আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষেরা মনে করতেন, এই দুনিয়ায় মানুষ জন্মায় তিনরকম উত্তরাধিকার বা ঋণ নিয়ে। পিতৃঋণ, দেবঋণ আর ঋষিঋণ।
১) পিতার বা পূর্বপুরুষের শরীরের উত্তরাধিকার বা পিতৃঋণ। একে আমরা পিতৃ-মাতৃ ঋণও বলতে পারি। আমাদের পিতামাতাকে আমরা আমাদের শরীরে বহন করি। পিতার ঔরস ও মায়ের গর্ভজাত আমরা, মায়ের শরীরেরই অংশে আমাদের অস্তিত্ব। কেবল কি আমাদের মাতাপিতা, তস্য মাতা ও পিতাসহ পূর্বপুরুষের শরীরের উত্তরাধিকার আমাদের শরীরে? এমনকী প্রথম মানব বা মানবীর রক্তও কি আমরা বহন করি না?
২) সমাজের বস্তুগত উৎপাদনের উত্তরাধিকারকে বলে দেবঋণ। বস্তুগত উৎপাদন কী? প্রাচীনকাল থেকে আমাদের পূর্বতন প্রজন্ম সমাজে যা বানিয়ে রেখেছে, আগুন আবিষ্কার থেকে তার সংরক্ষণ বা চাকা বা কৃষিকাজ এবং তার ধারাবাহিকতায় আজকের কম্পিউটার থেকে স্মার্টফোন পর্যন্ত, সবই সমাজের বস্তুগত উৎপাদন এবং নিশ্চিতভাবেই আমরা তার উত্তরাধিকার বহন করি।
৩) ঋষিঋণ হল এ-যাবৎ সমাজের অর্জিত জ্ঞানের উত্তরাধিকার। প্রাচীনকাল থেকে অর্জিত জ্ঞান বা সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারও আমরা বা আমাদের সমাজ বহন করে চলেছে। অবাঙমানসগোচর বা অপৌরুষেয় আকাশবাণী হিসেবে বেদ-এর স্তোত্রসমূহ চিহ্নিত হলেও, তা যে আসলে প্রাচীনতম শ্রুতি সাহিত্য, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আজ যে-কবি সার্থক কাব্য রচনা করছেন কাগজ বা ওয়ার্ড ফাইলের সাদা পাতায়, তিনিও সেই ‘দৈব আকাশবাণী’র ঋণ বহন করে চলেছেন। সান্ধ্যভাষায় রচিত চর্যাপদের সিদ্ধকবির উত্তরাধিকার যেমন বহন করেন, কৃত্তিবাস-কাশীরাম থেকে ভারতচন্দ্র হয়ে মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ, শক্তি-সুনীল-শঙ্খকে বহন করেন। উস্তাদ সাবির খাঁয়ের দশ আঙুল যখন নাচে বাঁয়ে-ডানে তবলার উপর, তখন ওই আঙুল কেবল উস্তাদ সাবির খানের নয়, তাঁর পিতা কারামাতুল্লা খাঁয়ের স্পর্শও মিশে যায় ওই আঙুল-নৃত্যে! কেবল পিতা কেন, পিতামহ মাসিৎ খাঁয়ের মাসিতখানি গৎ-ও মিলেমিশে যায় ওই তবলা লহরায়। কেন তিন পুরুষ, তেত্রিশ প্রজন্মের তামাম ফারুকাবাদ ঘরানাই সম্পৃক্ত থাকে না কি ওই গৎ-এ? ষোলোমাত্রায়? কেবল তবলা কেন, উস্তাদ পরভিন সুলতানার আলাপেও কি নীরবে থেকে যান না তাঁর চাচু উস্তাদ কারামাতুল্লাহ খাঁয়ের লয়কারী? এ হল পরম্পরা। শিল্পের পরম্পরা। অহর্নিশ জ্বলে থাকা বাতি। অনির্বাণ দীপশিখা। মেসিও যখন ঈষৎ তেরছা ভঙ্গিতে বাঁ-পায়ের কারুকাজ করেন সবুজ ঘাসে, সেই রঙ্গোলিতে কি মিশে থাকেন না দিয়েগো? মেসি কি বহন করেন না দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনার ব্যাটন? পরম্পরার ব্যাটন? তামাম দুনিয়া এইভাবেই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বহন করে এগিয়ে নিয়ে চলেছে সভ্যতার মালগাড়ি।
