মহালয়া। পিতৃপক্ষের শেষ। দেবীপক্ষের আরম্ভ পরের দিন থেকে। দেবীপক্ষ শুক্লপক্ষ। কোজাগরী পূর্ণিমায় এই পক্ষ শেষ। পুরো পক্ষ জুড়ে চাঁদ বড় হবে। আলোকিত হবে মহাপৃথিবী। মহাশ্বেতার মুখ ঝলমল করবে। আমি মহাজাগতিক এক তর্পণের কথা বলছি। তর্পণ হল স্মরণ করা। আমি স্মরণ করছি যাঁকে তিনিও এক দেবী। আমাদের এই সময় খুবই আঁধারময়ী। আমি কি মহাশ্বেতা দেবীকে এই মুহূর্তে স্মরণ করতে পারি না? মহাশ্বেতা বিদ্যার দেবী। মহাশ্বেতাদি আমার জীবনের কয়েক বছর আলোকিত করেছিলেন। কিন্তু এইটা সত্য সারাজীবন আলোর প্রভা রয়েই গিয়েছে। নিজের জীবন দর্শন তৈরি হয়েছিল মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে মিশে।
১৯৭৭ সালে, আমি বছর ছাব্বিশের যুবক। লিখতে শুরু করেছি কয়েক বছর আগে থেকে। অধুনা লুপ্ত অমৃত পত্রিকায় ‘গাঁওবুড়ো’ গল্প পড়ে তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, শ্যামল রায় নামে এক প্রাক্তন বিপ্লবী ও তাঁর অনুরাগীর মাধ্যমে। সেই শুরু মহাশ্বেতাকে চেনা। সেই চেনা এখনও শেষ হয়নি। তখন আমি চাকরি করি মেদিনীপুর জেলায়। এক গঞ্জে থাকি। গ্রামেগঞ্জে যেতে হয় অবিরত। মহাশ্বেতাদির ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাস তখন বই আকারে বেরিয়েছে। সাহিত্য অকাদেমি পায় ১৯৭৯ সালে। এ হল তার আগের কথা। জনৈক জ্যাকব মুন্ডাকে বইটি আমি পড়তে দিই বীরসা মুন্ডার জীবন কাহিনি জানার জন্য। জ্যাকব আর বইটি আমাকে ফেরত দেয়নি। তার সিঁদুরগৌরা গ্রামের অন্যরা বইটি পড়তে লাগল। মহাশ্বেতাদি আমাকে আর একটি বই দিলেন। সে যাই হোক। জ্যাকব মুন্ডারা নিকটবর্তী রোহিণী গ্রামে আদিবাসী সমাজের একটি সম্মেলন করল ১৯৮০ সাল নাগাদ, তখন আমি ওই জায়গা ছেড়ে চলে এসেছি। দীঘায় থাকি। জ্যাকব আমাকে চিঠি লিখল, দিদিকে চাই। মহাশ্বেতাদি এককথায় রাজি। আদিম জাতি ঐক্য
পরিষদের সভা হল। মহাশ্বেতাদির প্রথম আদিবাসী সংগঠন। মনে আছে, মহাশ্বেতাদি অনেককে নিয়ে রোহিণী যাত্রা করলেন। আমি পথ দেখাচ্ছি। খড়্গপুর পর্যন্ত ট্রেন, তারপর খড়্গপুর রোহিণী লজঝড়ে এক বাস। তার মাথায় মানুষ, ভিতরে ছাগল মুরগির সঙ্গে মানুষ। কুলটিকরি এলে তিনি বললেন, আমাদের সঙ্গে বাসের মাথায় উঠে চারপাশ দেখতে দেখতে যাবেন। সে ছিল আগস্ট মাস, শ্রাবণের শেষ। আকাশভরা মেঘ। বাস কন্ডাকটর রাজি হল না দিদিকে উঠতে দিতে। আমি, সব্যসাচী দেব, সাংবাদিক অরুণ শ্রীবাস্তব, হিন্দি জনবাদী কবি পবন কুমার, নির্মল ঘোষ ছিলাম তাঁর সঙ্গী। সেখানে মানে রোহিণী গ্রামে সারারাত মিটিং করে, পরদিন সকালে ডুলুং নদীতে সাঁতরে ফিরেছিলাম। অসম সাহসী এক লেখিকা, লিখেছেন মাটির পৃথিবীতে নেমে, মাটি আর মানুষের সম্পৃক্ত হয়ে। তিনি গজদন্তমিনারবাসী লেখক ছিলেন না। জীবন নিয়ে খেলা করেছেন। জীবনকে দেখেছিলেন গভীর মায়াভরা এক চোখ দিয়ে। কিন্তু সেই চোখে আগুনও ছিল। অন্যায় দেখলেই ফুঁসে উঠতেন, তাঁর গল্প, উপন্যাস এই আগুনের তাতে সেঁকা। মহাশ্বেতাদি নিয়ে কথা বলতে বসলে, সে কথা শেষ হয় না। যখন আমি দীঘায়, এক গ্রীষ্মে মহাশ্বেতাদি, নির্মল ঘোষ, নির্মলদার পুত্র দীঘায় এলেন। বিকেলে ঘুরছিলাম দীঘার রাস্তায়। রাস্তার ধারে এক ব্যক্তি আম নিয়ে বসেছিল বিক্রির জন্য। এক পুলিস সিপাই হাজির ব্যাগ নিয়ে। সে আম তুলেতুলে ব্যাগে ভরছিল। পাকা হিমসাগর। মহাশ্বেতাদি দেখতে পেয়েছেন। সিপাইয়ের পাশে নিরীহ মুখে দাঁড়িয়ে আছেন আম বিক্রেতা। সিপাই ব্যাগে অনেকগুলো আম ভরে যখন লিচুর কাছে যাচ্ছে, মহাশ্বেতাদি জিজ্ঞেস করলেন, দাম দিলে না? সিপাই অগ্রাহ্য করল তাঁর কথা। এগিয়ে যেতেই তিনি তার কব্জি ধরেছেন, এই থানায় চল।
সেই সিপাই তো অবাক। থানায়? কেন? সে নিজেই থানা থেকে আসছে, থানায় যাবে কেন? কেন আবার আম নিয়ে দাম দেয়নি তাই। দাম দেওয়া তার অভ্যেসে নেই, দেবে কেন? সে থানার লোক। মহাশ্বেতাদি তাকে বললেন, তোমাকে এবার হাজতে ভরব, গরিব লোকের ক’টা পয়সা মারছ, ফ্রিতে আম চাই তোমার? সে বুঝল যিনি তার হাত ধরেছেন, তিনি অত সহজ নন। সে প্রায় পায়ে পড়ে গেল তাঁর। ভিড় জমে গিয়েছে ততক্ষণে। এমন ঘটনা সচরাচর ঘটে না। কে উনি, কে উনি, কীভাবে ধরল ব্যাটাকে! ব্যাটাকে থানায় নিয়ে চলুন দিদি। সে আম তার ব্যাগ থেকে বের করে আমওয়ালার সামনে ঢেলে দিয়েছিল। এমনই ছিলেন তিনি।
আমি বাইরে থেকে কলকাতায় ফিরেই রবিবার দুপুরে তাঁর বালিগঞ্জ স্টেশন রোডের বাড়িতে হাজির হতাম। বাড়ি মানে ফ্ল্যাট। সেই ফ্ল্যাটে ওঠবার সিঁড়ি ছিল লোহার এবং ঘোরানো। পাক দেওয়া সিঁড়িই ছিল বিশেষত্ব। ছিল অনেক বেড়াল। অনেক বই। লেখার টেবিল। সাদা কাগজের নীচে কার্বন রেখে ডট পেনে লিখতেন কপি রাখার জন্য। আমাকে শুনিয়েছেন নতুন লেখা গল্প— বেহুলা, বিছন, দ্রৌপদী। হ্যাঁ, এই বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী আমি। আমিও শুনিয়েছি কয়েকটি গল্প। সে ছিল অপূর্ব সব দিন। মহাশ্বেতাদির বাড়ি যাওয়া ছিল উন্মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়া। কত রকম কথা হতো। আমি আমার অভিজ্ঞতার কথা বলতাম। চাকরি ছিল ভূমি সংস্কার দপ্তরে কানুনগোর। সেইসব গল্প শুনতে শুনতে তিনি এক উপন্যাস লিখলেন, ‘অক্লান্ত কৌরব’। সে উপন্যাস পড়তে গিয়ে দেখি এ তো আমি। বলতে হা হা হাসি। আমি এই বছরে একটি দীর্ঘ উপন্যাস লিখন প্রক্রিয়ায় আছি। এই উপমহাদেশ। েই উপন্যাসে মহাশ্বেতাদি স্বনামেই আছেন।
১৯৪৩-এর মন্বন্তরের কথা তৃপ্তি মিত্র ও তিনি দুর্ভিক্ষের কথা স্মরণ করছিলেন এক সকালে। আমি ছিলাম শ্রোতা। বিরল এক সকাল গেছে তা। তাঁরা কীভাবে ত্রাণের কাজ করেছিলেন, তা শোনালেন আমাকে। চিরকাল সামাজিক কাজে জড়িয়ে থাকতে চাইতেন। আদিবাসী সমাজে তিনি ছিলেন মারাং দাই। বড় মা। মারাং শব্দের অর্থ বড়। মারাং বুরু— বড় পাহাড়। মারাং দাইয়ের সঙ্গে বহরমপুরে তাঁর পিতা মণীশ ঘটকের মৃত্যুর পর গিয়েছিলাম রাতের লালগোলা প্যাসেঞ্জারে চেপে রাত জেগে কয়েকজনে গল্প করতে করতে। সেবার মুর্শিদাবাদ ঘুরেছিলাম। তিনি ইতিহাসের মূল সত্যকে খুঁজে বের করতে চাইতেন। সিপাই বিদ্রোহ, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন প্রথম জীবনে। উত্তরপ্রদেশের ওই অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা লোক-গল্প, রানিকে নিয়ে না-জানা কথা সংগ্রহ করতে খুব অল্প বয়সে ঝাঁসি গিয়েছিলেন টাকা ধার করে। কেল্লা থেকে শহরে ফেরার সময়ে টাঙ্গাওয়ালা তাঁর গলার হার ছিনতাই করতে গিয়েছিল। তিনি তার গলা টিপে ধরে চিৎকার করতে থাকেন, আশপাশের গ্রামের মানুষ ছুটে এসেছিল। এই কাহিনি তাঁর মুখে শুনেছিলাম। মহাশ্বেতাদির কথা প্রথম বড় করে শুনি ১৯৭২ সালে। তখন লিখি একটু-আধটু। শারদীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘হাজার চুরাশির মা’। পুত্র জেলখানায়, কিংবা পুলিসি এন কাউন্টারে মরেছে এমন কত মা তখন আমাদের পশ্চিমবাংলার ঘরে ঘরে। শুনেছি এই উপন্যাস উদ্দীপ্ত করেছিল বিপ্লবীদের। জেলখানায় পৌঁছে গিয়েছিল লেখাটি। এরপর পড়ি ‘অপারেশন বসাই টুডু’। সে আর এক আশ্চর্য নভেলেট। তারপর পড়ি ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘দ্রৌপদী’, ‘বেহুলা’, ‘শিশু’— এই সব উপন্যাস, গল্প। তাঁকে ঘুরে ঘুরে পড়া মানে তাঁর তর্পণই।
১৯৮১ সালের ৭ ডিসেম্বর, এক তরুণ লেখকের বিবাহের প্রীতিভোজ। সারাদিন যারা তাঁর কাছে এসেছে, তাঁদের বলেছেন, আজ অমুকের বিয়ের খাওয়াদাওয়া, চ,আমার সঙ্গে তোদেরও নেমন্তন্ন। সত্যিই তিনি এলেন, একটি ম্যাটাডোরে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে। বাকিরা সব পিছনে। এক ম্যাটাডোর মানুষ নিয়ে তিনি হাজির হয়ে বললেন, এসে গেছি!
হইহই লেগে গেল আনন্দ অনুষ্ঠানে। ভুলিনি এত বছরেও। ভুলব না বাকি দিনগুলিতেও। জীবনে এমন মানুষের সান্নিধ্যে আসা বিরল এক সৌভাগ্য।