সে নিজেই একটা ইতিহাস! তবু বেলা না যেতে খেলা তব গেল ঘুচে। তখন নাইট ক্লাব, হুক্কা বার, হ্যাং আউট, শপিং মলের কথা শোনালে মানুষ ভাবতো তামাশা করছে। দিনকাল ছিল একেবারে অন্য। রোববার দুপুরে মাংস-ভাত খেয়ে একটু গড়িয়ে আক্খা কলকাতা বেরত ম্যাটিনি শো দেখতে। হয় হাতিবাগান, নয় ভবানীপুর-এসপ্ল্যানেড। দুপুর থেকে রাত অবধি ভিড়। ধর্মতলা চত্বর গাঁক গাঁক করছে। ব্ল্যাকে টিকিট কেটে সপরিবারে কোনও হলে সেঁধিয়ে গেলেই হল। তখন ছুটির দিন মানে আদ্দির পাঞ্জাবি। মহিলারা সিল্কের শাড়ি পরতেন। বাচ্চাদের হাফ প্যান্ট-শার্ট। পায়ে নটি বয়, নটি গার্ল। জিনস-টপ-স্নিকার ইত্যাদি ভবিষ্যতের আলমারিতে তোলা।মধ্যবিত্ত অনেক পরে তা দেখতে পাবে।
রোববার ছুটি বলে এস এন ব্যানার্জি রোডে কর্পোরেশনের মূল বিল্ডিংটা থাকে অন্ধকার। কিন্তু তা সত্ত্বেও জায়গাটা ঝকমকে থাকত এলিটের জন্য। হলের বাইরের দেওয়ালে সিনেমার পোস্টার বড় করে টাঙানো। তাতে লাগানো হাই পাওয়ারের হ্যালোজেন। দূর থেকে সে আলো ছড়িয়ে পড়ত চত্বরজুড়ে। সেই আলোর রোশনাই ঠিকরে পড়ত সিল্কের শাড়ির জরিপাড়ে। ঝিকমিক জোনাকি জ্বলত মেন গেটে। কলকাতা এলিটে সেই যে সিনেমা দেখা শুরু করল, তা আর ছাড়ল না পরবর্তী ৬৮ বছরে। ১৯৫০ সালে হাঁটা শুরু করে আর পিছন ফিরে তাকায়নি সিনেমা হল। তার জন্য ইতিহাসের আলাদা একটা নোটবই খুলতে হয়েছে কলকাতাকে।
সে এলিট এখন আর নেই। কয়েকটি বুলডোজার তাকে পিষে দস্তুরমতো গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এখন ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে সে। কলকাতার অধিকাংশ সিঙ্গল স্ক্রিনের সঙ্গে চলে গিয়েছে সহমরণে। তবে এলিট যে নিজে শুধু গেল, তা তো না! আপামর মানুষের স্মৃতিকে হত্যা করে তবে নিল বিদায়। সবাই হয়তো মনে মনে তাঁর অন্ত্যেষ্টিও করল—‘এলিট সাহেব, তোমার আত্মার শান্তি হোক।’ ওমা! সাহেব কেন?
টেনিদা কাছাকাছি থাকলে না, এই প্রশ্ন শুনে এক চাঁটিতে ঘিলু চাটগাঁয়ে পাঠিয়ে দিত। সাহেব না তো আবার কী? ১৯১৫ সালে ম্যাডান থিয়েটার কোম্পানির অধীনে প্যালেস অব ভ্যারাইটি নামে একটি বলরুম তৈরি হয়েছিল সাহেবদের নাচাগানার জন্য। ১৯৩৮ নাগাদ সেটিই বদলে হল এলিট সিনেমা। অনেকে অবশ্য বলেন, তখন নাকি ক’বছর এর নাম ছিল প্রভাত। পরে রিডলি অ্যাবট নামে এক ব্রিটিশ স্থপতি খাস বিলিতি নকশায় তৈরি করলেন নতুন বাড়ি। কাজ চলাকাকালীন তাঁর মৃত্যু। ফলে জন বার্কম্যান ফার্নান্ডেজ নামে অন্য এক স্থপতি ১৯৪৮ নাগাদ কাজ শেষ করলেন। তারপর যতটুকু জানা যায়, রেডরিভার নামে একটি সিনেমা দেখানোর জন্য এলিট পর্দা তুলল ১৯৫০ সালে। তারপর, আহা কী সব ছবি! ‘গানস অব নাভারোন’, ‘গডফাদার’, ‘সাউন্ড অব মিউজিক’, ‘বর্ন ফ্রি’, ‘হ্যামলেট’। ১৯৬০ সালে আচমকা এল মুঘল-এ-আজম। বনেদি এসপ্ল্যানেডে সেই প্রথম ধাক্কা দিল এলিট। ইংরেজি সরিয়ে মুক্তি হিন্দি ছবির। তারপর এল ৭০ মিমি স্ক্রিন। আর ধর্মতলার ইংরেজি কৌলিন্যে মাথা গলিয়ে হিন্দি ছবির মারমার কাটকাট ব্যবসা শুরু। একদিন মুক্তি পেল শোলে। বাকিটা ইতিহাস। কলকাতাকে সাবালকও করল এই এলিট। ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’র মন্দাকিনীকে দেখে হৃদপিণ্ড ব্যাঙের মতো লাফিয়ে একাকার। আরও একটা ইতিহাস গড়ে উঠেছিল নিঃশব্দে। পাঁচ-ছয়ের দশকে বিশ্বের প্রগতিশীল সিনেমাগুলি কে দেখাত এ শহরকে? উত্তর একই, এলিট।
এলিটের সেই নোটবইটিতে লেখা বন্ধ হয়ে গেল পুরোপুরি। বছর পাঁচেক আগে ঝাঁপ বন্ধ হয়েছিল। এখন ভাঙা পড়ল অ্যাবটের বিলিতি নকশার বাড়িটিও। চূর্ণবিচূর্ণ এলিট এখন বিষণ্ণ ধুলো ওড়ায়।
দুপুরবেলার মাংস-ভাত এতক্ষণে হজম নিশ্চয়ই। এলিট থেকে উঁকি দিলে আমিনিয়া। বিরিয়ানির গন্ধ কুম্ভকর্ণের মতো খিদে পাওয়াচ্ছে। মাসের শেষদিকে অবশ্য সেদিকে না ঢোকাই ভালো। তার থেকে দু’পা বেশি ফেললে অনাদি। একটা করে মোগলাই আর কষা মাংসটা ভাগ করে নিলেই রোববার আরও জমে গেল। তারপর মৌরি চিবোতে চিবোতে বাড়ি। কাল আবার অফিস আছে...। তবে যাওয়ার আগে একবার সিম্ফনি ক্যাসেটের দোকানে ঘুরে যেতেই হবে। কিশোর কুমারের খানকয়েক গান লিস্ট করে রাখা অনেকদিন ধরেই। সেগুলি ক্যাসেটে রেকর্ড করতে দিতে হবে। ও হ্যাঁ বলা হয়নি, এলিটে দিওয়ার দেখতে যাওয়া হয়েছিল সেদিন। অনাদি কষা মাংসটা বানিয়েছিল খাসা।
