বৃহস্পতিবার, 17 জুলাই 2025
Logo
  • বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫

রহস্যময় শঙ্কু

১৬ জুন তাঁর জন্মদিন। সাহিত্যের চরিত্র হলেও বাঙালি পাঠকের কাছে তিনি যেন রক্তমাংসের মানুষ— মুশকিল আসান এক প্রোফেসর। জন্মদিনের আগে প্রোফেসর শঙ্কুকে ফিরে দেখলেন সায়ন্তন মজুমদার।

রহস্যময় শঙ্কু

প্রোফেসর শঙ্কুর স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়। তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল সত্যজিতের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়। ১৯৬১ সালে। লেখকের পিতা সুকুমার রায়ের লেখাতেই আমরা প্রথম তাঁর মতো একজনের আভাস পেয়েছিলাম—‘হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’। সেখানেও প্রোফেসর হুঁশিয়ারের নানা রোমাঞ্চকর গল্প দিনলিপির তারিখ বরাবর পরিবেশিত হয়েছিল। ঠিক যেমন শঙ্কুর গল্পগুলিতে রয়েছে।
আগামী কাল অর্থাৎ ১৬ জুন বিজ্ঞানী শঙ্কুর জন্মদিন। ১৯১২ সালে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর বাবা ছিলেন চিকিৎসক ত্রিপুরেশ্বর শঙ্কু। আর প্রোফেসর শঙ্কুর আসল নাম হল ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। যা শিব, বিষ্ণু কিংবা সূর্য তিনজনকেই বোঝায়। তাঁরা থাকতেন গিরিডিতে। সেখানে দেখা পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘সহজ পাঠ’-এ থাকা উশ্রী নদীকে। সেই নদীর তীর বরাবর ভোর পাঁচটায় উঠে চার মাইল হাঁটতেন শঙ্কু। কিন্তু, সেখানে হাজার খুঁজলেও এই বিজ্ঞানীর বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেখতে পাওয়া যাবে না তাঁর সেই বাগান, যেখানে উল্কা পড়েছিল। যার ফলে গোলঞ্চ গাছে দিনে কালো ও রাতে ফসফরাসের মতো জ্বলতে থাকা ফুল ধরত। বাগানেরই এক তালগাছে একবার বাজ পড়েছিল। সেই সময় ঝড়ের মধ্যে গাছের চারা বাঁচাতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন শঙ্কু। আসলে সবটাই যে কাল্পনিক।
গিরিডির বাড়িতেই ছিল তাঁর ল্যাবরেটরি। সেখানেই নির্মিত হয়েছে বিধুশেখরের মতো যন্ত্রমানব বা রোবট সহ আশ্চর্য সব বস্তু। বিভিন্ন সময়ে এই বাড়িতে এসেছিলেন সুইডেনের বিজ্ঞানী সভেন্ডশন, বিখ্যাত প্রাণীতত্ত্ববিদ জেরেমি সন্ডার্স, ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ ব্রায়ান ডেক্সটার প্রমুখ।
প্রোফেসর শঙ্কু পড়াশোনা করেছেন গিরিডি হাই স্কুল ও কলকাতার কলেজে। জীবনে কোনওদিন হননি দ্বিতীয়। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় বারো বছর বয়সে ম্যাট্রিক (তৎকালীন মাধ্যমিক), চোদ্দোতে আইএসসি পাশ করে ষোলো বছরেই পদার্থবিদ্যা-রসায়নে অনার্স গ্র্যাজুয়েট হন। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও বাবার কথায় ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন, শিল্প বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন বিস্তর। স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যাপক হয়েছিলেন মাত্র কুড়ি বছর বয়সে। শিখেছিলেন জার্মান, ফরাসি ভাষা।
বরাবরই তিনি ব্ল্যাক কফি খেতে ভালোবাসতেন। ছোটবেলায় মায়ের হাতে মোহনভোগও খেয়েছেন। আয়নায় নিজেকে দেখা পছন্দ ছিল না বলে তাতে ক্যালেন্ডার ঝুলিয়ে রাখতেন। অভ্যাস ছিল ডায়েরি লেখার। যে ডায়েরিটি তারক চ্যাটার্জির কাছ থেকে গল্প কথক কুড়ি টাকার বিনিময়ে পেয়েছিলেন। সুন্দরবনের উল্কাপাতের গর্ত থেকে পাওয়া ডায়েরিটি। এটির লেখার কালির রং অনবরত বদলে যেত। শেষে সেটি খেয়ে শেষ করে ফেলেছিল বহু পিঁপড়ে।
