শুরুর প্রামাণ্য নথি না পাওয়া গেলেও সম্ভবত মোঘল আমল থেকেই ধনী পরিবারগুলিতে দুর্গাপুজো করা হত। খুব সম্ভবত ১৫ শতকের শেষদিকে মালদহের এক জমিদার স্বপ্নাদেশ প্রাপ্তির পর প্রথম পারিবারিক দুর্গাপুজো শুরু করেন। ১৬১০ সালে যখন সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের পুজো শুরু হয়, কলকাতা ঠিক করে গড়ে ওঠেনি। ১৭৭০ সালে হুগলির গুপ্তিপাড়ায় দুর্গাপুজো শুরু হয় ১২ জন বন্ধু মিলে, যা ‘বারো-ইয়ারি’র পুজো নামেও আখ্যায়িত। এই ‘বারো-ইয়ারি’ কথাটি থেকেই বারোয়ারি কথাটির উদ্ভব। কাশিমবাজারের রাজা হরিনাথ দে ১৮২৪ থেকে ১৮৩১ পর্যন্ত তাঁর জন্মস্থান মুর্শিদাবাদে পুজো করতেন। ১৮৩২ সাল থেকে কলকাতায় প্রথম বারোয়ারি পুজো শুরু হয়। ব্রিটিশরা ১৭৬৫ সালে পুজোর উদ্যোগে সহায়তা শুরু করে হিন্দু প্রজাদের মন পাওয়ার জন্য, যা ১৮৪০ পর্যন্ত চালু ছিল।
পৌরাণিক কাহিনী থেকে দুর্গাপুজোর সূত্রপাত। কিন্তু ক্রমে দেবত্বের প্রাকার ভেঙে দুর্গা হয়ে উঠেছেন আমাদের ঘরের মেয়ে। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনই তাঁর লক্ষ্য। যেন পাশের বাড়ির সাধারণ মেয়ে, তবে দাপুটে। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের মধ্য দিয়ে ধর্ম, ভাষা নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণে বারোয়ারি পুজোর সর্বজনীন এবং ক্রমশ বিশ্বজনীন হয়ে ওঠা। ভক্তিকে অতিক্রম করে আনন্দযাপন। এই পুজো ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। কত মানুষের জীবিকার সংস্থান, কত কত অনুসারি শিল্পের অপেক্ষার অবসান! কত মানুষের উদ্যাপনের অবসর। প্রতিমা শিল্পী, প্যান্ডেল, থিম, ভাবুক, ঢাকি, ছোট দোকানদার, রেঁস্তরা, অস্থায়ী দোকান, জামাকাপড়, জুতো, শারদ সংকলন, গানের রেকর্ড, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক ও অন্যান্য বিনোদন ঘিরে রেখেছে এই পুজোকে। দুর্গাপুজোর মূল আকর্ষণ হল দেবী দুর্গার প্রতিমা। উৎসবের সময় পুজো, আরতি এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সংগীত, নৃত্য, নাটকও অনুষ্ঠিত হয়। এবং ক্রমশ ‘পুজো’ থেকে ‘শারদ উৎসবে’ রূপান্তর ।
প্রাচীন ভারতীয় সমাজে যেখানে মা দুর্গাকে শক্তি ও সুরক্ষার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। মধ্যযুগে, বিশেষ করে বাংলায় দুর্গাপুজো একটি বৃহত্তর মাত্রা পায়। রাজা-মহারাজারা এই পুজোর আয়োজন করতে শুরু করেন। এতে সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গও যুক্ত হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে দুর্গাপুজো শহুরে পরিবেশে জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রতিমা নির্মাণ ও সাজসজ্জায় নতুনত্ব আসে। বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক উন্মোচিত হয়। বর্তমানে দুর্গাপুজো আন্তর্জাতিক। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। দুর্গাপুজোর বিবর্তন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত হয়েছে। প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে এই উৎসবের বিভিন্ন দিক পরিবর্তিত হয়েছে। মানুষের দৈনন্দিন বেঁচে থাকা, রুটিরুজির লড়াই, পাওয়া না পাওয়ার বেদনা, আর্থসামাজিক সমস্যা, সামাজিক অসাম্য, বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে আমরা সমস্ত কিছু ভুলে পুজোর ক’টা দিন আনন্দে থাকতে চাই । সঞ্চয় করতে চাই সারা বছর ভালো থাকার রসদ। তাই তো মনে হয়, মায়ের কাছে সন্ধ্যাতারা আছে।