আচ্ছা, রিডলি অ্যাবট তো নকশা বানালেন, বাড়ি তৈরিও শুরু করলেন, কিন্তু তাঁকে টাকা দিল কে? জানা যায়, এলিট সিনেমা একসময় ছিল হলিউডের প্রযোজত সংস্থা টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স এবং বিশ্ববিখ্যাত ফটোগ্রাফিক স্টুডিও বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ডের। পরে অবশ্য মালিকানা বদল হয়। তাবড় বলিউডি অভিনেতাদেরও নাম একসময় জড়িয়ে ছিল এই হলের সঙ্গে। এখানেই শহরের দর্শকরা প্রথম থ্রি-ডি সিনেমা দেখার সুযোগ পান। কলকাতা পুরসভার বইপত্র ঘাঁটলে জানা যায়, উল্টোদিকের বাড়িটির ঠিকানা ১৩৬, এস এন ব্যানার্জি রোড। দর্শকাসন ছিল ২২২৮টি। তিনতলা হলের ফ্লোর এরিয়া ২৮৩০ বর্গমিটার। জন আব্রাহামের ‘পরমাণু—দ্য স্টোরি অব পোখরান’ এলিটের লাস্ট ডে, লাস্ট শো। এটাও শোনা যায়, শেষ শোয়ের একটি টিকিটও বিক্রি হয়নি সেদিন! কারণ হয়তো, ততদিনে কলকাতা মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখার অভ্যাস করে ফেলেছে। শপিংমল, নাইট ক্লাবের ছড়াছড়ি। শহর জিন্স কবে পরে ফেলেছে। তারপর মিনি স্কার্ট ধরেছে। ছেলেরা বারমুডা ধরনের হাফ প্যান্ট পরে রাস্তায় বেরতে আর লজ্জা পায় না। তা পরে সিনেমা হলেও ঢুকে যায়। সিনেমা শেষে ঢুঁ মারে পাবে। সদলবলে হ্যাং আউটে যায়। এ শহরে এলিট চলে কী করে? এ শহরে যে সে বেমানান, ব্যাকডেটেড। ফলে এস এন ব্যানার্জি রোডে দাঁড়িয়ে ‘তফাৎ যাও, তফাৎ যাও’ অনর্গল বকেই চলে মেহের আলি। সরে যেতেই হয় এলিটের পাশ থেকে। তারপর হঠাৎ ধুলো হয়ে উড়ে যায় গোটা হল। কিন্তু কলকাতা যে তাকে ছেড়েও ছাড়তে চায় না। কেবলই গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে স্মৃতিতে। অনেক দূর থেকেও সে ধুলো নাকে ঢোকে। হাঁচি আসে। আর না হাঁচলেও চোখ জলে ভরে যায়। রবীন্দ্রনাথ গুনগুন করেন, ‘যদি দূরে যাই চলে। ...তবু মনে রেখো।’
জ্যোতি, নিউ সিনেমা, রিগ্যাল, অপেরা। এস এন ব্যানার্জি রোড আর লেনিন সরণিতে থাকা হলগুলি সব বন্ধ। ধর্মতলার ভিতরে লাইট হাউস, গ্লোব, যমুনা, চ্যাপলিন, টাইগার, রক্সিও পর্দা ফেলে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে ঘুম কোনওদিনও ভাঙবে না। ধর্মতলার সিনেমা পাড়ায় সেই যে রাবণের চিতা জ্বলা শুরু হয়েছিল, তা নিভলই না। অনিঃশেষ জ্বলে পুড়িয়ে ছাই করে দিল যাবতীয় রোমান্স, সাউন্ড, মিউজিক, অ্যাকশন। ধুলো হল ইতিহাস। স্মৃতি মলিন হতে হতে ছেঁড়া কাপড়ের মতো এবার ছিঁড়ে যাবে যে কোনওদিন।
বাঙালি কোনওদিন যাই বলে না। বলে, আসি। যাওয়ার বেলা ফিরে আসার অঙ্গীকার রেখে যায়। অনেক অভিমান নিয়ে চলে যাওয়ার সময় এলিট ‘আসি’ বলে যায়নি কাউকে। তবে কোনওদিন, কোনও স্বপ্নে সে ফিরে আসবে। তখন ঘুম ভেঙে ধড়ফড়িয়ে উঠে ‘যেতে নাহি দিব’ বললেও এবং হাজার খুঁজলেও এলিটকে আর পাওয়া যাবে না। সে ধুলো হওয়ার আগে বুলডোজারগুলিকে অনেক অভিমান ভরে বলে গিয়েছে ‘যাই’।
