কৈলাস পর্বতে শিবের বাস। এও বলা হয় কৈলাস পর্বতই স্বয়ং শিব। এই পর্বতকে ঘিরে রহস্যের যেমন শেষ নেই তেমনই অলৌকিক ঘটনা ঘটে চলে সর্বদা। বহুকাল আগে কৈলাসকে স্পর্শ করেছিলেন স্বামী অপূর্বানন্দজি। সে এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা! সেই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন বাবুলাল দাস।
‘তিস্রো মাত্রা মৃত্যুমত্যঃ প্রযুক্তা / অন্যোন্যসক্তা অনবিপ্রযুক্তাঃ/ক্রিয়াসু বাহ্যাভ্যন্তরমধ্যমাসু / সম্যক্ প্রযুক্তাসু ন কম্পতে জ্ঞঃ।’ প্রশ্নোপনিষদ্-এ এই মন্ত্রটি হল, ওঙ্কারের তিনটি মাত্রা অ-উ-ম পৃথকভাবে প্রযুক্ত হলে মৃত্যুর বিষয়ীভূত হয়। তবে পরস্পরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হলে যথাযথভাবে প্রযুক্ত হয়। বাহ্য, অভ্যন্তর ও মধ্যম অর্থাৎ— জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তির অধিষ্ঠাতা পুরুষের ধ্যানকালে সম্যকভাবে প্রযুক্ত হলে ওঙ্কারতত্ত্বের জ্ঞাতা বিচলিত হন না, অর্থাৎ তাঁর আর মৃত্যুভয় থাকে না। কৈলাস যাত্রাপথে সেই ওঙ্কারকে প্রথম দর্শন করেছিলাম নাভিডঙে বিশাল এক পর্বতগাত্রে। প্রকৃতি আপন খেয়ালে সেখানে প্রণবমন্ত্রটি বরফ দিয়ে মুদ্রিত করে দিয়েছেন। এরপর এর মহিমা অনুভব করেছিলাম কৈলাস পরিক্রমা শেষে গভীর রাতে ক্যাম্পের বাইরে এসে উন্মুক্ত আকাশের নীচে একাকী বসে। অউম্ (ওঁ)-এর উপাসনাকে যম প্রশংসা করে, কীভাবে তা মানুষকে ব্রহ্মলোকে নিয়ে যায় নচিকেতাকে শুনিয়েছিলেন। এটিই হিন্দুদের পবিত্রতম শব্দব্রহ্ম বা প্রণব ব্রহ্মের প্রতীক। যিনি এই ওঙ্কারকে জানেন তাঁর সকল ইচ্ছা পূরণ হয়ে যায়।
যারপরনাই ক্লান্তি থাকা সত্ত্বেও ঘুম এল না এক অলৌকিক টানে। মনে পড়ল রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অন্যতম প্রাচীন সাধু এবং শ্রীমায়ের দীক্ষিত সন্তান স্বামী অপূর্বানন্দজি ছিলেন পূজ্যপাদ স্বামী শিবানন্দজির সেবক। তিনি ‘কৈলাস ও মানসতীর্থ’ পরিক্রমা করেছিলেন। লিখেছিলেন বিখ্যাত ‘কৈলাস ও মানসতীর্থ’ গ্রন্থটি। তিনি যখন আবেগভরে কৈলাসের পাদমূলে মুখ ঘষটাতে ঘষটাতে পড়েছিলেন তখন তাঁর কানে ভেসে আসছিল, ‘সেই মধুর গম্ভীর ওঁ-কার ধ্বনি।’
কৈলাসের পদপ্রান্তে যাওয়ার অনুমতি নেই এখন। চোখের সামনে শুভ্রতুষারমণ্ডিত কৈলাসের চূড়া। নয়ন মেলে চেয়ে আছি সেইদিকে শিশুর মতো বিস্ময় নিয়ে। হঠাৎ কী যেন হল শরীরের মধ্যে। সমস্ত দেহজুড়ে কেমন যেন একটা শিহরন খেলে গেল। প্রচণ্ড ঠান্ডায় গায়ে জল পড়লে যেমন হয়। অথচ কনকনে ঠান্ডা বাতাসও বইছে না! তাছাড়া, আপাদমস্তক বেশ ভারী শীতবস্ত্র রয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গভীর নিঃস্তব্ধতা ভেদ করে একটা অস্ফুট