আমরা যা খাই বা গ্রহণ করি, তা যখন দেবতাকে দিই, তখন তাকে বলে নৈবেদ্য। বাড়িতে কেউ এলে তাকে যেমন আমরা হাত-পা ধোয়ার জল দিই, আসন দিই, কিছু খেতেও দিই। সেইরকম পুজোর সময় যে দেবতাকে আমাদের ভদ্রাসনে ডেকে আনি তাঁকেও নানা আচারে-উপচারে সম্মানিত করতে চাই। নৈবেদ্য সেই অনেক উপচারের একটি। দুর্গাপুজোতে নৈবেদ্যর বহর অনেকখানি, তাতে আবার তিথিভেদে বৈচিত্র্যও আছে। ‘কালিকাপুরাণ’ মতে, প্রশস্ত ও পবিত্র নিবেদনীয় বস্তু দেবীকে সমর্পণ করতে হবে। তার মধ্যে ভক্ষ্য, ভোজ্য, লেহ্য, পেয় ও চোষ্য থাকতে হবে। ‘শাক্তানন্দতরঙ্গিণী’তে দেবীকে কী ভোগ দিতে হবে বলা হয়েছে। তার মধ্যে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী— সব পুজোতেই যা দেওয়া ভালো তা হল, চিঁড়ে, খই, চালভাজা, ঘি দিয়ে পাক করা হয়েছে এমন খাবার এবং ঘি দেওয়া পায়েস। আর যা দিলে মন সন্তুষ্ট হয় তেমন কিছু নৈবেদ্য। দেবপুজোয় যা বাঞ্ছিত তাই দেওয়া উচিত। ছোট ছেলেরা যা ভালোবাসে সেরকম খাদ্য মাকে দিতে হয়। যে বস্তুটি নিজের অপ্রিয় সেটি মাকে দিতে নেই। যা স্ত্রীদের প্রীতিকারক তা দিতে হয়। আর মাকে পান নিবেদন করলে মা খুবই খুশি হন।
ষষ্ঠী
ষষ্ঠীপুজোর সময়ই মা আমাদের আঙিনায় আসেন। আমন্ত্রণ, অধিবাস ও বোধন পর্বের সূত্রেই মহাপূজার সূচনা হয়। তখন থেকেই দেবী দুর্গা ও অন্যান্য আবাহিত দেবতাদের কিছু ভোগ নিবেদন করতে হয়। দুর্গাপুজোর প্রতিদিনই মূল পুজো শুরু হয় অবশ্য ভূত, প্রেত, পিশাচদের পুজো করে! তারপর একটি বেলপাতায় মাষকলাই, দই, হলুদ, ঘি ওই ভূতপ্রেতের উদ্দেশে নিবেদন করে অনুষ্ঠিত হয় ভূতাপসারণ। এরপর আরম্ভ হয় মূল পুজো। ষষ্ঠীতে পঞ্চদেবতা ও দেবী দুর্গাকে নিবেদন করা হয় বিভিন্ন ফল, মিষ্টি ও আতপ চাল।
সপ্তমী
সপ্তমীতে কোনও জলাশয়ে বা নদীতে নবপত্রিকা স্নান করিয়ে নিয়ে আসার পর পুজোমণ্ডপেও একটি সংক্ষিপ্ত স্নান হয়। স্নানের জন্য নানা উপকরণ লাগে। সেগুলিও প্রকৃতপক্ষে দেবীর উদ্দেশে নিবেদিত হয়। ‘কালিকাপুরাণে’ দেবীকে যা নিবেদন করতে হয় সেই তালিকায় মুখ ধোয়ার দাঁতন, সুগন্ধী তেল, পঞ্চকষায়, ধূপ, দীপ, অলঙ্কার, মালা, সিঁদুর এমনকী কাজলেরও উল্লেখ করা হয়েছে। সেই কাজল কীভাবে তৈরি করতে হবে, কে করবেন সব বলে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, মাটির পাত্রে চোখের কাজলের যেন কোনও যোগ না হয়। কোনও কারণে হলে পুজোর ফলটাই পাওয়া যাবে না! ধূপ দিলে মা চতুর্বর্গ দেন আর কাজল দিলে ভক্ত যা চায়, মা তাই দেন।
এরপর মাকে নানারকম ভোগ দিতে হয়। যথাবিধি না দিলে মা নেন না! অবশ্য রাগানুরাগে ভক্তিতে মাকে অন্তর থেকে নিবেদন করলে মা পরমকরুণায় নিবেদিত ভোগ গ্রহণ করেন। সেই ভোগের মধ্যে যা থাকবে তা হল— কমলালেবু, কয়েতবেল, আঙুর, সুপারি, ডালিম, কুল, চালকুমড়ো, কাঁঠাল, বকুল, যষ্টিমধু, আমসত্ত্ব, কেশর, আখরোট, পিণ্ড খেজুর, বেল, ডুমুর, শ্বেতপদ্ম, কাঁকুড়, জাম, বাতাবি লেবু, হরীতকী, আমলকী, ছ’রকম পিপুল, মৌরি, মটর, পটল, শসা, কলা ইত্যাদি। দুর্গাপুজোয় মায়ের নৈবেদ্যরূপে যে ফল-মূলের তালিকা শাস্ত্রে আছে, তার সব কিছুই কিন্তু শরৎকালে পাওয়া যায় না। কারণ বাসন্তী দুর্গাপুজোকে ধরে নিয়েই যে, এই তালিকা শাস্ত্রকার দিয়েছেন, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
সপ্তমীতে সকালে সাতটি বড় পাত্রে সাতটি আমান্ন দিতে হয়। সেই আমান্নে থাকে সাত সের আতপ চাল, নানারকম গোটা ফল, মিষ্টি, নাড়ু। এছাড়া সবরকম ফল কেটে মিষ্টির সঙ্গে সাজিয়ে মাকে দিতে হয়। এছাড়া শ্রীগুরুদেব এবং নারায়ণের ও নবপত্রিকার জন্যও আমান্ন নিবেদন করতে হয়। এই দিন দুপুরে হবে অন্নভোগ। সাড়ে চার সের আতপ চালের অন্ন সাতটি থালায় মাকে দেওয়া হয়। সঙ্গে গুরুদেবের, নারায়ণের, শিবের ও অন্যান্য গৃহদেবতাকেও আলাদা আলাদা থালায় ভোগ দিতে হয়। সপ্তমীতে মাকে আলু, পটল, বেগুন, কুমড়ো, কচুভাজা দেওয়া হয়। বেগুন, মুলো, পালংশাক, ফুলকপি, কচু ও পাঁচমিশালি মোট তিনটি তরকারি, পেঁপের টক ও অন্তত দশ সের দুধের পায়েস নিবেদন করা হয়। সঙ্গে থাকে মোট ন’খিলি পান। ‘অগস্ত্য সংহিতা’য় বলা হয়েছে, পানে চুনের ফোঁটা দিয়ে তাতে সুপারি, কর্পূর দিয়ে মাকে দিতে হয়।
আর ‘শিবার্চন চন্দ্রিকা’ ও ‘মৎস্যসূক্তে’ বলা হয়েছে যে, পানে শঙ্খ, শামুকের গুঁড়ো দিয়ে পাঁপড়, খয়ের, এলাচ, দারুচিনি, জায়ফল, কর্পূর, ধনে, মৃগনাভী ও অন্যান্য সদ্গন্ধ দিয়ে মাকে নিবেদন করতে হয়। এরপর রাতে ঘিয়ের লুচি ও মিষ্টি ভোগ দিয়ে দেবীকে শয্যা নিবেদন করতে হয়। ষষ্ঠী থেকে বিজয়াদশমীতে ভোগ নিবেদনের সময় প্রতিবারই শীতল, স্বচ্ছ, শুদ্ধ জলও নিবেদন করতে হয়।
অষ্টমী
অষ্টমীর সকালেও দাঁতন, মুখ ধোয়ার জল, স্নানের জল, সিঁদুর, কাজল— সব দেওয়ার পর সপ্তমীর মতোই সব ফল দেবীকে দিতে হয়। সঙ্গে আরও দেওয়া হবে আস্ত ধান, শালুক, ডাঁটা, পেঁপে, কলা, গাবফল, কুসুম, হলুদ, উচ্ছে, কাঠবাদাম, আখরোট, ক্ষীর, খোবানি, শালুক ও পঙ্কজের নানারকম ফল। তবে যত ফল বলা হয় তার মধ্যে বহড়া বৃক্ষ, তেলাকচু, শিলাজিৎ ও বৈষ্ণব ফল (কলা, শসা, আঙুর, লেবু, হরিতকী, আমলকী, আম, কাঁঠাল) দেবীর প্রিয়। ‘কালিকাপুরাণ’ বলেছেন— হে ভৈরব! মোসাম্বি লেবু, বাতাবি লেবু, করমচা, আম দেবীকে দিলে দেবী ভক্তের সমস্ত কামনা পূরণ করেন। মাকে পায়েস, পিঠে, যব, খিচুড়ি, মিষ্টি, চিঁড়ে ও নাড়ু ভোগ দেবে। ঘি ও চিনি মিশিয়ে শালিধানের ভালো অন্ন, এছাড়াও সবরকমের