রবীন্দ্রসঙ্গীতের কিংবদন্তি সুচিত্রা মিত্রের জন্মশতবর্ষ! গুরুদক্ষিণায় ছাত্রী মীনাক্ষী সিংহ। ক্যামেরায় ধরা স্মৃতি উজাড় করলেন অশোক মজুমদার
রবীন্দ্রসঙ্গীতের রহস্য নিকেতনে যিনি আমাদের চোখে আলো জ্বেলেছেন, কণ্ঠে দিয়েছেন সুর, অনুভবে দিয়েছেন গভীরতা, আজ তাঁর শতবর্ষের সূচনা লগ্ন। এখন অবসরে ফিরে তাকাই ছ’দশক আগের এক পরমক্ষণে— যেদিন রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাজেন্দ্রাণী সুচিত্রা মিত্রকে প্রথম দেখা। সে এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। ১৯৬০ সালের জুন মাসে এক স্মৃতিময় অপরাহ্নে ভর্তি হয়েছিলাম ‘রবিতীর্থ’র উত্তর কলকাতা শাখায়। এতদিন যাঁর কণ্ঠের রুদ্রমধুর পরিবেশনায় ছিলাম মুগ্ধ শ্রোতা— তিনি তখন আমার সামনে। সে তো নিছক আগমন নয়, যেন ‘আবির্ভাব’।
তাঁর কাছে রবীন্দ্রগানের দীক্ষা নিয়ে আমার জীবনপথের চলা অনিঃশেষ। সুচিত্রা মিত্র তখনও চল্লিশে পা দেননি। ছিলেন প্রাণচাঞ্চল্য হৃদয়বত্তা, স্মার্টনেস ও ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ী এক অভিজাত সত্তা। স্মৃতি দূরবিনে আজও দেখতে পাই সেই দিনগুলির প্রতিটি মুহূর্তকে। রবিতীর্থের প্রাণপ্রতিমা সুচিত্রা মিত্র এসে দাঁড়ালেন আমাদের সামনে। ঠিক যেন—‘একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণি জুড়ে।’ মনে পড়ছে রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক অরুণ বসুর মন্তব্য, ‘একদিন শুরু হল সুচিত্রা মুখোপাধ্যায়ের (মিত্র) যুগ। অবিশ্বাস্য অন্য কণ্ঠ, একেবারেই অন্য কণ্ঠ। কী দৃপ্ত, কী সরল ঋজু সতেজ, কী বিশ্বস্ত, কী অনায়াস।’
১৯৬০ থেকে ২০১১— দীর্ঘ পাঁচ দশক তাঁর সান্নিধ্যধন্য অতি সাধারণ এক ছাত্রী আজ জীবনের গোধূলিবেলায় স্মরণাঞ্জলিতে দিচ্ছে গুরুদক্ষিণা। না, এ কোনও ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা নয়, এক অসামান্যা সুর সাধিকার প্রতি অন্তরের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সুচিত্রাদির জন্ম ১৯২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। চলন্ত ট্রেনে। সেই সময়ে ট্রেন থেমেছিল বিহারের গুঝাণ্ডি স্টেশনে। তাই তাঁর ডাক নাম হল—গুজু বা গজু। একসময় শান্তিনিকেতনে অনন্যা গায়িকা-ত্রয়ী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র ও নীলিমা সেন তাঁদের ডাকনামেই বিখ্যাত ছিলেন—মোহর, গজু ও বাচ্চু। বাবা রবীন্দ্র স্নেহধন্য সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক। বাড়িতে সংস্কৃতির পরিমণ্ডল। মায়ের গলায় গান শুনে তাঁর বড় হয়ে ওঠা। বেথুন স্কুলে শিক্ষালাভ। সেই পর্ব শেষে, ১৯৪১ সালে কবিগুরুর তিরোধানের কিছু পরে শান্তিনিকেতনে যোগদান করেন সঙ্গীত শিক্ষার্থীরূপে। যেখানে আকাশে-বাতাসে মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে না পাওয়া সুচিত্রাদির জীবনে এক বেদনাবাহ ক্ষত। তবু রবীন্দ্রনাথের গানের তরীতেই তাঁর ভেসে চলা। দীর্ঘ সাত দশক পেরিয়ে, সেই যাত্রা থামল ২০১১ সালের ৩ জানুয়ারি। হয়তো আজ সিন্ধু পারের নতুন তীরে দেখা হয়ে গিয়েছে তাঁর জীবনদেবতার সঙ্গে, যেখানে গানের সুরে রবীন্দ্রনাথকে অন্তরতম রূপে পেয়েছেন সুচিত্রাদি।
মনে পড়ছে একদিন গান শেখাতে বসে তাঁর আত্মমগ্ন স্মৃতিচারণ। ‘ভেবেছিলেন আসবে ফিরে’ গানটি শেখাতে গিয়ে বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের দিনে শান্তিনিকেতনে বেদনাবিদ্ধ কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল—ভেবেছিলেম আসবে ফিরে,/ তাই সাহস করে দিলেন বিদায়।/ তুমি গেলে ভাসি নয়ননীরে/এখন শ্রাবণদিনে মরি দ্বিধায়।’ আমাদের সামনেও যেন সেদিন শান্তিনিকেতনের বিষণ্ণ শ্রাবণ বেলার ছবিটি উদ্ভাসিত হয়েছিল।
শান্তিনিকেতনে সুচিত্রাদি (তখন মুখোপাধ্যায়) গান শিখেছিলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, শান্তিদেব ঘোষ, শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে। এরপর ফের কলকাতার পর্ব। ভর্তি হলেন স্কটিশচার্চ কলেজে। এই সময়েই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ধ্রুব মিত্র ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। পরে ধ্রুব মিত্রর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনেও আবদ্ধ হলেন। ১৯৪৭ সালে জন্ম হয় একমাত্র পুত্র কুণালের। কিন্তু চিরাচরিত দাম্পত্য বন্ধন তাঁর লিখন নয়। ১৯৫৫ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ। এরপর কুণালকে নিয়ে শুরু হয় তাঁর একক জীবন সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে তাঁর পাথেয় ছিল রবীন্দ্রনাথের গান—‘যেতে যেতে একলা পথে/ নিবেছে মোর বাতি।/ ঝড় এসেছে, ওরে, এবার/ ঝড়কে পেলেম সাথি।’
এই ঝড় তাঁর জীবনে বারবার এসেছে। আর সেই ঝড়কে সঙ্গী করেই চলেছে জীবনের পথ পরিক্রমা। কন্যার জন্মের মাত্র ২১ দিনের মাথায় মৃত্যু হয় তাঁর ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর। মাতৃহারা সেই সদ্যোজাতকে মাতৃস্নেহে আগলে রেখেছিলেন আজীবন। পুত্র কুণাল ও কন্যারূপা সুদেষ্ণার মা সুচিত্রা মিত্র আঘাত পেয়েছেন বারবার। তাঁর জীবন ‘মধুর খেলা’ ছিল না—তবু কবির গানের সুরে তিনি বেঁধেছিলেন নিজের জীবনের ছন্দ। রবীন্দ্রসঙ্গীতই ছিল তাঁর পরমতম আশ্রয়।