ধ্বনি কানে ভেসে এল। বুঝলাম ওটি সাধারণ কোনও ধ্বনি নয়। গম্ভীর অথচ প্রশান্ত। সে শব্দে ভয় লাগে না। মন হঠাৎ উদাস হয়ে যায়। শরীরও স্থাণুবৎ হয়ে যায়। এরপর আর কিছু মনে ছিল না আমার। অদ্ভুত এক অনুভূতি দেহমন জুড়ে ছড়িয়ে গেল। জানি না সেটি কোন অবস্থা জাগ্রত, না স্বপ্ন, নাকি সুষুপ্তি! কতক্ষণ এইভাবে ছিলাম জানি না, ঘোর কেটে যেতে ভোরের আলো ফুটে উঠল। মনে হতে লাগল আমি যেন আমাতে নেই! খেতে, বা কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। এইভাবে বেশ কয়েক ঘণ্টা চলেছিল।
কৈলাস পরিক্রমাকালে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত দৃশ্য নজরে এসেছে, আশ্চর্য হয়েছিলাম আমার মানসিক অবস্থা অনুভব করে। মন কীভাবে কোন জাদুতে ভারশূন্য, বাসনাহীন হয়ে গেছিল তা ভাবলে আজও অবাক হই। সর্বদা একটা শুদ্ধ ও উচ্চ আবেশ ঘিরে থাকত। পবিত্র কৈলাস চূড়ার উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম — চারদিকের রূপ ভিন্ন ভিন্ন। সূর্যের কিরণ পড়ছে তাতে। অপূর্ব সে দৃশ্য! আশুতোষ যেন ভিন্ন ভিন্ন সাজে ভক্তদের দর্শন দিচ্ছেন। কখনও হাসিমুখে দাঁড়িয়ে চোখ মেলে, কখনও বা গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে আছেন। এক একেক সময় কৈলাস এক এক রূপ ধারণ করেন। একবার দেখলাম বরফের চাদরে পর্বতের গায়ে আঁকা হাঁটু মুড়ে বসা এক বৃষ। তার পাশে একটা মই! দেখছি সামনে গিরিরাজ কত না বিচিত্র রূপে ধরা দিচ্ছেন! সহসা একটু এগতেই পর্বতগাত্রে ভগবান শিবকে যেন জীবন্ত দেখলাম! জটাজূট মহাগম্ভীর, শান্ত যেন গণনাথ! বরফের ব্যাঘ্রচর্ম অথচ মধ্যে মধ্যে কালো শালগ্রাম শিলার মতো কালো কালো দাগ! শরীরের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল চকিতে। কে যেন তৎক্ষণাৎ আমায় দাঁড় করিয়ে দিল সেখানে। মনে পড়ে গেল, পিঠব্যাগে বাড়ি থেকে আনা শিশিতে গঙ্গাজল, ক’টি বেলপাতা আর ধূপকাঠি রয়েছে। সামনে রজতগিরিসদৃশ মহাদেব। আমি দিগম্বরের সামনে হাপুস নয়নে কেঁদে ফেললাম। কেন, তা জানি না। চোখের জলে মহাদেবের উদ্দেশে গঙ্গাজল, বেলপাতা নিবেদন করে স্তুতি করতে করতে সাষ্টাঙ্গে গড়াগড়ি খেতে লাগলাম — ‘ওঁ ধ্যায়েন্নিত্যং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতংসং / রত্নাকল্পোজ্জ্বলাঙ্গং পরশু মৃগবরাভীতিহস্তং প্রসন্নং। / পদ্মাসীনং সমন্তাৎ স্তুতমমরগণৈর্ব্যাঘ্রকৃত্তিং বসানং / বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং নিখিলভয়হরং পঞ্চবক্ত্রং ত্রিনেত্রম্।’ রজতগিরিসদৃশ গিরিরাজ, যিনি চন্দ্রকে ভূষণরূপে ধারণ করেছেন, যাঁর দেহ রত্নালঙ্কার দ্বারা উজ্জ্বল, চার হস্তে কুঠার, মৃগ, বর ও অভয়, প্রসন্ন ও পদ্মাসীন, যাঁকে দেবগণ চতুর্দিক থেকে স্তব করেন, যিনি ব্যাঘ্রচর্ম-পরিহিত, বিশ্বের আদি, বিশ্বের বীজ, নিখিল ভয়ের হরণকারী, পঞ্চবদন ও ত্রিনেত্র। সেই মহেশকে নিত্য ধ্যান করি। শিবের এই নয়নাভিরাম রূপ দেখতে দেখতে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। ঘোড়াওয়ালা কাছে এসে বলল, ‘আমরা অনেকটা পিছিয়ে পড়েছি, তাড়াতাড়ি করতে হবে।’