বিশ্বের প্রায় সব মানুষ, কোনও ধর্মশিক্ষা না নিয়েই, স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সংস্কার বশে এই তিন ঋণ শোধ করেন। উত্তরাধিকারের জন্ম দিয়ে আমরা শোধ করি পিতৃঋণ। কোনও না কোনও সামাজিক উৎপাদন বা কর্মে যোগ দিয়ে শোধ করি দেবঋণ আর সাংস্কৃতিক কর্মে লিপ্ত হয়ে জ্ঞানপ্রবাহকে সচল রেখে শোধ করি ঋষিঋণ।
জলদান দ্বারা পিতৃপুরুষের বা পিতৃলোকের তৃপ্তিসাধনের নামই ‘তর্পণ’। সকল বিশ্ববাসীই কোনও না কোনওভাবে এটি পালন করেন। জীবনানন্দের ভাষায় বলতে পারি, মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়; সেই অনন্ত বহমান মানবধারাকে সজীব রাখার অঙ্গীকারই ‘তর্পণ’। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর মতো অভিধানকার ও ভাষাবিদদের ভাবনা থেকে তর্পণের এমনই ব্যাখ্যা মেলে।
তর্পণ-অনুষ্ঠান একটি প্রতীকী শপথ অনুষ্ঠান ঠিকই; তবে একদিনের এই প্রতীকী আচরণ শুধুই সূচনামাত্র বা শপথ গ্রহণ করার মাহেন্দ্রক্ষণ। এর আসল তাৎপর্য বাকি ৩৬৪ দিনের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত এই উত্তরপুরুষদের ঋণ পরিশোধের কাজগুলি ক্রমান্বয়ে সম্পন্ন করতে হয় পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে নিবেদিত প্রতিনিয়ত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। এই ৩৬৪ দিনের কাজই আসল তর্পণ।
ঠিক এই ব্যাখ্যা মাথায় রেখে, তাঁর দ্বিশতবর্ষের জন্মজয়ন্তীতে আমরা দেখব, মাইকেল মধুসূদন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কীভাবে বহন করছেন পূর্বজদের উত্তরাধিকার এবং তাঁর বৈপ্লবিক কাব্যচর্চার মাধ্যমে মেটাচ্ছেন ঋষিঋণ। ঋণশোধের এই কর্মকাণ্ড কেবল রুটিন অনুসরণ নয়, ঐতিহ্যের অনুকরণ নয়, ইতিহাসকে অহেতুক বয়ে বেড়ানোও নয়, এই কাজ উল্লম্ফনও বটে। ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে মাথায় রেখে তাকে অতিক্রম করাই প্রকৃত শিল্পীর কাজ। পূর্বপুরুষের সম্পূর্ণ বিপরীত শিল্পচর্চা করা মানেও তাকে অগ্রাহ্য করা নয়, তাকে বহন করা। কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাস, চণ্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল তিনি মায়ের কাছে পড়েছেন। এইসব কাব্যের বিস্তৃত অংশ আবৃত্তি করে শৈশবে তিনি অন্দরে মহিলামহলকে অবাক করে দিতেন, পুত্রগর্বে গরবিনী মা জাহ্নবী আকুল হতেন আনন্দে। মাদ্রাজ প্রবাসেও মধুসূদন যাঁদের জন্য আকুলতা প্রকাশ করেছেন তাঁরা হলেন কৃত্তিবাস ও কাশীরাম। আমরা দেখেছি, প্রাণের বন্ধু গৌরদাস বসাককে