থাক। যাবার বেলায় পিছু থেকে ডাক দিয়ে কাঁদাতে নেই।
এলিট ইতিহাসই হয়ে গেল।
কৃষ্ণনগরের বনফুল এখন সাইকেল গ্যারাজ
উত্তাল সত্তর দশক। নকশাল আন্দোলনের ঢেউ এসে লেগেছে কৃষ্ণনগরে। তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী শহরের এক সিনেমা হল— ‘বনফুল’। সেই ঘটনা আজও ভুলতে পারেননি শহরের প্রবীণ নাগরিকরা। ১৯৬০ সালে তৈরি সেই ‘বনফুল’ অবশ্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে ৩৪-৩৫ বছর আগে। কৃষ্ণনগর রেলস্টেশনের ঠিক উল্টোদিকে সেই বিশাল সিনেমা হল এখন সাইকেল গ্যারেজ।
১৯৭০ সাল নাগাদ শহরে এক পুলিস কর্মীকে খুন করে নকশালরা। সন্ধ্যায় খবর আসে, অপরাধীরা লুকিয়ে রয়েছে বনফুলে। তখন পর্দায় চলছিল জিতেন্দ্র আর লীনা চন্দভারকারের ‘হামজোলি’। শো চলাকালীনই ভিতরে ঢুকে লাঠিচার্জ করতে শুরু করে পুলিস। তাতে আহত হন তৎকালীন এক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটও।
উত্তমকুমারের ‘সবার উপরে’ সিনেমার শ্যুটিং হয়েছিল কৃষ্ণনগরে। সেই ছবি যখন পর্দায় আসে, গোটা শহর ভেঙে পড়েছিল চিত্রমন্দির হলে। সেই প্রেক্ষাগৃহটিও বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহুদিন। শহরের আদি বাসিন্দা সঞ্জিত দত্ত জানিয়েছেন, আগে এখানে চারটি সিনেমা হল ছিল। এখন টিকে রয়েছে একটি, সঙ্গীতা। অগ্নিভ ভৌমিক
চিত্রা শুধু রাস্তার নামে
আসানসোল-বার্নপুর রাস্তার উপরই চিত্রা মোড়। এই নামকরণের নেপথ্যে একটি সিনেমা হল, ‘চিত্রা’। মোড়ের অদূরেই রয়েছে ভূতের বাড়ির মতো পড়ে রয়েছে বন্ধ হয়ে যাওয়া বিশাল সিনেমা হলটি। শহরের গোধূলি সিনেমা হলের অস্তিত্বও আর নেই। ‘সুভাষ’, ‘ডুরান্ড’ প্রেক্ষাগৃহ রেলের অধীনে থাকলেও সেখানে সিনেমা আর দেখানো হয় না। দুর্গাপুরেও হলগুলির একই দশা। বেনাচিতির অনুরাধা এখন শপিং হল। আসানসোল কুমারপুরে টিমটিম করে টিকে রয়েছে ১৬৫০ আসনের ‘মনোজ’। ম্যানেজার ইন্দ্রমোহন মিশ্রের দাবি, এটিই শহরের বুকে একমাত্র চালু সিনেমা হল। যে কোনও দিন তাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সুমন তেওয়ারি
কবিগুরুর স্মৃতিধন্য ‘হল’ পোড়োবাড়ি
রাস্তার নাম সিনেমা রোড। পথের ধারেই দাঁড়িয়ে হলুদ রঙের প্রকাণ্ড বাড়িটা। দূর থেকে দেখলে জমিদারবাড়ি বলেই ভুল হয়। মাথায় অবশ্য সাদার উপর নীল রঙে লেখা ‘চণ্ডীদাস চিত্র মন্দির’। সঙ্গে প্রতিষ্ঠাকাল, বাংলা সন ১৩৪৮। যে কথাটা লেখা নেই, তা হল এই নামকরণের নেপথ্যে ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঁকুড়ার একসময়ের অন্যতম আকর্ষণ এই সিনেমা হলটি এখন কার্যত পোড়োবাড়ি হিসেবেই দাঁড়িয়ে অতীত-গর্বের স্মৃতিপথে। শুধু এটি নয়, শহর ও লাগোয়া এলাকার সব প্রেক্ষাগৃহের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহুদিন। জেলা সদরে এখন কোনও সিনেমা হল নেই।
১৯৪০ সালে বাঁকুড়া শহরে এসেছিলেন কবিগুরু। সেই সময় তাঁর হাতে স্থাপিত হয়েছিল একটি প্রেক্ষাগৃহের ভিত্তিপ্রস্তর। রবীন্দ্রনাথই সেটির নামকরণ করেন ‘চণ্ডীদাস চিত্র মন্দির’। ২০১৮ থেকে বন্ধ প্রেক্ষাগৃহটি। শহরের প্রথম নির্বাক সিনেমা হলেরও সাক্ষী এই রাস্তা। তারপর ১৯২৯ সালে তৈরি হয় বীণাপানি। ব্রিটিশ শাসনকালে এই দুই সিনেমা হল নানা ইতিহাসের সাক্ষী। তার জেরেই রাস্তার নাম রাখা হয় সিনেমা রোড। এক প্রবীণ বাসিন্দা সমর কুণ্ডু বলেন, একসময় ১৯ পয়সা টিকিটে সিনেমা দেখা যেত। সিনেমা রোডের তিন হলে ছায়াছবি ভাঙলে একসঙ্গে হাজার খানেক মানুষ বের হতেন। রাস্তায় ব্যাপক ভিড় জমে যেত। এখন সব ইতিহাস।
বাঁকুড়া শহর সংলগ্ন এলাকায় তৈরি হয়েছিল শিবানী, বিশ্বকর্মা, কুসুম, কমলা প্রভৃতি একাধিক সিনেমা হল। আজ সবই বন্ধ। কোথাও তৈরি হয়েছে গোডাউন, কোথাও আবার ফ্ল্যাটবাড়ি। রামকুমার আচার্য
পায়েল মোড় আছে, নেই সিনেমা হলটাই
সেভক রোডে দুই মাইলের কাছেই পায়েল মোড়। সিনেমা হলের সুবাদেই এই নামকরণ। শুধু সেটাই আর নেই। বন্ধ প্রেক্ষাগৃহটি এখনও নজরে আসে। সামনের যে মাঠটায় টিকিটের জন্য লাইন পড়ে যেত, সেখানে এখন আগাছার জঙ্গল। মলিন হয়ে এসেছে ‘পায়েল’ লেখা গ্লোসাইনটাও। শিলিগুড়ি শহর থেকে এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক সিঙ্গল স্ক্রিন। এখন তো মাল্টিপ্লেক্সের যুগ! তাই মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যে থাকা পাঁচটি সিনেমা হল উঠে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। পায়েলের অবয়বটা তবু আছে। বাকিদের সেটুকুও নেই। বর্তমানে শিলিগুড়ি থানার কাছেই ছিল দু’টি হল—উর্বশী ও আনন্দলোক। দ্বিতীয়টির পরিচিতি এখন জিম ও লজ। বছর পাঁচেক আগে বন্ধ হওয়া উর্বশী ভেঙে তৈরি হচ্ছে আবাসন। শিলিগুড়ির ঝঙ্কার মোড়ের নামকরণের নেপথ্যেও ছিল একটি প্রেক্ষাগৃহ—ঝঙ্কার থিয়েটার। সিনেমার পোস্টার নামিয়ে সেখানে কবেই মাথা তুলেছে বহুতল। সেই ১৯৫১ থেকে হিলকার্ট রোডের ‘ল্যান্ডমার্ক’ মেঘদূত। সিনেমা হলটির ‘অন্ত্যেষ্টি’ হয়েছে কোভিডকালের আগেই। সে কথা বলতে গিয়ে হতাশাই ঝরে পড়ে ‘মেঘদূত’-এর মালিক, শিলিগুড়ি সিনেমা অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানির এমডি শুভাশিস মিত্রের গলায়। সুব্রত ধর
ফিরবে চলন্তিকা?
