠেছিল কি?
ভবিষ্যতের এমন প্রতিটি প্রকল্প যেন যাবতীয় গাফিলতি মুক্ত ভাবেই তৈরি হয়, সেই অঙ্গীকার থাকা দরকার। সুড়ঙ্গে দীর্ঘকাল আটকে পড়া ব্যক্তিদের কারও কারও মধ্যে হাইপোক্সিয়ার (টিস্যু পর্যন্ত অক্সিজেন সরবরাহে ঘাটতি) সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ক্লস্টোফোবিয়ার লক্ষণও প্রকট হতে পারে অদূর ভবিষ্যতে। তাই উদ্ধার-পরবর্তী-জীবনে কাউন্সেলিংয়ের উপর জোর দিয়েছে ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রিক সোসাইটি। ঘরে ফেরার পর প্রত্যেক শ্রমিক যেন যথাসম্ভব দ্রুত স্বাভাবিক হতে পারেন, সেই চেষ্টাই করতে হবে। এই পুরো দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র যেন কোনওভাবেই দায়সারা মনোভাবের পরিচয় না দেয়। উত্তরকাশীর বিপর্যের কারণও দ্রুত খুঁজে বের করে ভবিষ্যতের জন্য পাঠ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে এই ঘটনার পিছনে কারও গাফিলতি বা অপদার্থতা চিহ্নিত হলে। সামনেই লোকসভার নির্বাচন। তাই, ভয় হয় এই ‘সাফল্য’ যেন ভোটের বাজারে ‘পণ্য’ না হয়ে ওঠে কোনওভাবেই। সেটা শুধু কুরুচিকর নয়, অমানবিক ব্যাপারও হবে। তার চেয়ে সেটাই ভাবুক রাষ্ট্র—এই ধরনের উন্নয়ন যজ্ঞে নিযুক্ত শ্রমিক এবং তাঁদের পরিবারের জন্য আরও কতটা আর্থিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যায়। এই ধারণা উন্নয়ন চিন্তারই একটি উল্লেখযোগ্য পাঠ।