মনে হচ্ছিল, নিষ্পলক দৃষ্টিতে শুধু চেয়ে থাকি অনন্তকাল। দূর্গাপূজা এলে, শৈশবে যেভাবে মানসপটে কৈলাস নিয়ে নানান দৃশ্য রচিত হতো, এ যেন তারই বাস্তব রূপ! কোথায় মৃত্যুভয়? দেহরূপ খোলসের মায়া নেই এখানে। এই শিবপুরীতে দেহ রাখলে আর হয়তো ফিরে আসতে হয় না ধরাধামে।
ডোলমাপাস হয়ে গৌরীকুণ্ডে পৌঁছে ফের অপূর্বানন্দ মহারাজজির কথা স্মরণ হল। এখানে দৈবাৎ সূর্যদেবের দেখা মেলে। আকাশে ঝলমলে রোদ দেখে বুঝলাম ভগবান আজ প্রাণভরে কৃপার আলো ঝরিয়ে দিয়েছেন। ডোলমার প্রায় চারশো ফুট নীচে গৌরীকুণ্ড। পূজনীয় মহারাজজি এখানেও এমন একটি অলৌকিক কাণ্ড বাঁধিয়ে বসেছিলেন যে ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। গৌরীকুণ্ডে স্নান করা অসম্ভব। জল জমে পাথর হয়ে থাকে। কিন্তু মহারাজের ইচ্ছাকে কে দমিয়ে রাখবে? স্বয়ং ভগবান শিব তাঁর কাছে হার মেনেছিলেন। উপর থেকে কয়েকটা বড় বড় পাথর গড়িয়ে দিয়েছিলেন নীচে। সেই পাথর দিয়ে প্রায় এক-দেড় ফুট পুরু বরফ ভেঙে ডুব দেওয়ার মতো জায়গাও করে নিয়েছিলেন। হিমশীতল সেই জলে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার কথা। কুণ্ডের ভিতরে বসবাসকারী যক্ষের ভয় দূরে সরিয়ে দিয়ে তিনবার ডুব দিয়েছিলেন গৌরীকুণ্ডের জলে। মহারাজজি লিখেছিলেন, ‘সর্বাঙ্গ অবশ—হৃদপিণ্ডের ক্রিয়া যেন এককালে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কষ্ট-বোধ কতটা হয়েছিল তা ভাববার মতন মনের শক্তি ছিল না। আত্যন্তিক দুঃখের অনুভূতিটা প্রকাশ করা যায় না। খানিকক্ষণ পর দেহমনের অবশ ভাবটা কেটে গিয়ে এক অভাবনীয় আনন্দরসে আপ্লুত হয়ে গেল মনপ্রাণ।’
অনেকক্ষণ গৌরীকুণ্ডের সবুজ জলের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এখানে মা পার্বতী স্নান করেন। গৌরীকুণ্ডের অনেক আখ্যান আছে। এখান থেকে খুব চড়াই-উতরাই, প্রস্তরবহুল পথ। তুষার-ঝটিকা, বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, মেঘমলিন আকাশ এখানকার স্বাভাবিক রূপ। প্রাণান্তকর উতরাই। পথে গ্লেসিয়ার অতিক্রম করতে হয়। নীচে কুলকুল শব্দে হয়তো কোনও নদী বয়ে চলেছে। পা ফসকে গেলে মৃত্যু অনিবার্য।
কোন পুণ্যবলে যেন স্বর্গে এসেছি। বিশ্বাস হয় না। সজ্ঞানে, সশরীরে যেন স্বর্গে বিরাজ করছি। অলৌকিক সব দৃশ্যাবলী। দূরে দিকচক্রবাল জুড়ে যেন দেবদেবীদের দরবার, উদ্যান, সরোবর আরও কত কী! চারদিকে মায়াবী দৃশ্য।