গবেষণা ও আবিষ্কার করাই ছিল তাঁর প্রধান নেশা। বৈদ্যুতিন বাতির আবিষ্কর্তা টমাস আলভা এডিসনের পরেই স্থান পেয়েছিলেন। প্রথম বিদেশ যাত্রা ইংল্যান্ডে। ছাব্বিশ বছর বয়সে। ঠিক তার আগের বছর পঁচিশ বছর পূর্তির জন্মদিনে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন সর্বরোগনাশক মিরাকিউরল বড়ি। জার্মান পরিভাষায় যাকে আলহাইলমিটোল বলা হয়। গিরিডির টিকড়িবাবার কথা অনুযায়ী সাড়ে ছয় হাজার ফুট উঁচুতে থাকা সুদূর কসৌলি থেকে স্বর্ণপর্ণী গাছ তুলে এনে নিজের বাগানে চাষ করিয়েছিলেন তিনি। বাবাকে বাঁচানোর সুযোগ না পেলেও স্থানীয় উকিল, ক্যান্সার আক্রান্ত সন্ডার্স, মৃতপ্রায় ভারততত্ত্ববিদ হাইনরিখ স্টাইনারকে তিনি বাঁচিয়েছিলেন এর দৌলতে। ইংল্যান্ডের ক্যাক্সটন হলে এই সম্পর্কে তিনি বক্তৃতা দেন।
নানা বীজ মিশিয়ে সুস্বাদু ফল তৈরি করে সুইডিস অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স থেকে ‘ডক্টর’ উপাধি লাভ করেছিলেন। প্রিয় পোষ্য নিউটন বিড়ালের জন্য বানিয়েছিলেন মার্জারিন ওষুধ। যার ফলে বহু বছর বেঁচে ছিল সে। তার জন্য বানিয়েছিলেন ফিশপিল, যা একটা খেলেই সাত দিন চলে যেত। পরিচারক প্রহ্লাদের জন্য বটফলের রস দিয়ে তৈরি বটিকা ইন্ডিকা একটা খেলে চব্বিশ ঘণ্টা পেট ভরে থাকত।
ছোটবেলায় হাতের টিপ ভালো থাকলেও শিকার করা এক্কেবারে পছন্দ করতেন না। কারণ তিনি রক্তপাত সহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু অপরকে নিহত না করে নিশ্চিহ্ন করার জন্য আবিষ্কার করেছিলেন অ্যানাইহিলিন পিস্তল। মিশরে থাকাকালীন দু’বার তিনি এর সাহায্যে সঙ্গীদের বাঁচিয়েছিলেন সাপের হাত থেকে। এছাড়াও অন্যকে জব্দ করার জন্য আবিষ্কার করেছিলেন নস্যাস্ত্র অর্থাৎ নাকের নস্যির মতো এর ঘায়েলে যে কেউ টানা তেত্রিশ ঘণ্টা হাঁচি দেবে। কিন্তু অন্য গ্রহের লোকের উপরে তা ব্যর্থ হয়েছিল। তাঁর বানানো যন্ত্র রিমেমব্রেন। হেলমেটের মতো দেখতে বস্তুটিকে একবার লাই ডিটেক্টরের মতো ব্যবহার করে পাকা গোয়েন্দা হয়ে শঙ্কু কিন্তু অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞানী তথা খুনি হিয়ারনিমাস শেরিংকে হাতেনাতে ধরেছিলেন।
আবার এই হাঁসফাঁস গরম থেকে রেহাই দিতে পারে তাঁর তৈরি এয়ারকন্ডিশনিং পিল। যেটি জিভের তলায় রাখলে শরীর ঠান্ডা হবে। একই সঙ্গে  শীতকালে দশের নীচে নেমে যাওয়া হাড়কাঁপুনি ঠান্ডায় শরীরকে গরম রাখবে। একেবারে এক ঢিলে দুই পাখি। কিনতে হবে না এসি বা হিটার।
বর্তমানে মোবাইল ও সোশ্যাল মিডিয়ার ‘কল্যাণে’ আমাদের রাতের ঘুম উড়েছে। যা থেকে অনিদ্রার মতো রোগ বাড়ছে। তার জন্য অব্যর্থ শঙ্কুর সমনোলিন বড়ি। এখনকার মতো গুগল ট্রান্সলেটর তো তখন ছিল না। কিন্তু যে কোনও ভাষাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা সহজ হয়ে যেত তাঁর লিঙ্গুয়াগ্রাফ যন্ত্র ব্যবহারের ফলে।
ভারতে এখনও প্রতি বছরে হাজার হাজার মানুষ বজ্রপাতে মারা যান। সে ক্ষেত্রে অত্যন্ত উপযোগী শঙ্কুর তৈরি কার্বোথিনের পাতলা জামা। সেটির সাহায্যেই নরওয়ের পাগল বিজ্ঞানী গ্রেগর লিন্ডকুইস্টের হাত থেকে নিজেকে এবং ব্রিটিশ প্রাণীবিজ্ঞানী আর্চিবল্ড অ্যাকরিয়েডকে মৃত আশ্চর্য পুতুল হওয়া থেকে রক্ষা করেছিলেন।