সুচিত্রাদির আগে ধ্রুব মিত্র বিয়ে করেছিলেন গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। পরে যিনি কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী হিসেবে সুখী দাম্পত্যে স্থিত হয়েছিলেন। এমনকী সুচিত্রাদির সঙ্গে বিচ্ছেদের পর তৃতীয়বার বিয়ে করেন ধ্রুব মিত্র। সেই মহিলার সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল একক নিঃসঙ্গ পথচারিণী সুচিত্রাদির। শ্রদ্ধাগত চিত্তে সম্পর্ক রেখেছিলেন ধ্রুবর মায়ের সঙ্গেও। পুত্র কুণালের জন্য আজীবন বহন করেছেন নিজের ‘মিত্র’ পদবি। শুধু তাই নয়, বিবাহ বিচ্ছেদের পরও ধ্রুবকে স্বীকৃতি দিয়েছেন বন্ধু বলে। তাঁর মৃত্যুর পর বলেছিলেন, ‘আমার বন্ধু চলে গেল।’
বেদনা-ভরা জীবন। সেই বেদনাকে আত্মস্থ করার পথ সুচিত্রা মিত্র খুঁজে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতে। একথা সকলের জানা। খ্যাতি, প্রতিপত্তি, সম্মান, ঐশ্বর্যের পাশাপাশি পড়ে থাকে যে অসীম একক সত্তা, সেখানে তাঁর আশ্রয় ছিল জীবনদেবতা রবীন্দ্রনাথের গান। রবীন্দ্রনাথই যে তাঁর চিরপথের সঙ্গী, চিরজীবন, চিরনির্ভর। সেই জন্যই ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন গীতায়ন ‘রবিতীর্থ’। সহযোগী অকৃত্রিম সুহৃদ দ্বিজেন চৌধুরী। প্রতিষ্ঠানের নামকরণের পর ডঃ কালিদাস নাগ বলেছিলেন, ‘তীর্থক্ষেত্র যেমন সব জাতির সমন্বয়, রবিতীর্থও তেমনই সকল কৃষ্টির মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠুক।’ তাই অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ‘একান্ত ঠিকানা’ কবিতায় লেখেন—‘শান্তিনিকেতন ছেড়ে নগরের পথে/ আমিও যখনই যাই শ্রাবণে শরতে/ একান্ত ঠিকানা বলতে এ গীতবিতান/ রবিতীর্থ আছে জানি পরাশর রোডে।’
তারপর শুরু হল ‘রবিতীর্থে’র জয়যাত্রা। সাংস্কৃতিক পথ পরিক্রমাও বলা যায়। ১৯৫৫ সালে বর্ষামঙ্গল, ১৯৫৮ সালে নিউ এম্পায়ারে মঞ্চস্থ হল ‘চণ্ডালিকা’। ১৯৬৪ সালে আবারও মঞ্চস্থ হল ‘চণ্ডালিকা’, এবার মহাজাতি সদনে। এর পর একে একে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’, ‘শাপমোচন’, ‘শ্যামা’, ‘তাসের দেশ’— অনন্য সব অনুষ্ঠান। সবই সুচিত্রা মিত্রের পরিচালনায়। রবিতীর্থের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে প্রধান গীতি ভূমিকায় স্বয়ং তিনি। সমকালীন বিশিষ্ট সুধীজন ও মনীষীবৃন্দ সকলেই তাঁর অসামান্য কণ্ঠসম্পদের অনুরাগী। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে অশোক মিত্রের কথা। কবির স্নেহধন্যা অমিতা সেনের অসামান্য কণ্ঠলাবণ্যের প্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন—‘সেরকম গলা সুচিত্রার সঙ্গীত জীবনের শীর্ষে কয়েকবার শুনেছি। গলা যেন শেলীর সুপ্রসিদ্ধ স্কাইলার্কের মতো ঊর্ধ্বে, আরও ঊর্ধ্ব গগনে উঠছে তো উঠছেই।’
সুচিত্রাদির একক গানের অনুষ্ঠানে সাক্ষী থাকাও এক বিরল অভিজ্ঞতা। এ সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছে, তাঁরা জানেন সেই অনৈসর্গিক অনুভবের কথা। একবার এক আসরে বসে পরপর ৩০টি গান গাইলেন সম্পূর্ণ স্মৃতি থেকে। অবিস্মরণীয় এক উপহার পেলেন শ্রোতারা। তবে রবিতীর্থের অনুষ্ঠানের চমক ছিল অন্য এক জায়গায়। প্রচলিত গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য ছাড়াও থাকত উপন্যাস পাঠ, ছবি নিয়ে গানের মতো বিষয়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানান ভাবনার নানা রূপ মূর্ত হয়ে উঠত গানে গানে। সমগ্র পরিকল্পনা ও রূপায়ণের কৃতিত্ব একজনেরই—সুচিত্রা মিত্র।
স্মৃতিপথে ফিরে তাকালে মনে পড়ে এক অসামান্য অনুষ্ঠানের কথা। সুচিত্রাদির একক নিবেদন— ‘বাল্মীকি প্রতিভা’। শুধু দস্যুদলের কয়েকটি পুরুষকণ্ঠ বাকি সম্পূর্ণ বাল্মীকি প্রতিভা তাঁর অতুলনীয় একক কণ্ঠে। এছাড়াও বিশেষ কয়েকটি অনুষ্ঠানের কথা বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। ১৯৭১ সালে রাজভবনে অনুষ্ঠিত ‘চিত্রাঙ্গদা’। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের জননায়ক মুজিবর রহমান। ১৯৭৫ সালে রবিতীর্থের শিল্পীগোষ্ঠীকে নিয়ে সুচিত্রাদি গিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, এক বিশেষ আমন্ত্রণে। সেখানে মঞ্চস্থ হয় ‘তাদের দেশ’। মুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে পড়ে শ্রোতাদের মধ্যে। তিনি অবশ্য বহুবার লন্ডনে ও আমেরিকায় একক রবীন্দ্রসঙ্গীতও পরিবেশন করেছেন। কলকাতায় আমজাদ আলি খানের সরোদের সঙ্গে সুচিত্রা মিত্রের গানের যুগলবন্দি ছিল শ্রোতা দর্শকের কাছে এক অনন্য উপহার।
শুধু গানের সুরেই নয়, নৃত্যলীলা, আবৃত্তি, নাট্য ভাবনা, ললিতকলা, সাহিত্য সৃজনেও তিনি ছিলেন অনুপমা। ‘নটীর পূজা’য় শ্রীমতী, ‘তপতী’ নাটকে বিপাশা, ‘চিরকুমার সভা’র নীরবালা তাঁর অভিনয়, নৃত্য ও সঙ্গীতকলার এক অনন্য মেলবন্ধনের প্রকাশ। আবার অবসর সময়ে ব্যস্ত থেকেছেন ছবি আঁকা, পুতুল গড়া, ছড়া-কবিতা লেখা, স্মৃতিচারণে। অনুবাদের ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য দক্ষতার সাক্ষ্য বহন করে খলিল জিব্রানের কবিতার অনুবাদ, ‘মরমী বচন’। ‘দুঃখ আমার অসীম পাথার পার হল যে’— সেই দুঃখব্রতকে জীবনের আশ্রয় বলে মেনে নিয়েছিলেন। হয়তো তাই খলিল জিব্রানের ‘Spiritual Saying’-এর ভাবানুবাদে লিখেছিলেন,
‘এরই মাঝে— তবু বলি শোনো/ এমনও দুঃখ আছে কোনো/ প্রেমের থেকেও যে গভীর/ জ্ঞানের থেকেও মহিমময়/ বাসনার চেয়ে যে দৃঢ়/ দারিদ্র্য দুঃখ থেকেও প্রগাঢ়/ নেই তার কণ্ঠ কিংবা ভাষা।’
এ যেন তাঁর জীবনের এক গভীর উচ্চারণ!
সঙ্গীত, সাহিত্য, অভিনয়, নৃত্য-প্রতিভার বাইরেও আরও একটি পরিচয় আছে সুচিত্রাদির। সাধারণ মানুষের কাছে যা কিছুটা অজানাও বটে। তা হল, ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে তাঁর যোগ। বামপন্থায় সুগভীর আস্থা ছিল সুচিত্রাদির। এই প্রসঙ্গে আরও একটি অজানা তথ্য উল্লেখ করা যাক। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাধিকা হলেও প্রথম দিকে আরও অনেক রকমের গান গেয়েছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁর সাধনা, উপাসনা। কিন্তু নিজেকে তার মধ্যেই আবদ্ধ করে রাখেননি। গেয়েছেন ব্রহ্মসঙ্গীত, অতুলপ্রসাদী, নজরুল গীতি, আধুনিক, নবজীবন ও গণনাট্যের গানও। তাঁর কর্মপরিধি বিস্ময়কর। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। কলকাতার প্রথম মহিলা শেরিফ হওয়ার গৌরবময় পালকও জুড়েছে তাঁর মুকুটে। ভূষিত হয়েছেন ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে। আবার এতকিছুর মধ্যেও অসামান্য নিপুণতায় সংসারের সব দায়িত্ব সামলেছেন একা হাতে।
সুচিত্রাদির কর্মব্যস্ত জীবনের বড় অংশজুড়ে ছিল প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান ‘রবিতীর্থ’। আর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী, যাঁদের তিনি দিয়েছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের দীক্ষা। রবীন্দ্রনাথের গানকে কীভাবে শুধু কণ্ঠে ধারণ নয়, হৃদয়েও বরণ করতে হয়— দিয়েছেন সেই শিক্ষাও। বুঝিয়েছেন, রবীন্দ্রবাণী ও ভাবের যুগল সম্মেলনে কীভাবে সুর প্রাণ পায়। এখানেই তাঁর সার্থকতা। সুচিত্রাদি শিখিয়েছেন সেই ভাবরূপকে সমন্বিত করতে। প্রতিটি শব্দকে আলাদা মর্যাদা দিয়ে সুর-ঋদ্ধ উচ্চারণে কীভাবে গানকে প্রাণের স্পন্দন দিতে হয়, তাও শেখা তাঁরই কাছে। রবীন্দ্রনাথের গান যেন মন্ত্রোচ্চারণের মহিমায় প্রাণ পেত তাঁর সুললিত কণ্ঠে। পরিশীলিত শুদ্ধ উচ্চারণ ও শব্দ দিয়ে কীভাবে সুরের মূর্তি নির্মাণ করতে হয়, তাও শেখাতেন প্রাণ ঢেলে।
মনে আছে ‘আমার যা আছে আমি সকল দিতে পারিনি তোমারে নাথ’ গানটির সঞ্চারির প্রথম চরণ শেখার মুহূর্তটা। ‘যাহা রেখেছি তাহে কী সুখ/ তাহে কেঁদে মরি তাহে ভেবে মরি’। এই চরণে ‘তাহে’ শব্দের তিনবার উচ্চারণের পৃথক বৈশিষ্ট্য কী, তা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। আবার ‘আমার মন কেমন করে’ গানটিতে ‘কে জানে কে জানে কে জানে কাহার তরে’ আছে তিনবার। তিনরকমভাবে তা উচ্চারণ করে যে সুর লাগাতে হবে, শিখিয়ে দেন সেকথাও।
এসব বিষয় অবশ্য অনেকেরই জানা, দেখা, শোনা। এর বাইরেও সঞ্চয়ে রয়েছে কিছু স্মৃতি, যা ছয়ের দশকের আমাদের মতো কয়েকজন ছাত্রীর জীবনের অমূল্য সম্পদ। আজও চোখ বুজলে দেখতে পাই এক ঘনঘোর বর্ষাদিন। উত্তর কলকাতার রবিতীর্থের ঘরটিতে আমরা মাত্র পাঁচ-ছ’জন ছাত্রী। প্রবল বর্ষা উপেক্ষা করে দক্ষিণ কলকাতা থেকে এসেছেন সুচিত্রাদিও। শুধুমাত্র আমাদের ক্লাস নিতে। আমরা ভাবলাম, আজ একটু অন্যরকম হোক। তাই প্রথাগত গানের পাঠের বদলে তাঁর কণ্ঠে বর্ষার কিছু গান শোনানোর অনুরোধ করি। আমাদের সেই অনুরোধ রেখেলেন তিনি। ভরা শ্রাবণের সন্ধ্যা। বিজলিবাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছোট্ট সেই ঘরে আমরা ক’জন শ্রোতা। সুরের মূর্ছনায় মগ্ন, অভিভূত। বাইরে ‘ঝরো ঝরো বরিষে বারি ধারা’। গান ধরলেন সুচিত্রাদি। একের পর এক। তাঁর জাদুকণ্ঠে ভেসে এল বাদল দিনের প্রথম কদম ফুলের সুবাস। কখনও আবার আষাঢ় এল আকাশ ছেয়ে। আকুল কান্না ভেজে উঠল সুরের দোলায়—
