সে এক সোনা ঝরা রবিবারের বইমেলার বিকাল। দুপুরের পর থেকেই ধীরে ধীরে জন অরণ্যে পরিণত হচ্ছে কলকাতা বইমেলা। বিশেষত বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থার স্টলগুলোর সামনে উপচে পড়ছে পাঠকদের ভিড়, বইকেনার জন্য। খ্যাতনামা লেখক-লেখিকাদের সামনে থেকে দেখার জন্য, তাঁদের সই সংগ্রহ করার জন্য। আমি তখন মাত্র কয়েক বছর হল লেখালিখি শুরু করেছি। আর সেই সুবাদে কয়েকজন প্রকাশক আগ্রহী হয়ে আমার কয়েকটি বই প্রকাশ করেছেন। সেদিন বিকালে একজন প্রকাশক তাঁদের স্টলে আমাকে উপস্থিত থাকতে বলেছিলেন সম্ভবত সৌজন্যের খাতিরে। কারণ নতুন লেখকের বই ক্রেতারা লাইন দিয়ে কিনবেন সে প্রত্যাশা নিশ্চয়ই প্রকাশকের ছিল না, আর আমার তো ছিলই না। আমি শুনেছিলাম যাঁদের লেখা পড়ে বড় হয়েছি, যাঁদের লেখা নিয়মিত পড়ি তেমন বেশকিছু কবি-সাহিত্যিকরাও থাকবেন। তাঁদের কাছ থেকে দেখার আশাতেই বলা চলে আমি সেদিন প্রকাশকের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে উপস্থিত হয়েছিলাম বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থার সেই স্টলে। তার বাইরে লেখকদের বসার জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা। কয়েকজন খ্যাতনামা লেখক বসেছিলেন সেখানে। তাঁরা বয়সে আমার থেকে প্রবীণ তো বটেই, আর পাঠকদের কাছে লেখার পরিচিতির ক্ষেত্রেও সেসময় আমার থেকে শত যোজন এগিয়ে। যে সব লেখক সেদিন সেখানে ছিলেন তাঁদের অনেকের সঙ্গেই লেখার জগতে থাকার কারণে এখন ব্যক্তিগত পরিচয় বা সম্পর্ক গড়ে উঠলেও সেদিন তাঁরা আমাকে কেউই চিনতেন না। স্টলের বাইরে বসে তাঁরা নিজেদের মধ্যে খোশ গল্প করছিলেন, পাঠক-পাঠিকাদের বইতে সই দিচ্ছিলেন। আমি তাঁদের থেকে সম্ভ্রমের দূরত্ব রেখে কয়েকটা চেয়ার তফাতে গিয়ে বসলাম। তাঁদের কথা শোনার চেষ্টা করতে লাগলাম, আর মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম স্টল থেকে বই কিনে যাঁরা বেরচ্ছেন তাঁদের কারও হাতে আমার বই আছে কি না। দু-একজনের হাতে আমার সদ্য প্রকাশিত বই দেখলাম বটে তবে তাঁরা কেউ আমার সই নিতে আসেননি। অনেকের অভ্যাস আছে নতুন বই প্রকাশিত হলেই তা কিনে পড়েন, তাঁরা তেমনই পাঠক হবেন হয় তো। সময় এগচ্ছে, বইমেলার ভিড় আরও বাড়ছে। হঠাৎ প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার এসে বললেন, ‘বুদ্ধদেব গুহ আসছেন।’
খেয়াল করলাম কথাটা শুনেই উপস্থিত লেখকদের মধ্যে মৃদু চাঞ্চল্য শুরু হল। কয়েকজন লেখক অন্য স্টলে যাবেন বলে উঠে চলে গেলেন। আর যাঁরা রইলেন তাঁরা যেন কেমন গম্ভীর হয়ে গেলেন। এর কারণটা অবশ্য আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম। আমি অবশ্য বসে রইলাম এক স্বপ্নের মানুষকে কাছ থেকে দেখব বলে। ঋজুদাকে দেখব বলে, কোয়েলের কাছে, মাধুকরীর স্রষ্টাকে দেখব বলে। এর আগে অবশ্য আমি তাঁকে দেখেছি বেশ কয়েকবার বইমেলার আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে অনেক দূর থেকে দর্শকাসনে বসে। তাই কয়েক হাত তফাত থেকে চির তরুণ, চির যুবক, বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্রকে দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি আমি। হ্যাঁ, তিনি এলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। পরনে সিল্কের পাঞ্জাবি, দুধ সাদা পা-জামা, কাঁধে কাজ করা পশমিনা শাল, হাতের সোনার ব্রেসলেট ঝিলিক দিচ্ছে বিকালের সূর্যালোকে, ঠিক তাঁর লেখার মতোই, কলমের মতোই। তাঁর হাঁটা-চলার মধ্যে এক অদ্ভুত আভিজাত্য। আমার পাশের চেয়ারটা ফাঁকা দেখেই সম্ভবত তিনি সেখানে বসলেন। আমি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়ে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিলাম, হয়তো বা একটু তফাতে সরে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু তিনি ইশারায় আমাকে থামিয়ে দিলেন। তিনি চেয়ারে বসতেই স্টলের সামনের জনকোলাহল মুহূর্তর জন্য যেন স্তব্ধ হয়ে গেল, আর তারপরই তা যেন সহস্রগুণ বেশি হয়ে ভেঙে পড়ল চারপাশে বার্ধক্য ছোঁয়া এক মানুষকে ঘিরে। না, কথাটা আমি ভুল বললাম। যাঁর কলম আর মনের যৌবন কোনওদিন ফুরায় না, ফুরায়নি বাংলা সাহিত্যের এমন এক চির যুবক সরস্বতী পুত্রকে ঘিরে! আর এরপরই ঠিক মৌমাছির মতো পাঠক-পাঠিকারা ঘিরে ধরল তাঁকে। কেউ বইতে স্বাক্ষর করাবার জন্য, কেউ বা তাঁর পা-ছুঁয়ে প্রণাম করার জন্য। কে নেই সেই ভিড়ের মধ্যে? দামি কোটপ্যান্ট পরা সাহেবি মানুষ থেকে শুরু করে গ্রাম-বাংলার সুদূর কোন প্রান্ত থেকে আসা মলিন পোশাক পরা কোনও পাঠক। হয়তো নতুন বই কেনার সামর্থ্য নেই তার, সাদা কাগজের টুকরো সে বাড়িয়ে দিচ্ছে তার প্রিয় লেখকের কালির আঁচড় সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। লেখকের সামনের মিছিলে হয়তো ‘কোজাগর’ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন প্রৌঢ় জননী, আর তাঁর পিছনেই ‘সবিনয় নিবেদন’ বুকে জড়িয়ে তাঁর অষ্টাদশী কন্যা। তাঁরা দু’জনেই একই রকম মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন সামনের মানুষটার দিকে। এমন ঘটনা আমি পরবর্তীকালেও বহুবার দেখেছি। ‘স্টারডম’ কথাটা লেখকদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা উচিত কি না জানি না। যদি হয় তবে তা বুদ্ধদেব গুহর ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রযোজ্য।
সেদিনের বিকালের গল্পটা এ পর্যন্ত বলেই শেষ করা যেত, কিন্তু করা গেল না লোকটার নাম বুদ্ধদেব গুহ বলে। সেই বিকালের পর থেকে তিনি আমার চোখে এক অন্যরকম মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন বলে, যাঁকে পিতৃতুল্য অগ্রজের মতো শ্রদ্ধা করা যায়, ভালোবাসা যায় বলে। এবার আসি সে ঘটনার কথায়। সই বিলোতে বিলোতে হঠাৎই তিনি আমার পরিচয় আর আমি সেখানে কেন বসে আছি তা জানতে চাইলেন। আমি নাম বলার পর বেশ কুণ্ঠিত লজ্জিতভাবেই জানালাম যে, এ প্রকাশনা সংস্থা থেকে আমার একটা বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি জানতে চাইলেন কোথায় কোথায় লিখছি, কোন কোন প্রকাশক আমার বই ছেপেছেন? আমি তাঁর প্রশ্নের জবাব দেবার পর তিনি এক অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। আমাকে দেখিয়ে আমার নাম জানিয়ে তাঁর সমবেত পাঠককুলকে বললেন, ‘ইনি নবীন লেখক, নতুন বই বেরিয়েছে, ওঁর বইও আপনারা কিনুন। শুধু আমার বই কিনলেই হবে? নতুন লেখকদের বই না কিনলে বুঝবেন কীভাবে যে তাঁরা এ সময়কে কীভাবে দেখছেন?’ তাঁর কথা তাঁর অনেক পাঠকের কাছেই বেদবাক্যর মতো ছিল। তাঁর কথা শুনে অনেকেই ছুটলেন স্টলের ভিতর আমার বই কিনে আনার জন্য। আমি তো লজ্জায় লাল। তিনি চাপাস্বরে আমাকে বললেন, ‘ঘাবড়াবেন না। আপনার যতক্ষণ না কুড়িটা বই বিক্রি হচ্ছে ততক্ষণ আমি আছি। কুড়িটা হলে বলবেন।’
এরপর বই আসতে শুরু হল আমার কাছে, আমিও সই দিতে শুরু করলাম। কিন্তু তখন যেন ঠিক আমি আমার মধ্যে নেই। মনে হচ্ছে ঈশ্বরের পাশে বসে তাঁর নির্দেশেই কাজ করে চলেছি আমি। ইতিমধ্যে অন্য প্রকাশকরা তাঁদের স্টলে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিতে এসেছেন। প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগল আমার কুড়িটা বই শেষ হতে। ততক্ষণ তিনি অন্য প্রকাশকদের আবেদনকে উপেক্ষা করে সেইখানেই বসে রইলেন! তারপর আমার পিঠে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে, আমাকে তাঁর পা স্পর্শ করার সুযোগ না দিয়ে পাঠক-প্রকাশকদের ভিড়ে পরিবৃত হয়ে হাঁটতে লাগলেন অন্যদিকে।
সময় বহমান। সেদিন বিকালে তাঁর পদ স্পর্শ করার সুযোগ না পেলেও আমি পরবর্তীতে তাঁকে প্রণাম জানাবার সুযোগ পেয়েছিলাম, এবং শেষ পর্যন্ত আলিঙ্গনেরও। ততদিনে অবশ্য তিনি আমার লালাদা হয়ে গিয়েছিলেন। সম্বোধনও আপনি থেকে তুমিতে। তাঁর সঙ্গে আমি চাঁদনি রাতে জঙ্গলে বেড়িয়েছি বা প্রতিদিন তাঁর সঙ্গে ফোনালাপ হতো একথা বললে সত্যের অপলাপ হবে। তবে তাঁর সঙ্গে অনেকবারই অনেক দুর্লভ মুহূর্তের সঙ্গী হয়েছি। মজার ব্যাপার হল সেইসব সময় তাঁর বা আমার লেখা সংক্রান্ত আলোচনা কমই হতো। আলোচনা হতো তাঁর প্রিয় মানুষ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, অর্নেস্ট হেমিংওয়েকে নিয়ে। কখনও বা পুরাতনী গান নিয়ে। বলা বাহুল্য অন্তরঙ্গ সেসব মুহূর্তে আমি শ্রোতার ভূমিকাই পালন করতাম। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম তাঁর কথা। খুঁজে পেতাম লেখক পরিচয়ের আড়ালে থাকা অন্য এক বুদ্ধদেব গুহকে— আমার লালাদাকে। ভাবনা ঐশ্বর্য, অগাধ পাণ্ডিত্য, সমুদ্রর মতো বিশাল হৃদয় তাঁর লেখক সত্তার থেকে কোনও অংশে কম ছিল না।
বুদ্ধদেব গুহর লেখা বহু আলোচিত, বন্দিত। তাই সে সব নিয়ে আমার মতো ক্ষুদ্র কলমচির আলোচনা পাঠকদের কাছে বহুশ্রুত মনে হতে পারে। তাই তাঁর এই স্মৃতি তর্পণে আমি খোঁজার চেষ্টা করছি অন্য এক বুদ্ধদেব গুহকে— লালাদাকে।
বুদ্ধদেব গুহ মানেই চারপাশের সব আলো নিজের দিকে টেনে নেওয়া এক মানুষ। অথবা বলা যেতে পারে চারপাশে আলো ছড়িয়ে দেওয়া এক মানুষ। তাঁর লেখনী, প্রগাঢ় ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ, অনন্য বাচনভঙ্গি, গানের গলা— সব মিলিয়ে-মিশিয়েই এ ব্যাপারটা সম্ভব হতো। কারণ তিনি তাঁর নিজের আলোতেই ভাস্বর ছিলেন। তাঁর সেন্স অব হিউমারও ছিল অসাধারণ। এ প্রসঙ্গে অনেক ঘটনার মধ্যে একটা ঘটনার কথা বলি। একটি বিশেষ প্রকাশনা সংস্থার প্রতি তাঁর টান বা ভালোবাসা ছিল। সে কথা তিনি আমাকে বহুবার বলেছেন এবং নিজের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিখেছেনও। কারণটা হল লালাদার কৈশোরে লেখা প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়েছিল ওই প্রকাশনার পত্রিকাতে। লালাদার প্রয়াণের বছর তিন-চার আগের ঘটনা। ওই প্রকাশনার শারদ পত্রিকা প্রকাশ উপলক্ষে তাঁদের বসতবাটিতে লেখক-লেখিকাদের একটা টি-পার্টিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই পার্টি সন্ধ্যায় মিটে যাবার পর লালাদা এবং তাঁর সঙ্গী হিসাবে রয়ে গিয়েছিলাম আমরা তিনজন লেখক। ফিশফ্রাই খেতে খুব ভালোবাসতেন লালাদা। বলাবাহুল্য লালাদাই বক্তা। এমন সময় সে ঘরে প্রবেশ করলেন গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রী। মার্জিত রুচিশীল দম্পতি। দু’জনেই প্রৌঢ়ত্বের সীমানা অতিক্রম করেছেন বহুদিন। তবে আমাদের মাতৃস্থানীয়া সেই মহিলাকে দেখলে বোঝা যায় তিনি একসময় অতীব সুন্দরী দেখতে ছিলেন। পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর লালাদা কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন। তারপর প্রথমে ভদ্রমহিলার উদ্দেশে বললেন, ‘আপনার মতো সুন্দরী মহিলার সঙ্গে আগে আমার দেখা হয়নি কেন?’ এ কথা বলে তিনি গৃহকর্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখা হয়নি ভালোই হয়েছে। দেখা হলে আমি আপনার সঙ্গে ডুয়েলে নামতাম।’
ভদ্রমহিলার তো লালাদার কথা শুনে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাবার অবস্থা। ভদ্রলোকও কী জবাব দেবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। এর পরক্ষণেই লালাদা হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ‘এক জীবনে যে সবকিছু পাওয়া যায় না, তা আমি জানি। আর তা পাওয়া উচিতও নয়। কিন্তু আর একটা ফিশফ্রাই তো পাওয়া যেতে পারে? একটা ফিশফ্রাই দাও।’ আর এরপরই হাসির রোল উঠল ঘরে।
এক জীবনে সবকিছু পাওয়া যায় না ঠিকই, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের একজন জনপ্রিয়, জীবন্ত কিংবদন্তি লেখক হিসাবে যে সম্মান ভালোবাসা সহমর্মিতা তাঁর প্রাপ্য ছিল, তা কি পেয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ? এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে, সংশয় আছে। আর এ সন্দেহ তিনি উস্কে দিয়েছেন তাঁর নিজের লেখাতেই।
তাঁর মৃত্যুর পর এ কথাও বলতে শোনা গিয়েছে শেষ জীবনে নাকি তিনি সরকারি পুরস্কারের জন্য লালায়িত হয়ে ব্যক্তি বিশেষের হাত ধরে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। আমরা যারা লালাদা—বুদ্ধদেব গুহকে কাছ থেকে দেখেছি, তারা জানি এর থেকে বড় অসত্য আর হয় না। লালাদা কোনওদিন পুরস্কারের জন্য হাত পাতেননি সে কথা আমি আগেও বিশ্বাস করতাম, আজও করি। তাঁর প্রবল আত্মসম্মান বোধ এ ব্যাপারটার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর এ ধরনের সংবাদ প্রচারিত হয়েছিল তা তাঁর জানার সুযোগ থাকলে তিনি হয়তো তাঁর স্বভাব সুলভ ভঙ্গিমাতে বলতেন, ‘বাঘ কখনও ফেউ-এর কাছে ভিক্ষা চায় না।’ কলমের পাশাপাশি একসময় বন্দুকও চালিয়েছেন তিনি। অরণ্যর প্রতি ছিল তাঁর গভীর টান। তাই তাঁর কথায় প্রায়শই উঠে আসত বন্য জীবন, বন্য প্রাণের উপমা, বিশেষত বাঘের কথা। এই যেমন কোনও সাহিত্য গোষ্ঠীর সঙ্গে অথবা লেখক গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক না থাকার কারণ সম্পর্কে কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি হেসে বলতেন, ‘বনের রাজা বাঘ সবসময় একাই ঘোরে।’ তবে প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হওয়ায় কোনও ক্ষোভ কি তাঁর ছিল না? হ্যাঁ, ছিল। যা তিনি লিখে গিয়েছেন তাঁর ‘সারস্বত’ নামের লেখাতে। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি তো আজ কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের একটি পুরস্কারও পাইনি। কারণ বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে অধিকাংশই আমাকে লেখক বলে স্বীকারই করেন না। অন্য নানা কারণে আমার প্রশংসা কেউ করলেও আমার লেখার প্রশংসা আমি অন্য কোনও লেখকের মুখে বিশেষ শুনিনি আজ অবধি।’
তিনি যা পেয়েছেন তা হল পাঠক-পাঠিকাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা। যা একমাত্র অর্জন করা যায় কলমের জোরেই। প্রকাশক সুধাংশুশেখর দে-র মুখে পাঠক মহলে লালাদার প্রবল জনপ্রিয়তা নিয়ে একটা গল্প শুনেছিলাম। লালাদা লিখেও গিয়েছেন ঘটনাটির কথা। অনেকেই হয়তো তা জানেন। তবুও ব্যাপারটা এ লেখা লিখতে গিয়ে মনে এল। ঘটনাটা হল— এক প্রকাশনাগোষ্ঠী কোনও এক অজ্ঞাত কারণে পুজোর ঠিক আগে তাদের শারদীয়াতে বুদ্ধদেব গুহর উপন্যাস ছাপতে অস্বীকার করে। লালাদা সেই উপন্যাস তুলে নিয়ে সুধাংশুবাবুকে দেন পুজোর সময় লেখাটি বই আকারে প্রকাশ করতে হবে সেই শর্তে। পুজোর মাত্র তখন আর আট-দশদিন বাকি। তাঁরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বইটি প্রকাশ করেন এবং বইটির বিজ্ঞাপন করেন। ফলশ্রুতি হিসাবে এক মাসেই বইটির পাঁচ-হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়। এ সৌভাগ্য কতজন লেখকের জীবনে ঘটেছে, তা আমার জানা নেই।
বিশেষত নবীন-প্রবীণ সব বয়সের পাঠিকাদের মধ্যে তাঁর অদ্ভুত একটা জনপ্রিয়তা ছিল। সেটা তাঁর কন্দর্পকান্তি রূপের জন্য নয়। নারী মনস্তত্ত্ব তিনি বুঝতেন, যা তিনি ফুটিয়ে তুলতেন তাঁর কলমে। যা স্পর্শ করত পাঠিকাদের হৃদয়কে। অসম্ভব শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ ছিল তাঁর যে কোনও বয়সি, যে কোনও পরিচয়ের মহিলাদের প্রতি। একটা ঘটনার কথা বলি। চুঁচুড়ার এক স্বামীহারা শিক্ষিকা তাঁর বালক পুত্রের হাত ধরে বইমেলার স্টলে উপস্থিত হয়েছেন প্রিয় লেখকের সামনে বইতে স্বাক্ষর করাবেন বলে। কথা প্রসঙ্গে তাঁর পাঠিকা স্বামীহারা শুনে তিনি পাঠিকার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। যেন তিনি তাঁর হাত স্পর্শ করে অনুভব করার চেষ্টা করলেন তাঁর স্বামী হারানোর যন্ত্রণার কথা, অথবা ভাগ করে নেওয়ার চেষ্টা করলেন তাঁর বেদনা। এমন নানা ঘটনার কথা আমি তাঁর পাঠিকাদের মুখে শুনেছি বা দেখেছি।
কোভিড মহামারী শুরু হবার আগের শীত। আমরা উপস্থিত হয়েছি মফস্সল শহরের এক বইমেলা উদ্বোধনে। অনুষ্ঠান মিটে যাবার পর আমরা গেলাম এক হোটেলের রুমে খানিক বিশ্রাম আর খাওয়াদাওয়ার জন্য। সেখানে উদাত্ত কণ্ঠে গান ধরলেন লালাদা। একের পর এক গান গেয়ে চলেছেন তিনি। কখনও ‘আমি বাঁধিনু তোমার তীরে তরণী আমার, একাকী বাহিতে তরী পারি না যে আর...।’ কখনও বা ‘মা গো জগতের কাছে ঘৃণ্য হয়েছি মা, তুমি যেন ঘৃণা করো না।’ হঠাৎ তারই মাঝে আমি লালাদাকে প্রশ্ন করে বসলাম, ‘পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তবে সে জন্মে তুমি পুরুষ হতে চাও নাকি নারী?’
সঙ্গে সঙ্গে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘নারী হতে চাই। কারণ, নারীর মনের গভীরতা পুরুষের চাইতে অনেক বেশি।’ নারীর প্রতি আমি এই শ্রদ্ধা বোধ খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখেছি। আর এরপরই তিনি বললেন, ‘নারীর মন হল প্রিজমের আলোকছটার মতো। তার অনেক রং। সেই রংগুলোকে চিনতে না পারলে নারীর মনের সৌন্দর্যকে জানা যায় না।’ সেই শীতের রাতে অনেকক্ষণ ধরে চলেছিল তাঁর গান আর কথোপকথন। সেই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। কথা হয়েছিল তার শান্তিনিকেতনের বাড়িতে একদিন জমাটি আড্ডা হবে রবীন্দ্রনাথ আর হেমিংওয়েকে নিয়ে। কিন্তু সে সুযোগ আর হয়নি। তারপর কোভিড এল। আর কোভিডের নিষেধাজ্ঞা শেষ হবার কিছুদিনের মধ্যেই এক সকালে কান্না জড়ানো কণ্ঠে লালাদার ছায়াসঙ্গী রঞ্জন টেলিফোনে বলল, ‘দাদা আর নেই!’
কেওড়াতলা মহাশ্মশানে যখন কাঠের আগুন ধীরে ধীরে লালাদার শরীরকে গ্রাস করে নিচ্ছে তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আমার লালাদার কথাই মনে পড়ে যাচ্ছিল— ‘রাজা বাঘ একলাই চলে। সেটাই তার সৌন্দর্য আর ক্ষমতার প্রকাশ।’ সে ক্ষমতা আর সৌন্দর্য হয়তো তাঁকে দিয়েছিলেন স্বয়ং দেবী সরস্বতী।
আজ মহালয়ার পুণ্য তিথি। পিতৃপুরুষের উদ্দেশে আজ তর্পণের দিন। তর্পণের আসল উদ্দেশ্য তো স্মৃতি-তর্পণ। আজ তোমার উদ্দেশে আমিও তর্পণ করলাম। আমার প্রণাম গ্রহণ কর। যেখানেই থাক ভালো থেক তুমি। আমার লালাদা— সরস্বতীর বরপুত্র বুদ্ধদেব গুহ।