প্রচ্ছদ নিবন্ধ

ঘাতক বাহিনী
পুতিনের ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন!

‘মার্সেনারি’-র অর্থ ভাড়াটে সেনা। মধ্যযুগ থেকেই ইউরোপে দেখা গিয়েছে তাদের দাপট। এই আধুনিক যুগেও ‘মার্সেনারি’দের বেজায় কদর। সময় পাল্টেছে। তবে নোট ফেললে আজও হাজির করা যায় তাদের। বিশ্বের কুখ্যাত সেই সব মার্সেনারি বাহিনীর অজানা কাহিনিই লিখলেন মৃণালকান্তি দাস।

দশ হাজার গ্রিক যোদ্ধাকে নিয়ে ‘মার্সেনারি’ বাহিনী গঠন করেছিলেন ‘সাইরাস দ্য ইয়ঙ্গার’। অ্যাকেমেনিড সাম্রাজ্যে সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় ভাড়াটে সেনাবাহিনী। ‘টেন থাউজেন্ড’ নামে সেই বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন সক্রেটিসের শিষ্য জেনোফোন। ইতিহাস অবশ্য তাঁকে চেনে এথেন্সের ইতিহাসবিদ-দার্শনিক হিসেবেই।
পরে জেনোফোন তাঁর বিখ্যাত বই ‘অ্যানাবেসিস’-এ লিখেছেন, সাইরাস দ্য ইয়ঙ্গারের মূল উদ্দেশ্য ছিল তাঁর ভাই রাজা দ্বিতীয় আর্টক্সারক্সেসকে পারস্যের সিংহাসন থেকে উৎখাত করা। যুদ্ধ শুরু হয় ব্যাবিলনের উত্তরে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে। সেই কুনাক্সার যুদ্ধে ভাড়াটে ‘টেন থাউজেন্ড’ বাহিনী পারস্যের রাজার বিরুদ্ধে তুমুল লড়াই করে। রণাঙ্গনের জমি যখন তারা দখল করা শুরু করেছে, তখনই যুদ্ধে নিহত হন সাইরাস। নেতাকে হারিয়ে ভাড়াটে বাহিনীর জেনারেল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে খুন হতে হয় ‘টেন থাউজেন্ড’ বাহিনীর জেনারেলকে। আর্টক্সারক্সেসের সেনাবাহিনীর কবল থেকে টেন থাউজেন্ড বাহিনীকে বেঁচে ফিরতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। কঠিন মুহূর্তে ভাড়াটে বাহিনী জেনোফোনকে নতুন নেতা ঘোষণা করে। দীর্ঘ ন’মাসের লং-মার্চ শেষে তারা ব্যাবিলন থেকে গ্রীক ব্ল্যাক সি বন্দরে পৌঁছয়। ১৯৭৯ সালে সেই ঘটনা নিয়ে মার্কিন পরিচালক ওয়াল্টার হিল তৈরি করেন বিখ্যাত সিনেমা ‘দ্য ওয়ারিয়র্স’।
ভ্লাদিমির পুতিন জেনোফোনের ‘অ্যানাবেসিস’ পড়েছেন কি না, জানা নেই। তবে ‘মার্সেনারি’ বাহিনী গড়ার প্রয়োজন উপলব্ধি করেছিলেন এই প্রাক্তন কেজিবি অফিসারও। কিন্তু কে গড়বে সেই গোপন বাহিনী? খোঁজ পেয়েছিলেন দিমিত্রি উটকিনের। রুশ গোয়েন্দা বিভাগ ‘গ্রু’-র অভিজ্ঞ কর্মী উটকিন চেচেন যুদ্ধে লড়াই করার পরে অভিজাত ‘স্পেৎসনাজ’ বা বিশেষ বাহিনী ইউনিটের কমান্ড হিসেবেও কাজ করেছেন। ফলে ‘গ্রু’-র গোয়েন্দা দপ্তরের কাছে ‘মার্সেনারি’ বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করতে কোনও সমস্যা হয়নি উটকিনের। সম্পর্ক গড়ে তোলেন রুশ সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গেও। বাহিনীর নাম দেওয়া হয় ‘ওয়াগনার’। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, লিবিয়া, সিরিয়া ও ভেনেজুয়েলা থেকে রুশ বাহিনীর জাহাজে করে ওয়াগনারের কর্মীদের আনা শুরু হয়। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের অভিযোগ, ইউক্রেনে মাটিতে যুদ্ধ চালানো ওয়াগনারের প্রায় ৮০ শতাংশ সদস্যকে নেওয়া হয়েছে কারাগারে বন্দি অপরাধীদের থেকে বাছাই করে। রুশ সেনার পক্ষ থেকেই তাদের সরঞ্জাম ও রসদ সরবরাহ করা হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সঙ্গে যুক্ত একটি বিশেষ ডেস্ক থেকে দেওয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করেন ওয়াগনার কর্মীরা। ২০২০ সালে বেলারুশ যখন ৩৩ জন রুশ নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছিল, তখন পুতিন তাদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। যাঁরা সম্ভবত ওয়াগনার গ্রুপের সদস্য ছিলেন। রুশ বিশ্লেষকরা অনেকেই বলেন, ক্রেমলিনের সঙ্গে ওয়াগনার বাহিনীর যোগসূত্র নিছকই কল্পনা।
আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পিএমসি ওয়াগনার’ নামে পরিচিত ওয়াগনার গ্রুপের প্রথম খোঁজ মেলে ২০১৪ সালে। সেই সময় পূর্ব ইউক্রেনে ডনবাস অঞ্চলে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্য করছিল তারা। ওয়াগনার যোদ্ধারা তখন আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যেও সক্রিয়। রাশিয়ার আইন অনুযায়ী এই ধরনের ভাড়াটে সেনা ব্যবহারের কোনও সুযোগ নেই। তবে ২০১৮ সালে পুতিন ভাড়াটে সেনার অস্তিত্ব স্বীকার করে জানান, তাঁদের কাজকর্ম রাশিয়ার বাইরে। সংবিধানে না থাকলেও সম্প্রতি রাশিয়ান পার্লামেন্টে ওয়াগনার গ্রুপের মতো সংগঠনগুলিকে একটি আইনি ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। পুতিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সিরিয়ার যুদ্ধেও তিনি এই ওয়াগনার বাহিনীকে কাজে লাগিয়েছিলেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে ওয়াগনার বাহিনী। পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয় যে তাদের যাবতীয় আর্থিক সাহায্য করা বন্ধ করে দিতে চায় রুশ প্রশাসন। সেই সময় দৃশ্যপটে হাজির হন পুতিনের এক বিশ্বস্ত বন্ধু। ইয়েভজেনি প্রিগোজিন। পুতিন-ঘনিষ্ঠ রাশিয়ার এই অভিজাত ধনকুবের হয়ে ওঠেন ওয়াগনার বাহিনীর মূল পৃষ্ঠপোষক। ভাড়াটে যোদ্ধা রাশিয়ায় অবৈধ হলেও ২০২২ সালে কোম্পানি হিসেবে রেজিস্ট্রেশন হয় ওয়াগনার গ্রুপের। সদর দপ্তর খোলা হয় সেন্ট পিটার্সবার্গে। রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট থিঙ্ক ট্যাঙ্কের স্যামুয়েল রামানি জানিয়েছেন, রাশিয়ার শহরগুলিতে হোর্ডিং লাগিয়ে প্রকাশ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালিয়েছে এই গ্রুপ। নেপথ্যে একজনই—প্রিগোজিন।
ছোটবেলায় তাঁর স্বপ্ন ছিল ‘ক্রস-কান্ট্রি স্কিয়ার’ হওয়ার। কিন্তু জীবন বয়ে যায় উল্টো খাতে, অপরাধের জগতে। ১৮ বছর বয়সে চুরি করতে গিয়ে প্রথম ধরা পড়েন প্রিগোজিন। জেল হয়। দু’বছরের মধ্যে ফের ধরা পড়েন। অভিজাত আবাসনে ডাকাতির ডাকাতির অভিযোগে। ১২ বছরের জেল। ন’বছর জেল খেটে ১৯৯০ নাগাদ মুক্তি পান তিনি। জেল থেকে বেরিয়ে শুরু করেন হটডগ বিক্রি। লেনিনগ্রাদে। পা রাখেন রেস্তরাঁ ব্যবসাতেও। খাবারের বৈচিত্র্যের কারণে অভিজাত শ্রেণির নজর কাড়ে তাঁর রেস্তরাঁ। প্রিগোজিনের হাতের জাদুতে মুগ্ধ হন স্বয়ং পুতিন। রাশিয়ায় সফররত ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জাক শিরাককে নিয়ে প্রিগোজিনের রেস্তরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন পুতিন। স্কুলে খাবার পাঠানো থেকে অভিজাত রেস্তরাঁয় খাবার সরবরাহ— সবেতেই প্রিগোজিনের ‘কনকর্ড কেটারিং’।
পুতিনের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় সুবাদে একসময় গুরুত্বপূর্ণ মিশনের দায়িত্ব পড়ে প্রিগোজিনের উপরে। দ্রুত খুলে ফেলেন ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সি। সংস্থার মাধ্যমে ২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার জন্য আমেরিকার ফেডারেল গ্র্যান্ড জুরি ১৩ জন রুশ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করেছিল। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রিগোজিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনে মিথ্যে প্রচার করেছিল ‘ট্রল ফ্যাক্টরি’। তার দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। রাশিয়া অবশ্য কখনও এসব স্বীকার করেনি। 
পূর্ব ইউক্রেনে ক্রেমলিনের সাফল্যের অন্যতম কারণ ওয়াগনার যোদ্ধারা। এ বছরের গোড়ায় ওয়াগনারের নেতৃত্বে সোলেডার দখল করে রাশিয়া। সেই থেকেই টানাপোড়েন শুরু। বিবাদ সত্ত্বেও বাখমুতের যুদ্ধে রাশিয়াকে অভূতপূর্ব সাফল্য এনে দেয় ওয়াগনার বাহিনী। ক্ষয়ক্ষতি হয় প্রচুর। লাশের পাহাড়কে পিছনে রেখে রাশিয়াকে হুমকি দিয়েছিলেন প্রিগোজিন। অভিযোগ করেছিলেন, রাশিয়ার সেনা ওয়াগনার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। হাজার হাজার যোদ্ধার প্রাণ গিয়েছে। তাঁর বাহিনীর সদস্যদের মৃত্যুর জন্য রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভকে দায়ী করে হুমকিও দিয়েছিলেন তিনি। নিশ্চিত প্রিগোজিন হলিউডের সিনেমা ‘দ্য ওয়ারিয়র্স’ দেখেননি। দেখলে ভুলটা করতেন না!
রুশ সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ওয়াগনার বাহিনীর একাংশ। প্রিগোজিন সামরিক বাহিনীর ‘শেষ দেখে ছাড়বেন’ বলে ঘোষণা করেন। তারপরেই মস্কো অভিমুখে যাত্রা শুরু। সে পথে হাঁটতে হাঁটতেই দক্ষিণ রাশিয়ার রস্তভ-অন-ডন শহর দখল করে তাঁর বাহিনী। তারপর আবার মস্কোর দিকে এগতে থাকে ওয়াগনার। যদিও ওয়াগনারের অপারেশনাল কমান্ডার সের্গেই সুরোভিকিন দুর্নীতিগ্রস্ত প্রিগোজিনের বিদ্রোহ সমর্থন করেননি। কিয়েভ দখলের দায়িত্ব যে ভাড়াটে বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন পুতিন, সেই ‘বন্দুকের নল’ ঘুরে গিয়েছিল তাঁরই দিকে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের মতে, পুতিনকে কখনও এত দুর্বল দেখা যায়নি। কিন্তু রাত বাড়তেই ঘুরে যায় খেলা। আসরে নামেন বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কো। ক্রেমলিনের মুখপাত্র ঘোষণা করেন, বিদ্রোহে ইতি টেনে বেলারুশ ফিরে যাচ্ছেন প্রিগোজিন। মস্কো থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে থামে অভিযান। কিন্তু তাঁর ‘স্বল্পস্থায়ী সেনা অভ্যুত্থান’ ক্রেমলিনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে বলে মত অনেকেরই। ধাক্কা লাগে পুতিনের ‘স্ট্রংম্যান’ ভাবমূর্তিতেও। প্রিগোজিন যে ‘পুতিনের ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ তা স্পষ্ট হয়ে যায়। ‘রণে ভঙ্গ’ দিয়ে ‘অজ্ঞাতবাসে’ যাওয়া প্রিগোজিন অবশ্য অডিও বার্তায় দাবি করেন, বিদ্রোহ নয়, পুতিন সরকার এবং তাঁর সেনার আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পথে নেমেছিল ‘ওয়াগনার’ বাহিনী।
যদিও আমেরিকার সামরিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘ইনস্টিটিউট ফর দি স্টাডি অব ওয়্যার’-এর দাবি, ক্রমশ ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠা প্রিগোজিনকে ফাঁদে ফেলতেই ওয়াগনার যোদ্ধাদের একাংশের সাহায্যে ‘বিদ্রোহের চিত্রনাট্য’ তৈরি করেছিলেন পুতিন! রুশ গোয়েন্দা সংস্থা ‘ফেডারেল সিকিওরিটি সার্ভিস’ (এফএসবি) সূত্রে খবর, গত জানুয়ারি থেকেই প্রিগোজিন ইউক্রেনীয় গোয়েন্দাদের (হার মো) জালে আটকে পড়েছেন। সূত্রের দাবি, আফ্রিকায় থাকাকালীন ইউক্রেনীয় গোয়েন্দাদের সঙ্গে বৈঠক হয় প্রিগোজিনের। শেষ কথা অবশ্য বলেছেন সিএনএনের মস্কোর প্রাক্তন ব্যুরো প্রধান জিল ডগার্টি— ‘ভ্লাদিমির পুতিন এই বিশ্বাসঘাতকদের ক্ষমা করেন না।’
14Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বহু প্রচেষ্টার পর আটকে থাকা কাজের জটিলতা মুক্তি। কৃষিজ পণ্যের ব্যবসায় বিশেষ উন্নতি। আয় বাড়বে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৪ টাকা৮৪.৮৮ টাকা
পাউন্ড১০৮.২৩ টাকা১১১.৭৮ টাকা
ইউরো৯১.১৫ টাকা৯৪.৩৪ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা