সারা পৃথিবীর খবরের শিরোনামে সাবমার্সিবল ‘টাইটান’। টাইটানিক পরিক্রমায় বেড়িয়ে চার ধনকুবের সমেত নিখোঁজ হয়ে যায় সেটি। ভয়ঙ্কর টাইটান-ডুবি নিছকই দুর্ঘটনা নাকি আড়ালে উঁকি মারছে হাড়হিম করা নাশকতার কোনও নীল ছক? তথ্য ও তত্ত্বের চুলচেরা বিশ্লেষণে মৃন্ময় চন্দ।
১৬ই জুন শুক্রবার, কানাডার নিউ ফাউন্ডল্যান্ড থেকে, উত্তর অতলান্তিকের ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে ‘সেন্ট জনস’ দ্বীপের দিকে পাড়ি জমাল বরফ-ভাঙা জাহাজ ‘পোলার প্রিন্স’। সেন্ট জনস থেকে ৯০০ মাইল পূর্বে কেপ কডে পৌঁছতে লাগল দু’দিন। রবিবার, কেপ কডে সূর্যদেব সবে ঘুম ভেঙে আড়মোড়া ভাঙছেন, আকাশ মেঘলা, ঠাণ্ডা শিরশিরে হাওয়া বইছে; ‘পোলার প্রিন্স’ থেকে একটি সাবমার্সিবল জলে নামার তোড়জোড় শুরু করল। যাত্রা শুরুর কথা ছিল ভোর তিনটেয়। কিন্তু দৃশ্যমানতার অভাবে সাতটা বাজল। সাবমেরিন আর সাবমার্সিবলের মধ্যে ফারাক বিস্তর। সাবমার্সিবলের মতো সমুদ্রে ভাসমান বা বন্দরে থাকা কোনও বড় জাহাজের ভরসায় থাকতে হয় না সাবমেরিনকে। তার খোল অ্যালয় স্টিলে তৈরি, যা গভীর সমুদ্রের ভয়ঙ্কর জলের চাপ অক্লেশে সইতে পারে। তবে অতল গভীরে সাবমার্সিবল ছাড়া উপায় নেই। ‘পোলার প্রিন্স’ যে ‘টাইটান’ সাবমার্সিবলটিকে নিয়ে গিয়েছিল, সেটি নাকি অবলীলায় ১৩১২০ ফিট গভীরতায় ডুব দিতে পারত।
অভিশপ্ত টাইটানের যাত্রীরা
২২ ফিট লম্বা, ৯.২ ফিট চওড়া আর ৮.৩ ফিট উচ্চতার ‘টাইটান’ সাবমার্সিবলটির ওজন ছিল ১০ হাজার ৪৩২ কেজি। সাবমেরিনের তুলনায় যথেষ্ট হালকা। ৯৬ ঘণ্টার অক্সিজেন সম্বল করে পাইলট ছাড়া চার হতভাগ্য ধনকুবেরকে নিয়ে কেপ কড থেকে সমুদ্রের অতলে ডুব দেয় সাবমার্সিবলটি। হতভাগ্য কেন? কারণ বিপুল বৈভবে বিত্তশালী চার অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষের সেটাই ছিল শেষযাত্রা। চারজনের দলে পাইলট স্টকটন রাস ছাড়া ছিলেন ব্রিটিশ ধনকুবের, দুবাই নিবাসী কিংবদন্তি পাইলট হ্যামিশ হারডিং, পাক বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ শিল্পপতি শেহজাদা দাউদ ও তাঁর ১৮ বছরের ছেলে সুলেমান দাউদ এবং ৩৫ বার সফল টাইটানিক ধ্বংসাবশেষ অভিযানের নেপথ্য নায়ক, আরএমএস টাইটানিক ইনকর্পোরেশনের অধিকর্তা, ৭৭ বছরের ফরাসি নাগরিক পল-হেনরি নাগোশিলে।
নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের সমুদ্রের প্রায় ১৩,১২০ ফিট গভীরে যেখানে টাইটানিক চিরঘুমে শায়িত, সেখান থেকে ১৬০০ ফিট দূরে, টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে টাইটান। এত গভীরতায় উদ্ধারকাজে কোনও সাবমেরিন অবতরণ করতে না পারায় বাধ্য হয়ে নামাতে হয় ‘রিমোটলি অপারেটেড ভেহিকেল’ ভিক্টর-৬০০০কে।
