২২ মার্চ, ১৯৩৩। জন্ম নিল এক নরক। কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। আমেরিকার হলোকাস্ট মিউজিয়ামে সযত্নে রক্ষিত হিটলারি আতঙ্কের স্মৃতি। আজ সেই সংগ্রহশালা ও ক্যাম্পেরই অজানা কাহিনি।
নাম জন। পুলিসি অত্যাচারে জর্জ ফ্লয়েড, টায়ার নিকোলাসের মর্মান্তিক মৃত্যু এবং পরবর্তীতে আমেরিকাজুড়ে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের সাক্ষী এই কৃষ্ণাঙ্গ নিরাপত্তারক্ষী। তবু মার্কিন স্থাপত্যের সুরক্ষার দায়িত্ব-কর্তব্যে অবিচল। মেটাল ডিটেক্টরের সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পরও জামা-প্যান্টের পকেট, জুতো, রুমাল, মানিব্যাগে নিয়মমাফিক খানাতল্লাশি। ঠোঁটের কোণে একচিলতে স্বস্তির হাসি। ইউনিফর্মে লাগানো ওয়াকিটকিতে নিচু স্বরে ‘অল ক্লিয়ার’ বলে আঙুলের নির্দেশিকায় ছোট্ট মন্তব্য, ‘লিফট ওদিকে...’।
নামে লিফট হলেও, আকার-গড়ন দেখে গ্যাস চেম্বার ভাবলে এতটুকু ভুল হবে না। পাশাপাশি নয়, হাল্কা শব্দ করে ইয়া মোটা কাঠের দরজা খোলে উপর-নীচে। অবিকল ইলেকট্রিক চুল্লির মতো। ‘টিনের বাক্সের’ ভিতরের গন্ধটাও নাকে লাগতে বাধ্য। ঠিক যেন মানুষ পোড়ানো হচ্ছে। দরজা বন্ধ হওয়ার সময় লিফটের কেয়ারটেকার বললেন, ‘চারতলা থেকে শুরু করবেন। এখানেই আবার দেখা হবে। হোপ ইউ উইল সারভাইভ...’।
‘সারভাইভ’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ অস্তিত্ব রক্ষা। কিন্তু মার্কিন রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির হলোকাস্ট মিউজিয়ামে তার অন্য মানে—বেঁচে থাকা, বেঁচে ফেরা। ১৯৮০ সালে তৈরি এই সংগ্রহশালা। নাৎসি নৃশংতার ইতিহাসের বর্ণনা শুরু প্রবেশপথেই। দেওয়ালজুড়ে লেখা ‘The Holocaust’, যার অর্থ নৃশংস হত্যাকাণ্ড। ঠিক সেটাই যেন ফুটে উঠেছে পাশের ছবিতে। গণচিতাটি দৈর্ঘ্যে অন্তত বিশ ফুট। সামনে দাঁড়িয়ে বন্দুক হাতে হাসি-ঠাট্টায় মত্ত নাৎসিরা। স্পট লাইটের আলো-আঁধারিতে তাদের বর্বর উল্লাস মেরুদণ্ডে শিরশিরানি ধরাতে বাধ্য করে। ভয় আরও গাঢ় হবে চারতলায়। লিফট থেকে নামতেই ডানদিকে কাচের দেওয়াল। বড় বড় অক্ষরে খোদাই করা এসএস কমান্ডান্ট রুডলফ হসের বয়ান। গণহত্যার ‘সর্বশ্রেষ্ঠ পরিকাঠামো’ গ্যাস চেম্বার দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৪৭ সালে যুদ্ধপরবর্তী স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘এক মহিলার কথা মনে আছে। গ্যাস চেম্বারের দরজা বন্ধ হওয়ার সময় নিজের সন্তানকে ছুড়ে বাইরে ফেলতে চাইছিলেন। সঙ্গে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না... গলায় আর্তি, আমার বুকের ধনকে অন্তত বাঁচতে দেওয়া হোক।’
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসেবে যোগ দেওয়া অ্যাডলফ হিটলার জার্মানির মসনদে বসেন ১৯৩৩ সালে। শুরু হয় জার্মান সংস্কৃতির ‘শুদ্ধিকরণ’। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ইতিহাস যার অন্যতম অঙ্গ। হলোকাস্ট মিউজিয়ামের প্রতিটি তলে সবিস্তারে বর্ণিত সেই নৃশংসতা, বর্বরতা, যা শুধু চোখে দেখার নয়, অনুভবেরও। চারতলা থেকে তিনতলায় নামার পথে রাস্তা আটকাবে একটি লেভেল ক্রসিং। রং হলুদ-কালো হলেও, কাছে গেলেই কমলা সতর্কবার্তা। পাশে সরু জায়গা। কোনওক্রমে শরীর গলিয়ে অনুপ্রবেশের জন্য। ‘কাঁটাতার’ পেরলে পা থমকাবে কালচে-লাল রঙের মোটা বর্ডার লাইনে। তার উপর দপদপ করে জ্বলছে উজ্জ্বল লাল আলো। আর সামনে দু’টো বিশাল মানচিত্র। হিটলার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী জার্মানির। কতটা আগ্রাসন, এক লহমায় বুঝে ফেলা যায়।