স্বামী অপূর্বানন্দজি যেভাবে জীবন পণ করে কৈলাসের পাদমূলে পৌঁছে গিরিরাজের চরণ চুম্বন করে এসেছিলেন তা শুধু বিস্ময়কর নয়, অলৌকিকতার এক পরম দৃষ্টান্ত। মহারাজজির গাইড কীচখাম্পা মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি তো এযাবৎ যাত্রী নিয়ে পঞ্চাশ বার কৈলাসে এসেছি, কিন্তু এর পূর্বে কোনও যাত্রীই কৈলাসের পাদমূলে যায়নি। আর কেউ গিয়েছে বলেও শুনিনি।’ তীব্র শ্বাসকষ্ট উপেক্ষা করে নদী, বরফের খাত অতিক্রম করতে গিয়ে নীচে গড়িয়ে পড়েছেন। কোমর পর্যন্ত বরফে ডুবে গিয়ে দেহ অসাড় হয়ে গেছে। পর্বতের উপর থেকে হিমবাহ গড়িয়ে পড়েছে বিকট শব্দে। গাইড সাবধান করে বলেছিলেন, শিবজির অনুচর আর ভূতপ্রেতেরা বরফ ছুঁড়ে মারছে। মহারাজ মৃত্যুভয় জয় করে বলছেন—‘কৈলাসের পাদদেশ স্পর্শ না করে আমি ফিরে যাব না।’
এমন ভক্তকে ফিরিয়ে দেয় কার সাধ্য! স্বয়ং ভগবান শিব তাঁর কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেন না, বালকের স্বভাব না হলে ঈশ্বর দর্শন হয় না।’ মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্...। সর্বময় কর্তার ইচ্ছায় কী না হয়!
আমরা অনেক সময় অলৌকিক বিষয়টিকে গুলিয়ে ফেলি। ম্যাজিক মনে করে ভ্রম করে বসি। ম্যাজিকে কৌশল থাকে। অলৌকিকতার মধ্যে কোনও কৌশল থাকে না। থাকে গভীর নিষ্ঠা আর মনের পবিত্রতা। পবিত্র অন্তর দিয়ে মানুষ ঈশ্বরকে অনুভব করতে পারে। অনুভব করতে পারে তাঁর কৃপার কথা। বুঝতে পারে তাঁকে ধরতে পারলে উদ্ধার অনিবার্য। তাঁর হাতেই মতি, তাঁর হাতেই গতি। এই প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের দুটি কথা খুব প্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে হয়। তিনি শিকাগো থেকে দেওয়ানজি হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে একটি পত্রে লিখেছিলেন, ‘I am doing the Lord’s work, and wherever He leads I follow.’
ঈশ্বরের উপর এমন যাঁর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর অটুট বিশ্বাস, তাঁকে কে আটকায়? আমরা জানি ১৮৯৩ সালে স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো যাত্রা এবং ধর্মমহাসম্মেলনের সাফল্যকে কেন্দ্র করে কীভাবে একের পর এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। এই অলৌকিকতার মধ্যে রয়েছে জীবন পণ করা নিষ্ঠা আর হৃদয়ের পবিত্রতা।
* লেখক ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা দপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত বরিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক আধিকারিক।