টাইটানিকের পথে
রবিবার, ১৮ জুন। কেপ কড থেকে টাইটানিক দেখবেন বলে টাইটানে চেপে রওনা হন চার ধনকুবের। ১৪ এপ্রিল ১৯১২; সেদিনও ছিল রবিবার। সাদাম্পটন থেকে নিউ ইয়র্ক যাচ্ছিল রয়েল মেল স্টিমার ‘টাইটানিক’। রাত ১১টা ৪০ মিনিটে জাহাজটি সজোরে ধাক্কা মারে হিমশৈলে। সোমবার রাত ২টো ২০ মিনিটে ১ হাজার ৫৫০ জন আরোহী সহ সলিলসমাধি হয় টাইটানিকের। এর সঙ্গে টাইটানডুবির বেশ সাদৃশ্য রয়েছে। টাইটানিক এবং টাইটানের দুই পাইলট, এডওয়ার্ড স্মিথ এবং স্টকটন রাস দু’জনে আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন গোঁয়ার গোবিন্দ। টাইটানিকের পাইলট স্মিথকে হিমশৈলের অবস্থান জানিয়ে বারংবার সতর্ক করা হলেও, কর্ণপাত করেননি তিনি। তেমনই টাইটানের অজস্র গলদের কথা স্টকটন রাসকে পাখি পড়া করে বলা সত্ত্বেও পাত্তা দেননি তিনি।
দুর্ঘটনা নাকি ষড়যন্ত্র
টাইটান ধ্বংসের পিছনে শুধুই কি পাইলটের গোঁয়ার্তুমি? নাকি চূড়ান্ত অপেশাদারিত্ব, সীমাহীন লোভ আর লাভের দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা? নাকি ১৯৮৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর, সাকলিন দ্বীপপুঞ্জে, কোরিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং ০০৭-কে রাশিয়ার সুখোই-সু মিসাইলে পেড়ে ফেলার মতো কোনও হাড়হিম করা ঘটনা কলকাঠি নেড়েছে টাইটান-ডুবিতে? সে যাত্রায় বিমানকর্মী সহ বোয়িং ৭৪৭-২৩০বির ২৬৯ জন যাত্রীরই মৃত্যু হয়েছিল। যাত্রীবাহী বিমানটি নিউ ইয়র্ক ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছিল সিওলের গিম্পো বিমানবন্দরের দিকে। কানাঘুষো, আমেরিকা নাকি ‘এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলকে’ দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে বিমানটিকে ভুল পথে চালিত করে দু’বার রাশিয়ার অতি স্পর্শকাতর সামরিক ঘাঁটির উপর এনে ফেলেছিল। যাতে রেডারের প্রতিচ্ছবি মারফৎ রাশিয়ার গোপন সামরিক কর্মকাণ্ডের প্রস্তুতির ছবি আমেরিকা খুব সহজেই কব্জা করতে পারে।
টাইটান ধ্বংসেও ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব হাওয়ায় ভাসছে। কারণ, রবিবার ভোর সাতটায় ‘পোলার প্রিন্স’ টাইটানকে জলে নামানোর ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পরেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সন্ধ্যা ৫টা ৪৫ মিনিটে ‘পোলার প্রিন্স’ উপকূল রক্ষী বাহিনীকে জানায় টাইটানের নিরুদ্দেশ হওয়ার সংবাদ! উপকূল রক্ষী বাহিনী অবশ্য নড়েচড়ে বসে ৪৮ ঘণ্টা পর। মঙ্গলবার শুরু হয় ২৬ হাজার বর্গ কিমি ব্যাপী সমুদ্রমন্থন। ওশানগেট কর্তৃপক্ষ থেকে উপকূল রক্ষী বাহিনী—সকলেই কি তাহলে জানত টাইটানের মর্মান্তিক পরিণতির