মিউজিয়ামের তিনতলায় চোখে পড়বে একটি কাচের বাক্স। ভিতরে ডাঁই করা বই। বামপন্থী লেখক, মার্কিন লেখক, ইহুদি লেখক, মনস্তত্ত্ববিদ—কার লেখা নেই সেখানে! ‘শুদ্ধিকরণ’-এর শুরু এখান থেকেই। বই পুড়িয়ে বন ফায়ার। নাৎসিদের ভাষায় যা পরিচিত ‘The Burning of Books’ নামে। দেশের প্রতিটি শহরের গ্রন্থাগার এবং বইয়ের দোকানে তল্লাশিতে নেমেছিল নাৎসির ছাত্র সংগঠন। খুঁজে খুঁজে বের করা হয় মার্কস, লেনিন, ট্রটস্কি, লুক্সেমবার্গের লেখা বই। ইহুদি লেখক ফ্রানজ ওয়েরফেল, স্টেফান জিউইগ তো বটেই, বাদ যায়নি আলবার্ট আইনস্টাইন, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, সমকামিতা নিয়ে ম্যাগনাস হিরসফেল্ডের লেখাও। না বাজেয়াপ্ত নয়, জার্মান সংস্কৃতিকে ‘কলুষিত’ করা এই বইগুলি সরাসরি আগুনে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল। শুধু পুড়িয়ে ফেলা বললে হয়তো কম বলা হবে। বলা ভালো জিঘাংসা চরিতার্থ করছিল নাৎসিরা, যার পিছনে লুকিয়ে ছিল এক পৈশাচিক আনন্দ। ১০ মে, বার্লিন ইউনিভার্সিটির মূল প্রবেশপথের উল্টোদিকে অবস্থিত অপেরা হাউসে যখন এই নিধনযজ্ঞ চলছে, সেখানে উপস্থিত জার্মান সরকারের প্রচারমন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলস। সদর্পে ঘোষণা করছেন, ‘ইহুদি বুদ্ধিজীবীদের জমানা শেষ। আগুনে পুড়ছে সেই অতীত।’ সেই ঘটনার নিন্দা করে মার্কিন সমাজকর্মী হেলেন কেলার যা বলেছিলেন, কাচের বাক্সের নীচে ক্যাপশন করে সংরক্ষণ করা হয়েছে সেই অমোঘ উক্তিও—‘স্বৈরাচার কখনও আদর্শের শক্তিকে পরাজিত করতে পারে না।’
হ্যাঁ, মতাদর্শ ধ্বংসই মূল লক্ষ্য ছিল হিটলারের নাৎসি বাহিনীর। কারণ, বই পুড়িয়ে ফেলার পর তাদের টার্গেট ছিল কমিউনিস্ট পার্টি অব জার্মানির নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। মূলত তাঁদের আটকে রাখার জন্য ওই বছরই (১৯৩৩) তৈরি হয় প্রথম কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। মিউনিখ থেকে একটু দূরে দাচাউ শহরে। নাৎসিদের আগ্রাসনের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এমন শিবির সংখ্যা। জার্মানি এবং জার্মান অধিকৃত ইউরোপে প্রায় এক হাজার ক্যাম্প খোলা হয়েছিল। বিশ্বের হিসেব ধরলে সংখ্যাটা প্রায় ৪৪ হাজার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেখানে অত্যাচার চরমে ওঠে।
কীভাবে ব্যবহার হতো এই ক্যাম্পগুলি? সেই বর্ণনা মেলে মিউজিয়ামের তৃতীয় তলের অপর প্রান্তে। সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি করা ক্যাম্পের রেপ্লিকায়। বাইরে খুপরির মতো কিছু গর্ত। কিন্তু তা আদতে জানলা নয়। সেগুলি তৈরি করা হয়েছিল গুলি ছোড়ার জন্য। মিউজিয়ামের বর্ণনা বলছে, মাটির নীচে স্নানঘর বানিয়ে তাতে ঠুসে দেওয়া হতো বন্দিদের। উলঙ্গ করে। গাদাগাদি ভিড় নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে, দরজা সিল করে দেওয়া হতো। এরপরই শুরু ‘নৃশংস মজার খেলা’। দেওয়ালের ওই বিশেষ ছিদ্র দিয়ে ছাদ লক্ষ্য করে ছররা বন্দুক দিয়ে ছোড়া হতো সায়নাইড যুক্ত কীটনাশক ‘জাইক্লোন বি’। ছাদ ফুটো হয়ে বেরত বিষাক্ত গ্যাস। বেশিক্ষণ তা সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না অভুক্ত, অনাহারে থাকা শরীরগুলোর। মেরেকেটে দু’-তিন মিনিট। খেলা শেষ। তবুও নাছোড়বান্দা নাৎসিরা। প্রতিটি মৃত্যু নিশ্চিত করতে ২০ মিনিট সিল থাকত গ্যাস চেম্বার। তারপর ভেন্টিলেটর খুলে, বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বের করা হতো তাল তাল মৃতদেহ। আর, গ্যাস চেম্বারের প্রবেশপথে পড়ে থাকত নিরাপরাধ বন্দিদের শেষ চিহ্ন, গাদা