চিঠি লিখে সেইসব পুস্তক পাঠাতে আর্জি করছেন। মধুসূদন জীবনীকার সুরেশচন্দ্র মৈত্র বলছেন, কৃত্তিবাস, কাশীরাম, ভারতচন্দ্রের প্রতিদ্বন্দ্বী কাব্য তৈরি করলেন, কিন্তু এঁদের প্রতিকূল হননি। কারণ তাঁদের সকলের কূল যে একটিই— বাংলার কূল। মেঘনাদবধ কাব্যে রাম রাবণ, লক্ষ্মণ, ইন্দ্রজিতের পরিচিত ছককেই তিনি শুধু সাহসের সঙ্গে উল্টে দিলেন না, সেই কাব্য লিখলেন ছক ভাঙা অমিত্রাক্ষরে। বিপুল উল্লম্ফনে অতিক্রম করলেন পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য। বাংলা কবিতাকে শীর্ষে তুলে পরবর্তী কবিদের হাতে তুলে দিয়ে গেলেন উত্তরাধিকারের ব্যাটন।
সুরেশচন্দ্র মৈত্র আরও লক্ষ করছেন, কপোতাক্ষ নদ, তার দুই তীর, তীরের বটগাছ, ভাঙা শিবমন্দির, সায়ংকালের তারা— এরা সব মধুসূদনের শৈশবের শিশুশিক্ষার আদি বর্ণমালা। আর অজস্র পাখির কাকলি, বাতাসের সশব্দ, নির্জনতার আবেশ —তাঁর শৈশবের সঙ্গীতশিক্ষার প্রথম স্বরলিপি। এই স্নিগ্ধ সজল শ্যাম দেশভূমি তাঁর মনোরাজ্যকে সবুজ আর সিক্ততায় আর্দ্র করে রেখেছে চিরদিন —দুঃখ তাঁকে রুক্ষ করেনি, দুর্দিন তাঁকে করেনি কর্কশ ও পাণ্ডুর। বিশ্ববীক্ষার কারণেই কেবল বাল্মীকি বা কৃত্তিবাসের পাশাপাশি তাঁর অমর কীর্তি মেঘনাদবধ কাব্যে ছায়া ফেললেন হোমার, ভার্জিল, দান্তে, তাসোঁ, মিলটন প্রমুখ। কেবল দেশের কেন, তামাম দুনিয়ার কবিতার উত্তরাধিকারও যে তিনি বহন করেন! বিলেতের ব্ল্যাঙ্ক ভার্স এসে মিশে গেল বাংলার ছন্দে। মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর খাঁটি মহাকাব্যের অমিত্রাক্ষর। অন্ত্যমিলকে সম্পূর্ণ তুচ্ছ ও গৌরবহীন করে তোলাই এই ছন্দের মূল বৈশিষ্ট্য। মধুসূদনের লক্ষ্য ছিল এর যতি-বিন্যাস ও গতিময়তা। এই ছন্দে অন্ত্যমিলের জুটল না স্থান, পয়ার হল প্রবহমান, নদীর মতো। চরণের সীমা পেরিয়ে দুর্দান্ত ঘোড়ার মতো তীব্র গতিবেগে সে যখন ছুটে চলল, বাঙালি বুঝে গেল মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীরা আর ততটা শক্তিশালী নন, তাঁরা হাঁফিয়ে উঠেছেন। রামায়ণ-মহাভারতের মন্থর পাঁচালির একঘেয়ে সুর শেষ হয়ে গিয়েছে, বৈষ্ণব কাব্যের কীর্তন রসও স্তিমিত— এখন নতুন যুগে কাব্যের ভাষা বা ভঙ্গিমা সবই নির্মাণ হবে নতুন আঙ্গিকে।
নতুন নির্মাণ না করে উপায় কী? জগৎ-সংসার এবং সময় বদলে গিয়েছে আমূল, কিন্তু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তার কোনও প্রতিফলন নেই। অনুসরণ করার মতো, কাব্য-সাহিত্যে তাঁর সামনে যিনি আছেন সেই ভারতচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর সময়ের তফাত প্রায় এক শতাব্দীর। রায়গুণাকর মারা যাচ্ছেন ১৭৬০ সনে, তারও প্রায় চৌষট্টি বছর পরে জন্ম হচ্ছে মধুসূদনের। ঈশ্বর গুপ্ত যতবড় সাংবাদিক, কবি হিসেবে ততটা নন। তাঁকে অনুসরণ করার প্রশ্ন নেই। ফলত বহু যুগের ওপার থেকে ভারতচন্দ্রকে কিঞ্চিৎ শিরোধার্য করলেন বটে, কিন্তু সময়কে ছুঁতে প্রকরণটি নিলেন বিদেশ থেকে। না নিয়ে উপায় নেই! শূন্য ময়দানে একা মধুসূদন খেয়াল করলেন বাংলাকাব্যের আগুনটিই চুরি হয়ে গিয়েছে! প্রমিথিউজের মতো তিনি সেই আগুন ফের নিয়ে এলেন বাংলা সাহিত্যের প্রাঙ্গণে। প্রদীপ জ্বালিয়ে ভাসিয়ে দিলেন উত্তরপুরুষের দিকে। মাইকেল স্বয়ং সেই দীপশিখা। আমাদের প্রমিথিউজ।
১৮৬০ সালে কোচবিহারের রাজ প্রশাসনে ম্যাজিস্ট্রেট পদে চাকরির আবেদন করেছিলেন মধুসূদন। মহারাজা নরেন্দ্রনারায়ণের আমলে রাজ প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগের বিজ্ঞাপন প্রকাশ হয় ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকায়। ওই বিজ্ঞাপন দেখেই মাইকেল চাকরির আবেদন করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কোচবিহারের মহারাজার পরিচয় ছিল। তিনি সুপারিশ করেছিলেন মাইকেলের নাম। সেখানে মধুসূদনের অকুণ্ঠ প্রশংসা করে তিনি লিখেছিলেন, ‘একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পাঠাইলাম, দেখিও যেন বাতাসে উড়িয়া না যায়।’ যথার্থ কি বলেননি বিদ্যাসাগর, সৃষ্টিতে, এমনকী জীবনেও, মাইকেল কি সত্যিই এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নন!
জীবনীকার সুরেশচন্দ্র মনে করছেন, এই নতুন লেখার বিপুল সাফল্য শুধুই সাহিত্যের প্রকরণের বিষয় ছিল না। ছিল নতুন সময়ের আবেগকে ছোঁয়ার প্রশ্ন। সদ্য মহাবিদ্রোহ হয়ে গিয়েছে, আদিবাসী ও কৃষকদের বিদ্রোহ আছড়ে পড়ছে পরপর কোম্পানির শাসনের ওপর। ইংরেজ বিরোধী এই ক্ষোভের প্রেক্ষাপটেই রাম -রাবণ সম্পর্কের নতুন বিন্যাস পাঠককে স্পর্শ করল। রাবণ হয়ে দাঁড়ালেন দেশরক্ষাকারী নায়ক। মেঘনাদ ইন্দ্রজিৎ দেশরক্ষার সেই লড়াইয়েরই প্রধান সেনাপতি। অন্যদিকে রাম-লক্ষ্মণ পরদেশ আক্রমণকারী, ইংরেজদের মতোই! উনিশ শতক যেমন প্রতিবাদের যুগ, তেমনই জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার যুগও বটে। ইউরোপীয় আদর্শকে বরণ তিনি করেছিলেন বটে, কিন্তু বাঙালি জীবন ও বাংলাই সংস্কারকে ত্যাগ করতে পারেননি। বিশ্বপথিক হয়ে ভুলে যাননি স্বদেশ। সীতায় জয়ী হয়েছে ভারতীয় সংস্কার। প্রমীলাও যেন বাংলার কন্যা। একদিকে তাঁর উগ্র নারীমহিমা, অন্যদিকে বাঙালি গৃহবধূর স্নিগ্ধতা। এমনকী ঘরশত্রু রাজ্যলোভী বিভীষণ, লোভে যিনি বিসর্জন দিয়েছেন মনুষ্যত্ব, যাঁর চক্রান্তে নিহত হলেন মেঘনাদ, তিনিও মৃত্যুপথযাত্রী ভ্রাতুষ্পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। এইজন্যই সমালোচকরাও বলেন, হোমার-মিলটন মাইকেল হতে পারেননি, বাঙালি হয়ে রয়ে গিয়েছেন। আসলে তিনি বাঙালিই হতে চেয়েছিলেন। নিখাদ এক বাঙালি কবি। ঢাকা সফরে গিয়ে বলেছিলেন, আমি কেবল বাঙালি নই, বাঙাল, যশোরের বাঙাল! স্বপ্নে কুললক্ষ্মীর আদেশ পেয়ে পর-ধনের লোভ ছেড়ে তিনি আবিষ্কার করলেন ‘মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে।’
কেবল সৃষ্টিতে নয়, নিজের জীবনেও তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ বিপ্লবী। আইকোনোক্লাস্ট। নিজের অস্তিত্ব ক্রমাগত বিপন্ন করে ‘সাপলুডো খেলেছেন বিধাতা’র সঙ্গে, আজীবন। মধুসূদন বলতে আমরা প্রথমেই বুঝি হিন্দুধর্ম ছেড়ে যিনি ছাত্রাবস্থাতেই খ্রিস্টান হয়েছিলেন। পিতৃমাতৃদত্ত মধুসূদনের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন মাইকেল নাম। নিজের পারিবারিক ধর্ম পরিবর্তন করে তিনি ‘বিধর্মী’ হয়েছিলেন বটে, কিন্তু ধর্ম তাঁর কাছে ছিল গৌণ বিষয়। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার তাঁকে ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করার আহ্বান জানালে তিনি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ধর্ম তাঁর বিষয় নয়। খ্রিস্টান হয়েছিলেন বটে কিন্তু দ্বিতীয়বার চার্চে কখনও যাননি। ধর্ম তাঁর কাছে একটাই, মানবধর্ম। বলেছিলেন, ‘খ্রিস্ট ধর্ম জগতে সভ্যতা প্রচারের একটি বিশেষ উপায়। কেউ এর বিরুদ্ধে বললে আমি তাঁর সঙ্গে ধর্মযুদ্ধে রাজি আছি। কিন্তু আমার মানসিক প্রবণতা হিন্দুধর্মেরই দিকে।’ কাব্যে ভারতীয় হিন্দুপুরাণ ব্যবহার করেছেন অকাতরে, যদিও ধর্মকথা হিসেবে নয়, সাহিত্য হিসেবে। মৃত্যুশয্যায় যখন প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালে পড়ে আছেন, তাঁকে শেষ দেখা দেখতে এসে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন ও চন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর শেষকৃত্য ও সমাধি নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। মৃত্যুপথযাত্রী মধুসূদন হেলায় উত্তর দিয়েছিলেন, ‘মনুষ্যসৃষ্ট গির্জার আমি ধার ধারি না, ব্যক্তিবিশেষের দাক্ষিণ্যও আমি চাই না। আমি আমার স্রষ্টার কাছে ফিরে যাচ্ছি। আপনারা যেখানে খুশি আমাকে সমাধিস্থ করতে পারেন, আপনাদের দরজার সামনে অথবা গাছতলায়।’
ধর্মান্ধ এই পৃথিবীতে, মাইকেল মধুসূদন তাঁর সৃষ্টির পাশাপাশি, দু’শো বছর আগে, আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন এই অনাধ্যাত্মিক মানবিক মূল্যবোধের উত্তরাধিকার, আমরা কি তা আজ বহন করতে পারছি? তাঁর বৈপ্লবিক সৃষ্টি ও চারিত্রিক দৃঢ়তার উত্তরাধিকার যদি বহন করতে না পারি, কীভাবে হবে কবির সার্থক তর্পণ!