অন্ন, গোরু, মোষ, ছাগল, মৃগ— এদের দুধের ক্ষীর ভোগ দেবে। সবরকম মধু, গুড়ের মুড়কি, চিনি এবং মাংস দেবীকে দান করবে। ছানা, চিনি দেওয়া দই, ঘি দুর্গাকে ভোগ দিলে অশ্বমেধের ফল লাভ হয়। চিনেবাদাম, চিলগোজা (পাহাড়ি ফল), আমলকী, করমচা দিলে সৌভাগ্য লাভ হয়। আর মাষকলাই, মুগ, মসুর, তিল, ভাং ও যবও দিতে হয়। মাকে যে কোনও ভোগই বেশ বারাদি দ্বারা সংস্কার করে দিতে হয়। যে বস্তুকে যেভাবে সংস্কার করা উচিত, সেইভাবে সংস্কার করে তারপর মায়ের ভোগে কোনও বস্তু নিবেদন করতে হয়। যাতে পূতিগন্ধ আছে, যা পুড়ে গেছে, যা খাওয়া যায় না, এরকম ভোগ মাকে দিতে নেই। কর্পূর ইত্যাদি দিয়ে সুগন্ধি পান চুনের ফোঁটা সহযোগে ভোগ দিতে হয়।
অষ্টমীতে আট সের আতপ চাল দিয়ে আটটি আমান্ন এবং গুরুদেব ও নারায়ণের জন্য আরও দু’টি আমান্ন সকালে নিবেদন করা হয়। এরপর দুপুরবেলায় অন্নের থালা হবে আটটি এবং অন্যদের জন্য আরও দু’টি। সঙ্গে থাকবে লুচি, ছোলার ডাল, বাঁধাকপি ও কচুর দু’টি তরকারি, পাঁচরকম ভাজা, টম্যাটোর চাটনি, পায়েস ও পান।
সন্ধিপূজা
সন্ধিপূজাতেও আটটি আমান্ন মায়ের ও অন্য দেবতার জন্য আরও দু’টি আমান্ন, সঙ্গে সপ্তমী, অষ্টমীতে যতরকম ফল দেওয়া হয়— সবই দেওয়া হবে। সঙ্গে থাকবে মিষ্টি ও পিঠে। যেখানে বলিদানের প্রথা আছে, সেখানে পশু, পক্ষী যা বলিদান দেওয়া হবে তার মাংস, মাছ দেবীকে ভোগ দেওয়া হবে। শাস্ত্র মতে, গণ্ডার, ঘোড়া, ছাগল ও মাছ— এদের মাংস একসঙ্গে পাক করে দেবীকে দিলে তিনি প্রসন্না হন। ভক্তের রাজ্যলাভ হয়। মুলো দিয়ে হরিণের মাংস লোহার পাত্রে রান্না করে দেবীকে দেওয়া যায়। আর যাঁদের পূজায় বলিদান নেই তাঁরা খেজুর ও ঘি দিয়ে যবের গুঁড়ো দেবী বৈষ্ণবীকে নিবেদন করলে রাজসূয় ফল পান। মাকে খিচুড়ি দিলে অতুল সৌভাগ্য লাভ হয়। নারকেলের জল দিলে অগ্নিষ্টোম যজ্ঞের ফল লাভ হয়। বাতাবি লেবু, জায়ফল, আমলকী ও বেল মাকে দিলে তিনি প্রসন্না হন। আঙুর, চিনি এবং কমলালেবু মাকে নিবেদন করলে লক্ষ্মীলাভ হয় এবং রূপবান হয়। থানকুনি এবং চিঁড়ে দিলেও হয় লক্ষ্মীলাভ।
সন্ধিপূজায় যে বলিদানের ব্যবস্থা আছে, তাতে পশুবধ যেখানে হয় না, সেখানে চালকুমড়ো, আখ প্রভৃতি বলি দেওয়ার প্রথা আছে। আবার বিশেষ ক্ষেত্রে একটি বৃহদাকার মিষ্টি সন্ধিসময়ে বলির বিকল্প হিসেবে নিবেদিত হয়। সঙ্গে পায়েস ও লুচি ভোগ দেওয়া হয়। এরপর রাতে সপ্তমীর মতোই ঘিয়ের লুচি ও মিষ্টি নিবেদন করা হয়।
নবমী
নবমীর সকালে ন’টি আমান্ন মায়ের এবং অন্যদের আরও দু’টি দেওয়া হয়। তাছাড়া সপ্তমী থেকে দশমী প্রতিদিনই পঞ্চামৃতও দিতে হয়। এই দিন দুপুরে মায়ের ন’টি থালায় অন্ন ও অন্যদের আরও দু’টি থালায় অন্ন, সঙ্গে ঘি, লেবু, পাঁচরকম ভাজা, মুগ ও মটরের দু’রকম ডাল, কলাই ডাল, কচু, পুনকো শাকের তরকারি, করলা ও কাঁচকলা ছাড়া শুক্তো, ফুলকপির তরকারি, পেঁপে ও চালতার দু’রকম টক, পায়েস ও পান মাকে দেওয়া হয়। রাতে ঘিয়ের লুচি ও মিষ্টি নিবেদনের পর পূজার প্রতিদিনের মতো শয্যা নিবেদন করা হয়।
কালিকাপুরাণ মতে, গোটা আখ, মুগডালের মণ্ড এবং মাখন মাকে ভোগ দিলে অতুল সৌভাগ্য লাভ হয়। মাখনের সঙ্গে একটু তিল দিলে খুবই ভালো। রত্নধোয়া জলের সঙ্গে নারকেলের জল তাতে ক্ষীর, ঘি, মধু মিশিয়ে কিছুটা চিনি ও দই দিয়ে পান করা যাবে, এইরকম বস্তু তৈরি করে তৈজস পাত্রে দেবীকে দিলে ঋদ্ধি-সিদ্ধি দু’টিই লাভ হয়।
মাকে যদি মরিচ, পিপ্পলী, মোচা, কাঁকুড়, পদ্মের নাল সংস্কার করে তাতে খণ্ডযুক্ত তেঁতুল দেওয়া হয়, তাতেও ভক্তের অভ্যুদয় হয়। রাজমা, মসুর, পালংশাক, পাটশাক, কচুশাক, মাষকলাই, ব্রাহ্মীশাক, মুলো, বেতুয়াশাক, কলমী শাক, অঙ্কুরিত শস্য দানা, হেলেঞ্চাশাক, টগরফুল, গাছের কচি পাতা ভোগ দিলে অতুল লক্ষ্মী ও দুর্গালোক লাভ হয়।
ভোগ নিবেদনের ব্যাপারে শাস্ত্র আমাদের সচেতন করে বলেছেন যে, শ্রদ্ধা, পরিষ্ঠি, সংস্কার, ভক্তি, দ্রব্য, অভিমন্ত্রণ এবং অনুরাগ যুক্ত হয়ে ভোগ নিবেদন করতে হয়। মন্ত্রবিরুদ্ধ এবং কালবিরুদ্ধ এবং গুরুভার সমন্বিত নৈবেদ্য মাকে দিতে নেই। রুপা, সোনা, তামার পাত্র বা পাথরের পাত্রে ভোগ নিবেদন করতে হয়। তৈজস পাত্রের মধ্যে সৌবর্ণ বা তামার পাত্রে ভোজন ও অর্ঘ্য দিতে হয়। যদি তা না থাকে তাহলে যজ্ঞকাঠের পাত্রে ভোগ দেওয়া যায়। তবে তা মধ্যম ব্যবস্থা। আর যখন তাও থাকবে না, তখন নিজে হাতে তৈরি করে মাটির পাত্রে ভোগ দেওয়া যাবে।
পুরাণকার বলেছেন, মাকে ভোগ নিবেদন করলে ভক্তের মনোবাসনা পূরণ হয়। সব কাজ সিদ্ধ হয়। অমৃত লাভ হয়। ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ— মায়ের নৈবেদ্যে সর্বদা প্রতিষ্ঠিত থাকে। নৈবেদ্য হল সর্ব যজ্ঞময়, সকলের তুষ্টিপ্রদ। মায়ের প্রসাদ আমাদের জ্ঞান ও কাম প্রদান করে। ভোগপ্রসাদ সব সময় অতি পবিত্র।
‘শাক্তানন্দতরঙ্গিণী’তে বলা হয়েছে, ভোগ নিবেদনের সময় যদি কোনও বস্তুর অভাব থাকে। মানে আমরা যত উপচার উপকরণের কথা জানলাম, তা যদি জোগাড় করা না যায়, তাহলে মনে মনে সেই বস্তু ভাবনা করে মানস নিবেদন করা যেতে পারে। তাতেও পুজোর ফল একই হয়। দেবী প্রসন্ন মনে এই মানস নৈবেদ্য গ্রহণ করেন। ‘কালিকাপুরাণ’ও একই কথা বলেছেন। পূজার শ্রেষ্ঠ নৈবেদ্য চোখের জল। তারপর বন্দনা। বন্দনায় প্রাণ ও বুদ্ধি মাতৃচরণে সমর্পিত হয়। প্রণামও চোখের জলের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রণাম হল আত্মযজ্ঞ। নিজের ‘আমি’টাকেই অর্ঘ্যরূপে মায়ের চরণে নিবেদন করে দেওয়া!
দশমী
দশমীর সকালে দশ সের আতপ চালের দশটি আমান্ন, সবরকম গোটা ফল, মিষ্টি, নাড়ু ইত্যাদি দিতে হয়। সপ্তমী থেকে দশমী প্রতিদিন বেলগাছের ছোট শাখা ও পঞ্চামৃত, কাজল, সিঁদুর ইত্যাদি মাকে নিবেদন করা হয়। এছাড়া ষোড়শ উপচারের দ্রব্যগুলি তো নিবেদিত হয়ই। দশমীর দিন পূজার পরে যে ভোগ নিবেদন হয়, তাতে নানারকম কাটা ফল, মিষ্টি এবং দশটি বড় থালায় চিঁড়ে, দই, মিষ্টি, গুড় ইত্যাদি ভোগ দেওয়া হয়। আর শিবের জন্য বিশেষ করে সিদ্ধি বেটে তাতে কলা, দুধ, মিষ্টি মিশিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। দশমীতে অন্নভোগ হয় না। রাতে প্রতিমা নিরঞ্জনের পরে সকলে অন্নপ্রসাদ গ্রহণ করেন। এই ভোগটি মায়ের চিত্রপটে এবং শ্রীগুরুদেবের কাছে নিবেদন করা হয়।
দুর্গাপূজা হল মহাপূজা— কলির অশ্বমেধ যজ্ঞ! তাই এই পুজোয় উপচারের বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্য আছে। সব জায়গায় যে একইরকম নৈবেদ্য বা ভোগ নিবেদনের বিধি-রীতি আছে— এমনটা কখনও নয়। পারিবারিক ঐতিহ্য ও আঞ্চলিক রীতি অনুসারেও ভোগের দ্রব্য ও নিবেদন পদ্ধতি আলাদা হয়ে থাকে। আমরা শুধু দৃষ্টান্তরূপে শাস্ত্রীয় পদ্ধতির সঙ্গে কিছু পারিবারিক পূজায় যেমনটা হয় তা ছোট করে বলার চেষ্টা করলাম। এখানে বিশেষত রানিগঞ্জে শ্রীভূমানন্দদেব প্রবর্তিত গৌরী আশ্রমের প্রাচীন দুর্গাপুজোয় ও আরও কয়েকটি স্থানে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় তাকে দৃষ্টান্তরূপে গ্রহণ করা হয়েছে।
জগতের সঙ্গে যোগাযোগ হলে আমাদের চেতনায় নানা তরঙ্গ ওঠে। তারপর আমরা ইন্দ্রিয় ও মনের নির্দেশ মেনে ছোটাছুটি করি, প্রথমে খুব আরাম হয়, ভালো লাগে ক্ষণিকের জন্য। তারপরই অনুভব করি আর ভালো লাগছে না! —এই হল আমাদের ভোগ, যা আসলে দুর্ভোগ ছাড়া অন্য কিছু নয়। মাকে আমরা যখন ভোগ নিবেদন করি, তখন মা প্রসন্ন হয়ে আমাদের নিবেদিত নৈবেদ্যের সূক্ষ্ম অংশ গ্রহণ করেন। সাদা চোখে মনে হয় যা দিয়েছিলাম সবই তো এখানেই রইল! তাহলে মা যে গ্রহণ করলেন সেটা বুঝব কেমন করে? উত্তর হল— চন্দন, লবঙ্গের মূল নির্যাস বের করে নেওয়ার পরেও যেমন বাইরে থেকে বস্তুটিকে যথাযথ অবস্থিত বলেই বোধ হয়, তেমনই বাইরে নৈবেদ্য যা আমার স্থূল নাগালে এল, তা তখন কিন্তু মায়ের প্রসন্নতায় প্রসাদের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। আমার মতোই অন্ন, ব্যঞ্জন, ফল, মিষ্টান্ন, ধূপ, দীপ, বলি— সবাই নিজেকে মাতৃচরণে নিবেদন করে কৃতার্থ হয়ে গিয়েছে। নিবেদিত সত্তায় তখন সত্ত্বগুণের প্রাচুর্য, যা আমাকে আনন্দ রাজ্যে আলোর রাজ্যে পৌঁছে দেবে। এখানেই মাতৃপূজার পূর্ণতা।
ছবি : সোমনাথ পাল ও তাপস কঁাড়ার