গাদা জুতো। সেই ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে ঠিক তার পাশের ঘরেই। ঢুকলেই চামড়ার একটা বোঁটকা গন্ধ নাকে আসবে। কারণ, অবিন্যস্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে কয়েক হাজার জুতো। দেওয়ালের গায়ে স্টিলের ফলকে লেখা রয়েছে ইহুদি কবি মোজেস শুলসটেনের ব্যাখ্যা—‘আমরা জুতো। শেষ প্রত্যক্ষদর্শী। প্রাগ, প্যারিস, আমস্টারডামের দাদু-ঠাকুরদা-নাতি নাতনিদের শেষ চিহ্ন। আমরা প্রত্যেকে ওই নৃশংসতার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছি, তার কারণ একটাই। আমরা চামড়া এবং ফেব্রিক দিয়ে তৈরি... রক্ত-মাংসের নই।’
এই বন্দিদের অধিকাংশই মূলত আউসভিৎস থেকে আগত। দক্ষিণ-পশ্চিম পোল্যান্ডের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোকে এই নামেই ডাকত নাৎসিরা। গোরু-ছাগলের মতো ট্রেনে তোলা হতো বন্দিদের। কাঠের কামরা, পাটাতনও কাঠ দিয়ে তৈরি। মিউজিয়ামের একতলায় সংরক্ষিত সেই কামরার কাছে যেতে হয় একটি ব্রিজ পেরিয়ে। সেটিও প্রতীকী। ট্রেনে ওঠানো-নামানোর সময় বন্দি ইহুদি বা বামপন্থীদের জন্য নির্দিষ্ট রাস্তা যাতে মাড়াতে না হয় জার্মানদের, তাই ব্রিজের ব্যবস্থা করেছিল হিটলার প্রশাসন। ট্রেনের কামরার ভিতর কাঠের মচমচ শব্দ কানে আর্তনাদের মতো বাজে। দেখা মেলে সাড়ে ৬ ফুট উচ্চতার সেই খাটের। যেখানে তিনটি তলে রাখা হতো তিনজনকে। তাঁরা না পারতেন শুতে, না বসতে। প্রবল শীতে জুটত একটা ফিনফিনে কম্বল। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর ওটাই ছিল দু’দণ্ড বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা। খাবার কী জুটত সেখানে? না, এই ইতিহাস সংরক্ষিত নেই। বরং জায়ান্ট স্ক্রিনে তুলে ধরা হয়েছে ক্যাম্প থেকে বেঁচে ফেরা গুটিকয়েক লোকজনের সাক্ষাৎকার। অর্ধচন্দ্রাকৃতি ছোট অডিটরিয়ামে বসে শোনা যায় দু’টুকরো পাউরুটি আর একবাটি ডালের সেই গল্প। সেই ‘অমৃতসম’ খাবারের ভাগাভাগি নিয়ে বাপ-ছেলের খুনোখুনির কাহিনি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে দুই বন্ধুর পরিণতমনস্কতার ছবি। সেই দুই বন্ধু, যাঁদের গোপন পরিকল্পনায় প্রথমবার আঘাত হানা গিয়েছিল নাৎসি দুর্গে। পাথর ঘষে তৈরি অস্ত্রে বদলা নিয়েছিলেন তাঁরা। বাহিনীর কমান্ডান্টের দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি আজও। বরং ভয় ধরানো গিয়েছিল নাৎসিদের মননে। পতনের...।
সেই স্বপ্ন বাস্তব হয় ১৯৪৫ সালে। কয়েক লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। আর কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে জীবন্মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয় কয়েকজনকে। সেই সৌভাগ্যবানদের তালিকায় অবশ্য ছিলেন না লিন্ডার পূর্বপুরুষরা। শিক্ষামূলক ভ্রমণে এসেছিল ক্যালিফোর্নিয়ার এই কলেজ ছাত্রী। শুধুমাত্র মায়ের কথা রাখতেই তার এখানে আসা। কী সেই কথা? লিন্ডা জানাল, ‘মা বলেছেন, বাবা-ঠাকুরদা ঠিক কতটা কষ্ট পেয়েছিলেন, এটা তোমার জানা দরকার। প্রত্যক্ষ করা দরকার।’ লিন্ডার সঙ্গে প্রথম দেখা সেই অডিটরিয়ামে। চোখের কোণে চিকচিক করছিল জল। চশমার ফাঁক দিয়েও তা স্পষ্ট। নৃশংসতার ‘যাত্রাপথ’ শেষে শহিদ শিখার সামনে আর নিজেকে সামলাতে পারেনি লিন্ডা। বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তাকে সামলাতে এগিয়ে আসেন শিক্ষিকা। তাঁর সান্ত্বনাতেই খানিকটা ধাতস্থ হয় লিন্ডা। চশমা খুলে, চোখ মুছতে মুছতে অস্ফূটে বলতে থাকে, ‘এখন বুঝতে পারছি, মা কেন মাঝরাতে উঠে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত...’।