তাঁর পোষা কাক কর্ভাস যে কী ভেলকি দেখিয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকায়, তার প্রমাণ দেয় অরনিথন যন্ত্র। কর্ভাসের মধ্যে চলে এসেছিল মানবিক বুদ্ধিসুদ্ধি। অনেক সময় শঙ্কুর স্বভাব বা আবিষ্কার তাঁকেই বিপদে ফেলত। একবার মহাভারতের অস্ত্রের অনুকরণে হাই তোলার বড়ি বানিয়ে নিজেই খেয়ে ফেলেছিলেন। অনেক হাই তোলার পরে ঘুমের মধ্যে এমন ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, দাড়ির বাঁদিকটা গিয়েছিল পেকে। আবার রকেটের খোল তৈরিতে বিধুশেখরের বারণ সত্ত্বেও  ঔৎসুক্যের বশে ট্যানট্রাম বোরোপ্যাক্সিনেটের ব্যবহার করে চোখ ধাঁধানো আলো ও বিস্ফোরণের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। এত বড় একজন বিজ্ঞানীকে একবার বাঁচিয়েছিল ভৃত্য প্রহ্লাদ। একটি টিকটিকি বাইকরনিক অ্যাসিডের শিশির ওপর পড়ে উল্টে যায়। অ্যাসিড  গড়াতে গড়াতে স্তূপ করে রাখা প্যারাডক্সাইট পাউডারের দিকে যাচ্ছিল। ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা ভেবে তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান, নড়াচড়ার ক্ষমতাও ছিল না তাঁর। আর তখনই কিছু না জেনে  প্রহ্লাদ অবলীলায় গামছা দিয়ে অ্যাসিড মুছে বিপদ দূর করে ফেলে।
গুণীদের চারপাশ থেকে নানা জ্বালাযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। ভারত আজ এই শতকে মঙ্গলযান পাঠিয়েছে। কিন্তু গত শতাব্দীতে বিজ্ঞানী নিজেই মহাকাশযান বানিয়ে মঙ্গলে ও ভিন গ্রহে পাড়ি দিয়েছিলেন। খেয়েছিলেন মঙ্গলের জলও। চারপাশের কিছু মানুষের মতো তাঁর প্রতিবেশী অবিনাশবাবু প্রথমে ঠাট্টা করেছিলেন। রকেটটিকে হাউই বলে কালীপুজোর দিনে ওড়ানোর প্রস্তাবও দেন। প্রথমবারের রকেট উৎক্ষেপণ ব্যর্থ হয়ে আবার অবিনাশবাবুরই মুলোর খেতে পড়ে গিয়েছিল। তার জন্য পাঁচশো টাকা ক্ষতিপূরণও চেয়েছিলেন।
একবার মিশরে গিয়ে তিনি অন্য গ্রহের প্রাণীর সন্ধান ও পৃথিবীর চারটি মূল সমস্যার বিষয়ে তাদের বাতলে দেওয়া সুলুকসমাধানের হদিশ পেয়ে যান— আবহাওয়ার প্রকোপের মোকাবিলা, বায়ুশোধন, সমুদ্রগর্ভে বসবাস ও সৌরশক্তির ব্যবহার। এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন এক মহাপ্লাবনের মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়ে আছি,সেক্ষেত্রে সমুদ্রবাস আমাদের বাঁচাতে পারে। আবার অতি সস্তায় আলোর ব্যবস্থার জন্য তিনিই বানিয়েছিলেন লুমিনিম্যাক্স।
প্রোফেসর শঙ্কুর ডান হাতের অনামিকায় একটি আংটি দেখতে পাই আমরা। তাতে বসানো রয়েছে একটি পাথর, যা থেকে নীলাভ আলো বিচ্ছুরিত হয়। সেটি আসলে ছিল অন্য গ্রহের সম্পদ। অনেক রহস্য ভেদ করলেও সেই পাথরের রহস্য কিন্তু উদঘাটন করতে পারেননি স্বয়ং শঙ্কু।
এবার আসি মানুষ শঙ্কুর কথায়। পরোপকার ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। পয়সার প্রতি লোভও তাঁর ছিল না। সেই আমলে জাদুকর আর্গাসের কাছ থেকে দশ হাজার এস্কুডো অর্থাৎ ভারতীয় টাকায় পনেরো হাজার টাকার তোয়াক্কা না করে পোষা কাকটিকে কিন্তু তিনি অন্যের হাতে তুলে দেননি। ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতা ও ১ মন ১১ সের ওজনের এই মানুষটির মূল্যবোধ ছিল অত্যন্ত উঁচু। তা তিনি পেয়েছিলেন নিজের বাবার কাছ থেকে। তিনি ছেলেকে বলতেন, ‘ক্ষমতা আছে বলেই যে অঢেল উপার্জন করতে হবে তার কোনও মানে নেই।...রোজগার যেভাবেই করিস না কেন যারা দরিদ্র, যারা নিরক্ষর, যারা মাথা উঁচু করে চলতে পারে না, তাদের কথা 
ভুলিস না।’
তিনি টাফা গ্রহে সেখানকার লোকদের মধ্যেই মহাসম্মানে বাঁধা পড়ে আছেন? নাকি নিজস্ব ব্যোমযানে আবার পাড়ি দিতে গিয়ে অন্য কোথাও আটকে পড়ে আছেন? রহস্যমণ্ডিত হয়ে রয়েছেন আমাদের ম্যানিফিকো আশ্চর্য প্রোফেসর শঙ্কু।
 শঙ্কুর স্কেচ সত্যজিৎ রায়ের আঁকা

রাশিফল