কথা? কৌশলগতভাবে নিউ ফাউন্ডল্যান্ড আমেরিকার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে সীমানা বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিই নয়, উত্তর অতলান্তিকে বাণিজ্য-যোগাযোগ ও বিমান পরিবহণের ক্ষেত্রেও নিউ ফাউন্ডল্যান্ড ও সেন্ট জনসের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ কোনও সামরিক উদ্দেশ্য বা গভীর সমুদ্রে আড়ি পাতার কাজকে মসৃণ এবং নিরঙ্কুশ করতেই কি বলি দেওয়া হল টাইটানকে? জল-স্থল-অন্তরীক্ষে সর্বক্ষণের অতন্দ্র প্রহরায় মাছিও গলতে পারে না যে আমেরিকায়, সেই আমেরিকাই দু’দিন পর টের পেল জলের নীচে সন্দেহজনক কিছু একটা ঘটেছে! কিন্তু সেটা যে চার ধনকুবেরকে নিয়ে টাইটানের গঙ্গাপ্রাপ্তির আভাস, তার পেতেও দ্বারস্থ হতে হল কানাডা-জাপানের? উদ্ধারকাজে নামাতে হল ব্রিটিশ সি-সেভেনটিন, কানাডার পি-থ্রি বিমান এবং ফ্রান্সের ‘আরওভি’ রোবট ভিক্টর-৬০০০কে! কানাডার রিমোট চালিত একটি এবং গভীর সমুদ্রে অভিযানে ওস্তাদ ম্যাগেলান-এর একটি ‘আরওভি’র চিরুনি তল্লাশিতে সমুদ্রের তলদেশ থেকে টাইটানের পাঁচটি ভাঙা টুকরোর হদিশ মিলল। যে আমেরিকা লাস ভেগাস থেকে ৬ হাজার ২৫৯ মাইল পথ উজিয়ে দিনের পর দিন ড্রোনে চুপিসারে আড়ি পেতে লিবিয়ার স্বৈরাচারী শাসক গদ্দাফিকে খতম করতে পারে বা লাদেনকে তুড়ি মেরে নিকেশ করতে পারে, সে নাকি নাকের ডগায় একটা পুঁচকে সাবমার্সিবলের ফেটে ভেঙে খানখান হওয়ার কোনও শব্দই পেল না! সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র দেশ আমেরিকা!
কাঠামোয় বিপত্তি
৫ ইঞ্চি পুরু কার্বন ফাইবার আর ৩.২৫ ইঞ্চি পুরু টাইটানিয়াম পাতে তৈরি পলকা টাইটানের না ছিল গভীর সমুদ্রে নামার ছাড়পত্র, ছিল না কোনও সুরক্ষাকবচও। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে টাইটানের নিরাপত্তা সংক্রান্ত খুঁটিনাটি দেখার ভার বর্তায় ডেভিড লকরিজ নামে এক ব্যক্তির কাঁধে। তিনি প্রথমেই জানান, সমুদ্রের নোনা জলের ঘূর্ণিতে কার্বন-ফাইবার দ্রুত ক্ষইতে থাকে। তার আয়ুও ক্রমশ কমে আসে। সাবমার্সিবল তাই কার্বন-ফাইবারে তৈরি না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। টাইটানের নানা যান্ত্রিক ত্রুটির কথাও তিনি কর্তৃপক্ষের গোচরে আনেন। বিশেষ করে বন্ডলাইন বা যে আঠা টাইটানে ব্যবহৃত হয়েছিল, তা নিয়েও বিস্তর আপত্তি ছিল লকরিজের। তৃতীয় কোনও নিরপেক্ষ ব্যক্তি বা সংস্থাকে দিয়ে টাইটানের স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং জলে নামার ছাড়পত্র জোগাড়ের কথাও বলেছিলেন। ঘোরতর আপত্তি ছিল ভিউপোর্ট নিয়েও। মেরেকেটে ১৩০০ মিটার গভীরতায় নামার উপযোগী ছিল ভিউপোর্টটি, তার বেশি গভীরতায় নামার চেষ্টা করলেই জলের চাপে ভিউপোর্ট ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলেও সতর্ক করেছিলেন তিনি। লকরিজের কথায় কর্ণপাত করা তো দূরঅস্ত, বরং ১০ মিনিটের নোটিসে তাঁকে বরখাস্ত করেন রাস। বিবাদ গড়ায় কোর্টে।
