সোমনাথ বসু: আম কুড়োতে খুব ভালো লাগত রবির। বিভিন্ন কবিতায় তা ঘুরেফিরে এসেছে। ‘দুই বিঘা জমি’তে তিনি লিখছেন, ‘সেই মনে পড়ে, জৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাইকো ঘুম,/অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।’ শুধু তাই নয়, আশ্রমের কারও মধ্যে এই নেশা থাকলে তিনি তাকে প্রশ্রয় দিতেন। ঠিক এমনই এক ঘটনার সাক্ষী ছোট্ট অণিমা ও তার সহচরী। কতই বা বয়স তখন তার। ছয় কিংবা সাত। শান্তিনিকেতনের বিকেলের আকাশ গান ধরেছে, ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে...’। শৈশবের বাঁধনছাড়া উল্লাসে তখন অণিমা মত্ত, অকুতোভয়। আম কুড়োতেই হবে তাকে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি। মুষলধারায়। কী আর করে ছোট্ট মেয়েটি। কাছেই ‘শ্যামলী’। তার দাওয়ায় উঠে পড়ল সে। গৃহস্বামী তখন প্রকৃতির রঙে শব্দ বসাতে ব্যস্ত। মনে হয়তো সুরও খেলা করছে নিজস্ব রাগে। হঠাৎই অণিমাকে দেখে মুগ্ধ হলেন কবি। কবিগুরু। শান্ত স্বরে গান শোনানোর অনুরোধ এল সেই মেয়েটির কাছে। গেয়েও ফেলল সে। শুনে অনুরোধকারী বললেন, ‘তুমি আমাদের সত্যচরণের মেয়ে। মাঝে মাঝে গান শুনিয়ে যেয়ো আমাকে।’
গান শুনিয়ে এক ছুট্টে বাড়িতে এল অণিমা। সন্ধ্যা, রাত্রি এল নিয়ম মেনে। মেয়েটির স্মৃতিসুধায় শুধুই সেই অনুরোধকারী। আর কেউ নয়। বাকিটা ইতিহাস। আম কুড়োনোর ধুমে তিনি যে পেয়ে গেছেন জীবন ঈশ্বরের সান্নিধ্য। তাই আমৃত্যু রবিগানকে তিনি কণ্ঠে ধরেছেন শেষ পারানির কড়ি হিসেবেই।
জন্ম বাঁকুড়ার সোনামুখী গ্রামে। কিন্তু নিজেকে শান্তিনিকেতনের আশ্রমকন্যা হিসেবেই চিরকাল দেখেছেন তিনি। তাই তো অক্লেশে লিখেছেন, ‘ততদিনে তাঁর (রবীন্দ্রনাথ) সঙ্গে আমার সম্পর্ক যেন কত সহজ। আজ জানি তখনও তিনি অন্যদের কাছে কত ‘মহান’, কত ‘বিরাট’, কত ‘বিশাল’, কিন্তু তখন তিনি আমার অতি আপনজন। আমার আবদার করার, আমার নালিশ জানাবার, আমার অভিমান করার, আমায় সমাধান খুঁজে দেওয়ার মানুষ তিনি।’
রবি-প্রশ্রয়েই গান শিখেছেন তিনি। পেয়েছেন ‘নব আনন্দে জাগো’র মন্ত্র। একবার ‘উদিচী’তে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘সুমঙ্গলী বধূ’র গান শেখাচ্ছেন। ... ‘আঘাতে হও জয়ী অবিচল ধৈর্যে কল্যাণময়ী’— ছোট্ট মেয়েটির কণ্ঠ যেন আজ সঙ্গ দিতে নারাজ। কিছুতেই কবির সুরে সুর মেলাতে পারছে না। কপালে হাত দিলেন রবিবাবু। এ কী! গা যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। পরে আত্মজীবনীতে অণিমা, থুড়ি কণিকার ব্যাখ্যা, ‘গুরুদেব আমার কপালে হাত রেখে বললেন, তোর তো গা গরম। বাড়ি চলে যা।’ পরে কবির হাতে নিপুণ সেবাও পেয়েছে আদরের মোহর। শুধু তাই নয়, কীভাবে কাঁটাচামচ দিয়ে খেতে হয়, সেই শিক্ষাও পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের থেকে।
সালটা ১৯৩৭। কলকাতার ছায়া প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠানে গান গাইলেন কণিকা, ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’। তাঁর গানে গলা মেলালেন স্বয়ং রবি। স্রষ্টা ও তাঁর শিষ্যার মেলবন্ধনে ভয়ের সব বাঁধন ভেঙে গেল। শুধু গান নয়, কবিতা পাঠ ও নাটকে অভিনয়ও করেছেন অবন ঠাকুরের ‘আকবরী মোহর’। এই যাত্রায়ও তাঁর প্রশ্রয়ের নাম রবিবাবু। ‘ডাকঘর’ নাটকে সুধা হলেন কণিকা। সংলাপ বলার সময় অভিব্যক্তির ধরন শেখালেন কবি। ‘তাই বই কি! ফুলের খবর আমার চেয়ে তুমি নাকি বেশি জান’— অমলকে কীভাবে বলতে হবে তা হাতে-কলমে সুধাকে দেখালেন তিনি। এই সময়েই শেখা, ‘সমুখে শান্তি পারাবার’। এই গানের অর্থ জীবনের বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন ভাবে খুঁজে পেয়েছেন শিল্পী। বলেছেন, ‘কী অপূর্ব ভঙ্গিতে গাইতেন। গাওয়া শেষ করে বলতেন, ‘‘আমার মৃত্যুর পর এ গান গেও তোমরা।’’ আবার নয়ের দশকের শেষদিকে নিজের বাড়ি ‘আনন্দধারা’র ড্রয়িং-রুমের ইজি চেয়ারে বসে কণিকা এই গান গুনগুন করতেন। হাতের তাল পড়ত কাঠের হাতলের উপর। অর্থাৎ, জীবনের ওপারে যাওয়ার আহ্বান রবীন্দ্রনাথের ঢংয়েই খুঁজে পেয়েছিলেন কণিকা।
১৯৪১’এর ২৫ জুলাই। সমুখে মৃত্যুর ডাক শুনতে পাচ্ছেন গুরুদেব। অসুস্থ কবিকে নিয়ে আসা হবে কলকাতায়। তার আগে কণিকা গাইলেন, ‘এ দিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার’। মোহরের মাধুর্য কানে নিয়েই শান্তিনিকেতন ছাড়লেন কবি। এরপরেই এল সেই ২২ শ্রাবণ। প্রকৃতিও সেদিন কাঁদছে। সঙ্গে হাওয়া পাগলপারা। কলকাতা থেকে এল দুঃসংবাদ, কবি আর নেই। কণিকা সেদিন গেয়েছিলেন সেই গান, ‘সমুখে শান্তি পারাবার’।
কণিকার প্রথম রেকর্ড কিন্তু ছিল আধুনিক গানের, যা মেনে নিতে পারেননি কবি। আঘাত পেয়েছিলেন। তাই জীবনে আর কোনওদিন অন্য গান রেকর্ড করা হয়নি মোহরের। নিজেই বলেছেন, ‘যাঁকে ঘিরে আমার সবকিছু, তাঁকে ব্যথা দিয়ে গানের তরী বাওয়া উচিত নয়।’
রবিবাবুর গানকে রবীন্দ্রসঙ্গীত করার অন্যতম কারিগর তিনি। গ্রাম্য, শান্ত, আটপৌরে, আত্মমগ্ন জীবনযাপনের সঙ্গে গানকে বেঁধে নেওয়াই কণিকার ইউএসপি। স্রষ্টার সৃষ্টিকে কখনও বিন্দুমাত্র আঘাত দিতে চাননি। অনুষ্ঠানে তাঁর মুখের সামনে খোলা থাকত গানের খাতা। বলতেন, ‘এই খাতা হল শিল্পী আর শ্রোতার মধ্যে আড়াল।’ শহুরে প্রলোভনে কোনওদিন পা কেন, নিজের ছায়াও পড়তে দেননি কণিকা।
গান শিখেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে। এছাড়াও পেয়েছেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ, হেমেন্দ্রলাল রায়, অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভি ভি ওয়াজেলওয়ারের শিক্ষা। তবে কবিগুরুর পর তাঁর দ্বিতীয় গুরু অবশ্যই শৈলজাদা। শান্তিবাবুর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা রেখেও এই কথা তিনি বারবার বলেছেন। রবিগান যেন চিরকাল রবিগানই থাকে, এই লক্ষ্যই ছিল তাঁর। রবীন্দ্রনাথই ছিলেন তাঁর নিভৃত প্রাণের দেবতা। আর পূজা পর্যায়ের গানই ছিল তাঁর নৈবেদ্য। এছাড়া প্রেম ও প্রকৃতির গানেও তাঁর নিবেদন এখনও বাঙালিকে আত্মভোলা করে তোলে।
শ্রোতাদের হৃদয়ের আঁচলে এখনও কণিকার অজস্র গান বাঁধা আছে। ‘ও যে মানে না মানা’, ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না’, ‘বাজে করুণ সুরে’, ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ ইত্যাদি। কিন্তু কোনওদিন প্রচারের আলো চাননি তিনি। চিকিৎসার জন্য একবার তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। হাওড়া স্টেশনে মোহরকে দেখার জন্য উপচে পড়েছে ভিড়। তা দেখে নিজেই বিস্মিত হয়ে কণিকা বলেছেন, ‘এত লোক এখানে। আমি তাহলে কীভাবে বেরব?’
দীর্ঘদিন বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনা করেছেন কণিকা। তাঁর তালিমে বহু শিল্পী আজ খ্যাতির শীর্ষে। কীভাবে গান শেখাতেন তিনি। মোহরের বোনপো প্রিয়ম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘মাসি সবসময় বলতেন, কোনও গান শেখার আগে তা একশোবার পড়া বাধ্যতামূলক। ভাব এবং অন্তর্নিহিত অর্থ শুধু বুঝলেই হবে না। প্রয়োজন উপলব্ধির। না হলে গুরুদেবের গান এককের হবে না।’ শোনা যায়, সঙ্গীতে মনোযোগী হওয়ার জন্য একবার প্রমিতা মল্লিককে একটি কুকুরও উপহার দেন কণিকা।
কিংবদন্তি শিল্পী হলেও মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশনের আগে বেশ নার্ভাস থাকতেন মোহর। একবার শৈলজারঞ্জন মজুমদারের উৎসাহে প্রেসিডেন্সি কলেজের অনুষ্ঠানে গান গাইতে এসেছেন কণিকা-সুচিত্রা মিত্ররা। ব্যাকস্টেজে গুনগুন করছেন, ঠিক তখনই কে যেন বলল, ‘এখানে গান খারাপ হলে ছেলেরা শব্দ করে।’ ব্যস, মোহরের শিরদাঁড়ায় দিয়ে বইতে লাগল উষ্ণ প্রস্রবণ। বন্ধু সুচিত্রার কাছে বারবার জল চাইলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত গাইলেন, ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে’। শিল্পী নিজেই বলেছেন, ‘গানটা মোটেই ভালো হয়নি। বরং সুচিত্রা অনেক ভালো গেয়েছিল। ওর গাওয়া ‘গোধূলি লগনে’ কোনওদিন ভুলব না। আর আমার গানের জন্য শৈলজাদার বকুনি খেয়েছিলাম। বরং আবৃত্তিটা সেদিন অনেক ভালো হয়েছিল।’
কেন স্নায়ুর চাপে ভুগতেন কণিকা? অনেকে বলেন, রবিগান ছিল তাঁর কাছে জীবনের অঙ্গ। কোনও পরিস্থিতিতেই তার প্রতি সামান্যতম অবিচারও করতে নারাজ তিনি। পদ্মশ্রী, দেশিকোত্তম সম্মানে ভূষিত হলেও নামের পাশে বিরাট বিশেষণ তাঁর একেবারেই না-পসন্দ ছিল। এই কারণেই মোহর রবিগানের অলঙ্কার। বাঙালির মনের কোণের আপনজন।
তথ্যসূত্র: শিল্পীর আত্মজীবনী আনন্দধারা।