পেশায় উকিল, কিন্তু ব্রিটিশদের অধীনে চাকরি করতে চাননি তমলুকের বাসিন্দা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। স্বাধীনতার আগে তাই বেছে নিয়েছিলেন আয়ের নতুন রাস্তা— গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রোজেক্টরের সাহায্যে পর্দায় সিনেমা দেখানো। সেই টাকাতেই ১৯৪৫ সালে তমলুক শহরে গড়ে তোলেন একটি সিনেমা হল, চলন্তিকা। এক হাজার সিটের এই সিনেমা হল প্রথমবার বন্ধ হয়েছিল ২০০৪-এ। বছর তিনের পর বঙ্কিমবাবুর ছেলে ও নাতিদের চেষ্টায় ফের দরজা খোলে। কিন্তু, করের চাপে হল চালানোর কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। পরিণাম? ২০১০ সালে আবারও ঝাঁপ বন্ধ। তারপর থেকে গোডাউন ঘর হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়। তবু তমলুকে ১২ নম্বর ওয়ার্ডে ওই জায়গাটির নাম রয়ে গিয়েছে চলন্তিকা মোড়ই।
আজও সিনেমা হল চালুর আশা জিইয়ে রেখেছেন বঙ্কিমবাবুর ছেলে প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়। রেখে দিয়েছেন প্রোজেক্টর, স্ক্রিন এবং সিট। শুধুমাত্র ট্যাক্সের বোঝা একটু কম হলেই আবার তমলুক শহরে ঐতিহ্যবাহী এই সিনেমা হলের দরজা খুলে যেতে পারে, দাবি প্রতিষ্ঠাতার নাতি শিলাদিত্য চট্টোপাধ্যায়ের।
তমলুক শহরে মোট তিনটি সিনেমা হল ছিল। পুরাতন পাঞ্জাব ব্যাঙ্কের মোড়ে রূপশ্রী এবং মানিকতলায় রাজ্য সড়কের ধারে শ্রীদুর্গা একসময় রমরমিয়ে চলত। এখন সেগুলিতেও গোডাউন ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মেচেদায় মিনি ও মানসী, রাধামণিতে শ্যামাশ্রী, চণ্ডীপুরে মণিহার, নন্দকুমারে পিয়াসি, হলদিয়ায় মঞ্জুশ্রী, সুতাহাটায় শ্রী এবং দুর্গাচক ষোড়শী এবং মহিষাদলের বর্গভীমা সিনেমা হল বহুদিন ধরে বন্ধ। শ্রীকান্ত পড়্যা
সিনেমাহীন ঝাড়গ্রাম
একসময় ঝাড়গ্রাম শহরে রমরমিয়ে চলত চারটি সিনেমা হল। প্রিয়া, রূপছায়া, সাবিত্রী ও জনতা। সেগুলির এখন ভূতুড়ে দশা। বেলপাহাড়ী ব্লকের শিলদায় সিংহবাহিনী টকিজটিও বহু বছর বন্ধ। অগত্যা জেলার মানুষকে বড় পর্দায় সিনেমা দেখতে হলে যেতে হয় মেদিনীপুর বা খড়্গপুর শহরে। তার জন্য বাসে ঘণ্টাখানেকের রাস্তা উজিয়ে পৌঁছতে হয় সঠিক সময়ে। ঘোড়াধরা এলাকার বাসিন্দা সুবীর বিশ্বাস বলছিলেন, বড় পর্দায় সিনেমা দেখার মজাই আলাদা। আগে সে এক দিন ছিল। ছোটবেলায় উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেনের বহু ছবি হলে গিয়ে দেখেছি। এখন সিনেমা দেখার জন্য খড়্গপুর বা মেদিনীপুর যেতে আর ইচ্ছে করে না। রাজদীপ গোস্বামী