গত ৬০ বছর অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে সাবমার্সিবল নিয়ে কাজ করা সংস্থা ‘মেরিন টেকনোলজি সোসাইটির’ ৩৮ জন সদস্য, ২০১৮ সালের ১৭ মার্চ সর্বসম্মতভাবে একটি খোলা চিঠি লিখে টাইটানের গভীর সমুদ্র যাত্রা থেকে রাসকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেন।
অভিযোগ, বিভ্রান্তিকর চটকদার বিজ্ঞাপনে পর্যটকদের ঠকাচ্ছেন রাস। বিজ্ঞাপনে ফলাও করে রাস বলতেন, টাইটান নাকি নাসা, বোয়িং এবং ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির প্রযুক্তিতে তৈরি। যা ছিল সর্বৈব মিথ্যা। টাইটান কতটা দক্ষতায় গভীর সমুদ্রে ডুবতে পারে, তা পরখ করতে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছিল বাহামার ‘গ্রেট অ্যাবাকো’ দ্বীপে। আচমকা ঝড়-বৃষ্টিতে বাজ পড়ে সমস্ত বৈদ্যুতিন সামগ্রী ও কম্পিউটার নষ্ট হয়ে যায়। সাত মাস লাগে মেরামতিতে। বিদ্যুৎ-ব্যাটারির জোড়াতাপ্পির পর জলে নামানোর পরেই বিকট শব্দে আতঙ্কিত হয়ে তড়িঘড়ি যাবতীয় পরীক্ষানিরীক্ষা স্থগিত রেখে শুরু হয় টাইটানের স্বাস্থ্যপরীক্ষা।
আইনের ফাঁকফোকর
২০১৮ সালে, ফ্লোরিডার এক দম্পতি টাইটানিক দর্শনে রাসকে ১ লাখ ৫ হাজার ডলার অগ্রিম দেন। বারবার নানা প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে যাত্রা ভেস্তে যাওয়ায় টাকা ফেরত চান ওই দম্পতি। কিন্তু রাজি হননি রাস। সেই ঝামেলাও গড়ায় কোর্টে। পিবিএসের সাংবাদিক ডেভিড পোগকে মুচলেকায় জানান, টাইটান একটি পরীক্ষামূলক সমুদ্রযান। শুধু শারীরিক বা মানসিক আঘাত নয়, টাইটানে চড়লে মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নিজ দায়িত্বে, বুঝেশুঝে, টাইটানে চাপার পর কোনও অঘটনের দায়ভারে ওশানগেটকে কখনই দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না।
নানা অভিযোগ-অনুযোগে তিতিবিরক্ত রাস বলেছিলেন, টাইটানের অনন্য-অনুপম নকশা দেখেই নাকি সবার চোখ টাটাচ্ছে। তাই লাল ফিতের ফাঁস ও নানান অসাড় অজুহাতে টাইটানের যাত্রাভঙ্গ করতে চাইছে কিছু ছিদ্রান্বেষী। টাইটানে চেপে গত ৩ বছরে অবশ্য ২৮ জন ভাগ্যবান টাইটানিক পরিক্রমা সেরে নিরাপদেই বাড়ি ফিরেছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, বজ্র-আঁটুনির দেশ আমেরিকায় যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তায় রাশি রাশি গলদের ফস্কা গেরোর প্রমাণ মেলার পরেও সমুদ্রে অবতরণেরঅনুমতি কি করে পেল টাইটান?
গভীর সমুদ্রে সাবমার্সিবল সকলের অগোচরে কখন কোন দেশের সীমা টপকে অন্য দেশের সীমানায় ঢুকে পড়ছে, তা উপকূল রক্ষী বাহিনীর পক্ষে বোঝা মুশকিল। সামুদ্রিক নিরাপত্তা বা উপকূলীয় কোনও আইন সাবমার্সিবলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ফলে হাজার বেচাল দেখেও ১৯৯৩ সালের ‘প্যাসেঞ্জার ভেসেল সেফটি অ্যাক্ট’-এ আমেরিকা পাকড়াও করতে পারে না টাইটানের মতো বেআইনি সাবমার্সিবলকে। জলের তলা দিয়ে এক দেশের সীমানা টপকে অন্য দেশে ঢুকে যাওয়ার কারণেই তাতে কোনও একটি নির্দিষ্ট দেশের পতাকা থাকে না। রাস ২০১২ সালের টাইটানিকের প্রথম শ্রেণীর ভাড়ার সমানুপাতে, ২০২১ সালে, মুদ্রাস্ফীতির হিসেব কষে টাইটানের ভাড়া ঠিক করেছিলেন, ১,০৫,১২৯ ডলার। ২০২৩ সালে সেই ভাড়াই বেড়ে হল ২ লক্ষ ৫০ হাজার ডলার। ভার্জিন গ্যালাকটিকের মহাকাশযাত্রার খরচও সেই সময় ছিল আড়াই লাখ ডলার।
কে এই স্টকটন রাস
সান ফ্রান্সিসকোর এক ধনী পরিবারের সন্তান রাস। বাবা-মা চেয়েছিলেন, সন্তান মহাকাশচারী হবেন। সেইমতো বাবা অ্যাপোলো-১২’র মহাকাশচারী পিট কনরাডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কনরাড তাঁকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাইলটের লাইসেন্স যোগাড়ের পরামর্শ দেন। ১৯৮০ সালে, মাত্র ১৮ বছর বয়সে ফাইটার জেট ওড়াতে শিখে যান রাস। প্রিন্সটনে, এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় গ্রীষ্মাবকাশে রাস বিমান চালাতে যেতেন সৌদি আরবে। তারপর নিজেই তৈরি করেন একটা প্লেন—‘গ্লাসেরাই’। দৃষ্টিশক্তির সমস্যায় নভোশ্চর, এমনকী সেনাবাহিনীর পাইলট হওয়ার বাসনাও ছাড়তে হয় রাসকে। ২০০৪ সালে রিচার্ড ব্র্যানসনের প্রথম বাণিজ্যিক মহাকাশফেরির সফল উড়ান দেখতে ‘মোহাভি’ মরুভূমিতে পৌঁছন রাস। ব্র্যানসনের অবস্থা দেখে মহাকাশ যাত্রায় আগ্রহ হারান তিনি। নটিলাসের ক্যাপ্টেন নিমো নয়, রাসের স্বপ্ন ছিল ‘স্টারট্রেকের’ ক্যাপ্টেন কির্ক হওয়ার। শুরু হল সিয়াটলের সমুদ্রের বরফ-ঠাণ্ডা জলে স্কুবা ডাইভিং। শেষ পর্যন্ত মনঃপূত হল না তাও।
অতল জলের আহ্বানে শুরু হয় রাসের সাবমেরিনের খোঁজ। সারা বিশ্বে খুঁজে তখন আমেরিকা-ফ্রান্স-জাপান-কানাডা মিলিয়ে মাত্র ১০০টি সরকারি সাবমেরিনের খোঁজ মেলে। কোনওটিই ভাড়া দেওয়া হয় না। ২০০৬ সালে নিজেই বানিয়ে ফেললেন ১২ ফিট লম্বা অদ্ভূতদর্শন এক সাবমেরিন। সেটি চালাতে হতো উপুড় হয়ে শুয়ে। সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৫.৫৬ কিমি। রাসের মাথায় ঘুরছিল একটাই বিষয়, পৃথিবীর তিনভাগ জল এবং আমেরিকার অর্ধেকটাই সমুদ্র। অথচ সমুদ্র নিয়ে মানুষের জ্ঞানগম্মি খুবই কম। এখনও পর্যন্ত মাত্র ৫ শতাংশ সমুদ্র জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। সমুদ্র অন্বেষণের ‘ডিপ ডিজিস’ পেয়ে বসে তাঁকে। ২০১০ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলে প্রথম উজ্জ্বল হলুদে ছোপানো ‘ইয়োলো সাবমেরিন’, অ্যান্টিপডিসে, চার জন যাত্রীকে নিয়ে রাস রওনা হন সান্টা ক্যাটলিনা দ্বীপের ১০০০ ফিট গভীরে।
২০১৬ সালে সাইক্লপস-ওয়ান নিয়ে পাড়ি জমান নান্টাকেটে। ইতালির জাহাজ ‘আন্দ্রিয়া ডোরিয়া’ ৪৬ জন যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় ১৯৫৬ সালে। নান্টাকেটের যাত্রীরাও কড়কড়ে গাঁটের কড়ি ফেলে চেপেছিলেন সাইক্লপস-ওয়ানে। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটছিল না। সমুদ্র বললেই রাসের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তিমি, হাঙর আর টাইটানিকের নাম। লাস ভেগাসের ‘লাক্সর হোটেল অ্যান্ড ক্যাসিনো’তে রাস দেখেছিলেন টাইটানিকের সিল না খোলা শ্যাম্পেনের বোতল, পেয়ালা-পিরিচ ও জানলার ফ্রেম। টাইটানিকের অজানা সম্পদ আবিষ্কারে তর আর সইছিল না রাসের। ২০১২ সালে ‘ইউনেস্কো সাইট’ঘোষিত হওয়ায় পর টাইটানিকের কোনও বস্তুতে হাত ছোঁয়ানোর উপায় ছিল না। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে টাইটানিকের পাশে বসে অক্টোপাসদের সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে চাইলেন রাস।
টাইটানের রোজনামচা
১৮ জুন সোনি প্লে স্টেশনের ভিডিও গেম ‘এক্সবক্স-৩৬০র’ জয়স্টিক দিয়ে টাইটানকে চালাচ্ছিলেন স্বয়ং রাস। লিফটের মত বোতাম টিপে আর জয়স্টিকের হাতল ঘুরিয়ে/নাড়িয়ে খোশমেজাজে আত্মঘাতী আত্মবিশ্বাসে টগবগ করতে করতে টাইটানকে নিয়ে ডুব মেরেছিলেন রাস। যাওয়া আসা মিলিয়ে ঘণ্টা পাঁচেকের রাস্তা শেষে নির্বিঘ্নেই গোঠে ফিরে আসার দিবাস্বপ্নে মশগুল রাস সহযাত্রীদের নাকি বলতেন তাঁরাও একবার চালিয়ে পরখ করে দেখতে পারেন কি অত্যাশ্চর্য যান তিনি বানিয়েছেন! তাঁর অগাধ আত্মবিশ্বাসের কারণ এর আগেও দু’বার নানাবিধ যান্ত্রিক ত্রুটি নিরাময়ে টাইটানিকের ভগ্নাবশেষ দেখে অক্ষত শরীরে মূল জাহাজে ফিরে এসেছিল টাইটান। কিন্তু ১৮ জুন বিধি বাম! আর উঠল না টাইটান। গেল অস্তাচলে, দেবতার গ্রাসে!
জুতো খুলে মই বেয়ে ঢুকতে হতো টাইটানে। একটাই ভিউপোর্ট বা ওয়াশিং মেশিনের ঢাকনার মত বড় গোলাকৃতি কাচের জানলা ছিল। সমুদ্রের তলদেশে নোঙর করার পর সেই জানলা দিয়ে দেখতে হতো টাইটানিকের ভগ্নাবশেষ। সুবিশাল জাহাজটি ঠিক যে জায়গাটায় দেহ রেখেছে, তার খুব কাছেই সমুদ্রের তলদেশে ভিড়ত টাইটান। ঘণ্টাতিনেক পর্যটকরা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতেন টাইটানিকের খণ্ডহর। ছবি তোলারও কোনও বিধিনিষেধ ছিল না। পাইলট সমেত চারজন পর্যটক টাইটান-এর অন্দরে প্রবেশের পর ১৭টা বোল্ট দিয়ে টাইটানের প্রবেশপথ বায়ুনিরুদ্ধ সিল করে দেওয়া হতো। অক্সিজেনের অভাব বা যান্ত্রিক গোলযোগে বাইরে বেরনোর কোনও উপায় ছিল না। জলের গভীরে দু’ঘণ্টার যাত্রাপথ নিমেষে পার হয়ে যেত। তিরিশ বা চল্লিশতলা বাড়ির সবচেয়ে উপরের তলা থেকে লিফট যেরকম ঊর্ধ্বশ্বাসে নেমে আসে একতলায় সেরকমই।
‘পোলার প্রিন্স’-এর সঙ্গে প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর এসএমএস এবং একটি ‘বিপ’ ধ্বনির মারফত যোগাযোগ রক্ষা করত টাইটান। সমুদ্রের ৫০ ফিট গভীরতাতেই অচল জিপিএস। ‘জিওডেসিক’ বা ‘সোনার’-এর মাধ্যমে, ডপলার এফেক্টে গভীর সমুদ্রে যোগাযোগ রক্ষা হয়। ‘স্পেস এক্স’-এর স্যাটেলাইট স্টারলিঙ্ক নাকি টাইটানেও ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন করেছিল। গত বছর সিবিএস-এর সাংবাদিক ডেভিড পোগকে টাইটানিকের শোভা দেখাতে আমন্ত্রণ জানায় ওসেনগেট। পোগের বয়ানে, মূল জাহাজের সঙ্গে গত বছরও আড়াই ঘণ্টার জন্য যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল টাইটানের। প্রায় ১৩,০০০ ফিট গভীরতায় প্রবল জলের স্রোতে, নিকষ কালো অন্ধকারে টাইটানিককে খুঁজতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। বরাতজোরে প্রাণে বাঁচেন যান পর্যটকরা। ২০২১ এবং ’২২—দু’বছরই এভাবে ‘পোলার প্রিন্সের’ সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল টাইটানের।
সমুদ্রের ২০০ মিটার গভীরে সূর্যালোক খানিকটা পৌঁছলেও তারপর যত গভীরে নামা, ততই বাড়ে অন্ধকারের প্রাবল্য। তলদেশে থিতু হতে হতে সেই ঘন অন্ধকারে টাইটানের নিভু নিভু আলোয় প্রায়শ দেখা মিলত সমীহ জাগানো অদ্ভুতদর্শন বিশালকায় নানা সামুদ্রিক জীবজন্তুর। সাবমার্সিবলের যাত্রীদের স্যান্ডউইচ জাতীয় হাল্কা খাবার ও জল সরবরাহ করা হতো। তবে বলে দেওয়া হত বুঝেশুনে খেতে, যাতে টয়লেট ব্যবহারের প্রয়োজন না পড়ে। যদিও একটা পর্দা ঢাকা টয়লেট অবশ্য ছিল। সেটা পিছনে, টাইটানের মূল দেহখণ্ড থেকে আলাদা করা। কয়েকটা ভাঙাচোরা পাইপ জুড়ে ভারসাম্য (ব্যালাস্ট) বজায় রাখা হতো। রাস বলতেন, এমন কিছু ফেলে দেওয়া উপকরণে টাইটান তৈরি, যা সুস্থ মাথায় কল্পনা করাও মুশকিল। আর অচিরাচরিত উপকরণে তৈরি বলেই নাকি তা একমেবাদ্বিতীয়ম। ১৮ জুনই প্রথম নয়, আগে দু’বার টাইটানিকের কাছে সফল অবতরণ করেছিল টাইটান। ৫০ বার টেস্ট ডাইভও নাকি সারা হয়েছিল। তবে কোনওবারই সম্পূর্ণ নির্বিঘ্নে অবতরণ সুসম্পন্ন হয় নি। ১৮ জুন জলে ডুব মারার ঠিক ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট বাদে পোলার প্রিন্স-এর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় টাইটানের। সে যোগাযোগ আর পুনর্স্থাপন করা যায়নি।
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়