‘তুমি যেওনা, তুমি যেও না/ আমার বাদলের গান হয়নি সারা’।
আমাদের সঙ্গীতায়নের ছোট্ট ঘরটি যেন পেল অমরাবতীর উত্তরাধিকার। তাঁর কণ্ঠের মূর্ছনায় কেঁপে উঠল বর্ষার সজল প্রহর— ‘আজ নাহি নাহি নিদ্রা আঁখি পাতে’। এরপর সুরের খেয়ায় ভেসে এল বাদল দিনের বেদনা। চোখের জলের জোয়ার লাগল দুখের পারাবারে। সেই অপার্থিব অনুভূতি অর্ধশতক পরে আজও স্মৃতিতে অমলিন।
আজ সুচিত্রা মিত্রের জন্মশতবর্ষের সূচনালগ্নে স্মৃতিচিহ্নিত অনেক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মনে ভিড় করে আসে। অনেক না বলা কথা রইল অকথিত। জীবিতকালেই তিনি ছিলেন কিংবদন্তি। ইতিহাসের সেই মহিমাদীপ্ত বিরল ব্যক্তিত্বকে কত কাছ থেকেই না দেখেছি। পেয়েছি সস্নেহ সান্নিধ্য। এ গৌরব কোথায় রাখব! রবিতীর্থর উত্তর কলকাতা শাখা ছিল আমাদেরই বাড়িতেই। আরও অনেক স্মৃতি, আনন্দ মুহূর্তের সাক্ষী ছিলাম, তা রয়েছে অন্তরে।
জীবনে তিনি নাম, যশ, খ্যাতি, সম্মান অনেক পেয়েছেন। আবার হারিয়েছেনও অনেক কিছু। বেদনার ভারে ভরেছে তাঁর জীবনপাত্র। আর এই বেদনাই তাঁকে দিয়েছে অভিব্যক্তির ঐশ্বর্য! তাঁর নিত্যদিনের প্রভু, প্রিয় রবীন্দ্রনাথের কথা তাঁর জীবনেও সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে—‘যে মানুষ জীবনে দুঃখ পেল না, তার পাওনার ঘর অপূর্ণ রইল।’
কখনও কাউকে না বলা একদিনের স্মৃতি আজ সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি। একবার দেখেছিলাম নিজস্ব নির্জনে নিঃসঙ্গ একক শিল্পীসত্তার বেদনাম্লান মূর্তি। বলেছিলেন— ‘আমি একা, ভীষণ একা, সারাটা জীবন একেবারে শূন্য।’ মনে হল, তাঁর অন্তর যেন বেদনায় দীর্ণ— ‘মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে/ একেলা রয়েছ নীরব শয়ন পরে/ প্রিয়তম হে জাগো, জাগো, জাগো।’ তাঁর সমস্ত জীবন সেই প্রিয়তমের সঙ্গে গানের খেলায় সেতুবন্ধন। জীবনে তিনি কী চেয়েছিলেন? খ্যাতি, প্রতিপত্তি না কবির গানে শান্তি সুধা? গানের সুরে ভেসেই গিয়ে তিনি পৌঁছেছেন তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে—অপরূপ আলোর এক বৃত্তে। সেই আলোর নাম রবীন্দ্রনাথ। তাই একাকিত্বের অবসাদ, নিঃসঙ্গতার অন্ধকারেও তিনি পথ চলেছেন নির্ভয়ে। তাঁর অগণিত শ্রোতারা যেন আজও কান পেতে শুনতে পান দৃপ্ত কণ্ঠের উচ্চারণ—‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে/ তবে একলা চলো রে।’
জীবনপথের সেই সংগ্রামী একলা পথিক, অনন্যা সঙ্গীত সাধিকা সুচিত্রা মিত্রকে তাঁর জন্মশতবর্ষের লগ্নে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও বিনম্র প্রণতি।
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল