আইনের মারপ্যাঁচে সামান্য বিষয় তিল থেকে তাল হয়ে দাঁড়ায়। কেনাকাটায় ঠকে যাওয়া থেকে ব্যাঙ্কের নমিনি, মৃত ব্যক্তির জমি-বাড়ি থেকে টাকা-পয়সা-গয়নার ভাগ উত্তরাধিকারীদের কার কতটা? শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তিতে স্ত্রীর কতটা অধিকার? জোর করে জমি বা বাড়ি দখল হলে কী করবেন? মা-বাবার ডিভোর্সে সন্তানের অধিকার কে দাবি করবে? দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যু হলে বিমার টাকায় শ্বশুরবাড়ির অধিকার কতটা? লোন করেছেন, টাকা শোধ না হলে কী করবেন? ফ্ল্যাট, বাড়ি-জমি কেনার সময় কী কী নথি যাচাই করবেন? এইরকম ৪০টি বিষয়ে আইনি পরামর্শ দিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়।
ভারতীয়দের আইন নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও অনেকেরই জানা নেই কোন আইনের আওতায় কী আছে? তাই ছোটখাট নানা সমস্যায় চিন্তার ভাঁজ ফেলে কপালে। কিন্তু সাধারণ কিছু আইন জানলেই প্রাথমিক পর্যায় সামলে নেওয়া যায় অনেক কিছু। এমনকী কোন আইনের মাধ্যমে আপনি সুরক্ষিত থাকবেন, দূর হবে নানা জটিলতা সে সবেরই খোঁজ দিলাম আমরা। চল্লিশটি আইনি সমস্যার সহজ সমাধান দেওয়া হল এই প্রতিবেদনে।
১. মৃত ব্যক্তির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে নমিনি না থাকলে কী হবে?
ধরে নিচ্ছি, একজন অ্যাকাউন্ট হোল্ডার গত হয়েছেন। এবং প্রশ্ন অনুযায়ী ওই অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের কোনও নমিনি নেই। অর্থাৎ মৃত্যুর আগে ওই ব্যক্তি কোনও নমিনি রেখে মারা যাননি।
এইসব ক্ষেত্রে, সাধারণত ওই মৃত অ্যাকাউন্ট হোল্ডার, যে উত্তরাধিকার আইন দ্বারা পরিচালিত, সেই আইন অনুযায়ী যাঁরা উত্তরাধিকারী হন, আইনত তাঁরাই ওই ব্যাঙ্কে রাখা যাবতীয় টাকা-পয়সা ইত্যাদির হকদার হবেন।
যেমন— মৃত ব্যক্তি যদি হিন্দু হন, তাহলে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন বলে তাঁর উত্তরাধিকারী বলে গণ্য হবেন।
এবার বিশদে বলি, নমিনি না থাকলে যাঁরা ওই অস্থাবর সম্পত্তি যেমন টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি ইত্যাদির দাবিদার, উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, তাঁদের ব্যাঙ্কে আবেদন করতে হয়। ধরা যাক, উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী তিনজন দাবিদার। তিনজনই একসঙ্গে ওই অর্থ ক্লেইম বা দাবি করতে পারে। অথবা যে কোনও দু’জন দাবি করতে পারে, আর একজনের অনুমতি সাপেক্ষে।
ব্যাঙ্কে এই ধরনের ক্ষেত্রগুলির ব্যাপারে সাধারণত দুটি পদ্ধতি মেনে চলা হয়। দাবি করা অর্থ যদি পাঁচ লাখ টাকার কম হয়, বা যদি দাবি করা অর্থ পাঁচ লাখ টাকার বেশি হয়।
ধরা যাক, দাবি করা অর্থ পাঁচ লাখ টাকার কম (মূল অর্থ ইন্টারেস্ট ইত্যাদি সবকিছু নিয়ে)। ওই যে একটু আগে বললাম, ধরা যাক, ওই ব্যক্তির রেখে যাওয়া অর্থের উত্তরাধিকারী তিনজন। ওই তিনজন একসঙ্গে ব্যাঙ্কে যোগাযোগ করতে পারেন। অথবা যে কোনও একজন বা দু’জনও যোগাযোগ করতে পারেন, অন্যদের অনুমতি নিয়ে।
প্রথমেই ব্যাঙ্কে ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ নিয়ে যোগাযোগ করতে হবে। ব্যাঙ্ক অবশ্যই ‘অরিজিনাল ডেথ সার্টিফিকেট’ দেখতে চাইবে এবং তারা তা ভেরিফাই করে দেখবে।
দ্বিতীয়ত— অবশ্যই KYC জমা দিতে হবে। অর্থাৎ আধার কার্ড, প্যান কার্ড, সঙ্গে ড্রাইভিং লাইসেন্স বা পাসপোর্টও হতে পারে। এগুলো অরিজিনাল নিয়ে যাওয়াই ভালো। যদিও ব্যাঙ্কে ফোটোকপিতে ভেরিফাইড উইথ অরিজিনাল স্ট্যাম্প মেরে, অর্থাৎ ব্যাঙ্ক যাবতীয় ডকুমেন্ট ভেরিফাই করে তবেই ফেরত দেবে।
ব্যাঙ্ক অবশ্যই আবেদনকারীদের ছবি চাইবে। ক্লেইমেন্টদের একটা ফর্ম দেবে। ক্লেইমেন্ট বা উত্তরাধিকারীরা সেই ফর্ম ফিলাপ করে দেবেন। সেখানে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি, যিনি ওই আবেদনকারীদের চেনেন দীর্ঘদিন ধরে, আবার সমাজেও সম্মাননীয় (রেসপেক্টেবল), ওই ব্যাঙ্কে দীর্ঘদিন ধরে অ্যাকাউন্ট আছে (এমন লোককে ব্যাঙ্কও উইটনেস বা সাক্ষী হিসেবে পছন্দ করে) এমন একজন মানুষের স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়।
ব্যাঙ্ক চাইলে ওই ব্যক্তির স্বাক্ষরে সন্তুষ্ট নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক ওই আবেদন নাকচ করতে পারে। মনে রাখতে হবে, এমন লোকের স্বাক্ষর প্রয়োজন ওই ফর্মে, যাকে ব্যাঙ্কও চেনে। অর্থাৎ ব্যাঙ্কেও অ্যাকাউন্ট আছে, সমাজেও সম্মানিত এবং আবেদনকারীদেরও তিনি দীর্ঘদিন ধরে চেনেন। সমাজে যাঁর সুনাম আছে। ওই ব্যক্তি আবেদনকারীদের আত্মীয় না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
যদি ওই অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থ, সব উত্তরাধিকারীরা ‘ক্লেইম’ না করেন, আবার যাঁরা ক্লেইম করছেন তাঁদের ক্লেইম এর ব্যাপারে কোনও আপত্তি না থাকে, তাহলে ওই ফর্মে তাঁদেরও ‘নো অবজেকশন’ দিতে হয়। অর্থাৎ ওই ক্লেইমেন্টরা অর্থ পেলে তাঁদের কোনও আপত্তি নেই বা ভবিষ্যতেও তাঁরা দাবি করবেন না।
এছাড়াও, নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প পেপারে একটা ‘লেটার অব ইনডেমনিটি’ দিতে হয় যেটা নোটারি এফিডেভিট করে নিতে হয়। তারপরে, ব্যাঙ্ক নিজেরা একটা এনকোয়ারি করে দেখে নেয়, এবং সব দিক ঠিক থাকলে, ব্যাঙ্ক ওই অর্থ আবেদনকারীকে/আবেদনকারীদের দিয়ে দেয়।
এবারে আসি, আলোচনার দ্বিতীয় ভাগে। অর্থাৎ যখন ব্যাঙ্কে রাখা টাকার সংখ্যাটা বেশি এবং যদি নমিনি না থাকেন। আগে এক লাখের বেশি পরিমাণ টাকার কথা বলা হতো। এখন সাধারণভাবে পাঁচ লাখ টাকা বা তার বেশি পরিমাণ টাকার কথা বলা হয়। তাও এক ব্যাঙ্ক থেকে অন্য ব্যাঙ্কে নিয়মাবলি অনেকসময়ই আলাদা হয়। তবু পাঁচ লাখ বা তার বেশি পরিমাণ টাকার ক্ষেত্রে, সেখানে মোটামুটি নিয়ম এক হলেও এখানেও একটা ডিক্লারেশনের প্রশ্ন আসে। বিভিন্ন ‘ফরমালিটি’র বিষয় থাকে। ‘লেটার অব ইনডেমনিটি’ ইত্যাদির বিষয় থাকে— তবে, তা হবে যাঁরা ওই অর্থ দাবি করছেন তাঁরা যদি একমত হন।
ব্যাঙ্কের যদি দাবিদারদের নিয়ে কোনওরকম সন্দেহ হয়, তাহলে, ব্যাঙ্ক ‘সাকসেশন সার্টিফিকেট’ বা ‘উইল’ থেকে থাকলে প্রোবেট বা ‘লেটার অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ নিয়ে আসতে বলবে। সেক্ষেত্রে, ওই দাবিদারদের আদালতের শরণাপন্ন হতেই হবে।
২. পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার মেয়েদের কতটা? শুধু কি জমি-বাড়ি, নাকি জমানো টাকাতেও সমান অধিকার?
আইন বলছে বিয়ে হোক বা না হোক পৈতৃক সম্পত্তিতে সমানাধিকার মেয়েদের রয়েছে। কী বলছে আইন? হিন্দু মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার বুঝতে হলে আগেই বলে নেওয়া জরুরি যে, হিন্দুদের মধ্যে দুটো বড় ভাগ আছে— দয়াভাগ আর মিতাক্ষরা। সহজ করে বুঝিয়ে বললে বাঙালিরা মূলত দয়াভাগ হিন্দুদের পর্যায়েই পড়েন— পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও অসমের বাঙালিরা এই পর্যায়ভুক্ত।
দয়াভাগ হিন্দুদের ক্ষেত্রে পৈতৃক সম্পত্তিতে মেয়েদেরও সমানাধিকার রয়েছে। আজকাল অবশ্য মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন সময়ের রায়ের বলে মিতাক্ষরা হিন্দু মেয়েরাও সমানাধিকার পাচ্ছেন।
অর্থাৎ, পৈতৃক সম্পত্তিতে ছেলের সমান অধিকার একটি মেয়েরও রয়েছে— এমনকী বিবাহিতা মেয়েরাও বাবার সম্পত্তিতে সমানাধিকার দাবি করতে পারেন।
আর একটু গভীরে যাব—
মনে করুন, বাবা কিংবা মা, তাঁদের সম্পত্তি সম্পর্কে কোনও লেখাপড়া না করেই মারা গেলেন। তাহলে তাঁদের যদি একটি করে ছেলে মেয়ে থাকে, তাহলে তাঁরা উভয়েই ওই সম্পত্তির অর্ধেক অংশের মালিক হবেন— অর্থাৎ তাঁরা উভয়েই অংশ করে পাবেন। এখানে, মেয়ের বিয়ে হয়েছে নাকি হয়নি, তাঁর অন্যত্র বাসস্থান আছে কী নেই, তা কোনওভাবেই গ্রাহ্য হবে না। অর্থাৎ, মেয়েও পরিষ্কার সমানাধিকার পাবেন।
অনেক আগে, মেয়েদের ‘dwelling House’ বা বাসস্থান-এ অধিকার ছিল না। কিন্তু আইনের বিভিন্ন সময়ের পরিবর্তনের ফলে এখন মেয়েরা বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি সব কিছুতেই সমানাধিকার পাবেন।
একইভাবে, বাবা-মায়ের জমানো টাকা পয়সা, গয়নাগাটি, ফিক্সড ডিপোজিট সব কিছুতেই মেয়েদেরও সমানাধিকার থাকে। এমনকী মেয়ে বিবাহিতা হলেও অনেকেরই ধারণা আছে, বিবাহিতা মেয়েদের বোধ হয় পৈতৃক সম্পত্তিতে সমানাধিকার নেই— তাঁদের জানাই, বিবাহিতা মেয়েদেরও পৈতৃক সম্পত্তিতে সমানাধিকার থাকে।
পাশাপাশি, আর একটা কথাও জানিয়ে রাখি, বাবা মারা যাওয়ার আগে যদি তাঁর নিজের সম্পত্তি (এমনকী টাকা-পয়সাও) যদি দানপত্র করে অন্য কাউকে দিয়ে যান, তাহলে কিন্তু মেয়ের আর কিছু করার থাকবে না।
আবার এটাও ঠিক যে দানপত্র আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায়, তবে তা বেশ কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ।
বাবা কিংবা মা যদি তাঁদের নামাঙ্কিত সম্পত্তি উইল করে অন্য কাউকে দিয়ে যান তাহলে অবশ্য ওই উইলকর্তা বা উইল কর্ত্রীর মৃত্যুর পর মেয়ে চাইলে ওই উইলের প্রোবেট নেওয়ার সময় আদালতে উপস্থিত হয়ে আপত্তি দাখিল করতে পারেন।
এবার আসি বিবাহ বিচ্ছিন্না বা বিধবা মেয়েদের বাপের বাড়িতে অধিকার প্রসঙ্গে। ঠিক একজন অবিবাহিত মেয়ের যেমন অধিকার থাকে তেমনই একজন বিবাহিতা মহিলার বিয়ের পরেও বাবার বাড়িতে পূর্ণ অধিকার থাকে। সুতরাং শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আসা, বিবাহবিচ্ছিন্না ও বিধবা— সকলেই বাবার সম্পত্তির সম্পূর্ণ হকদার। টাকা-পয়সা, জমি-বাড়ি, শেয়ার অর্থাৎ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি যাই থাকুক না কেন দাবি করতে পারেন। একক সন্তান হলে এবং মায়ের অবর্তমানে পুরোটাই দাবি করতে পারেন মেয়ে।
৩. ছেলে যদি বাবা-মায়ের দায়িত্ব না নেয় তবে বাবা-মা কী কী আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন?
‘মেইনটেন্যান্স অব পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজেন্স অ্যাক্ট ২০০৭’— প্রায় নতুন একটি আইন, যদিও এই আইনটি সম্পর্কে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ এখনও প্রায় কিছুই জানেন না। কিন্তু এই আইনটি দেশের আইন প্রণেতাদের চমৎকার চিন্তাভাবনার ফসল। দেশের প্রবীণ বা বয়স্ক মানুষদের সুরক্ষা দেওয়ার প্রশ্নে আইন প্রণেতাদের সদিচ্ছার যে অভাব নেই তা এই আইনটি দেখলেই বোঝা যায়।
এই আইন অনুযায়ী ছেলে বা মেয়ে বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে বাধ্য।
এই আইনে মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের কাছে ‘মেইনটেন্যান্স’ বা ‘খোরপোশ’ চেয়ে আবেদন করতে পারেন।
পালক পিতা-মাতা বা সৎ বাবা-মাও, তাঁদের সন্তানদের কাছে খোরপোশ চেয়ে আবেদন করতে পারেন। এই আইনে সিনিয়র সিটিজেন বলতে ৬০ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সি যে কোনও ভারতীয় নাগরিককেই বোঝানো হয়েছে।
দশ হাজার টাকা পর্যন্ত খোরপোশ পাওয়া যেতে পারে। ইচ্ছাকৃতভাবে বাবা-মাকে দেখাশোনা না করার অপরাধ প্রমাণিত হলে তিন মাস পর্যন্ত জেল অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
আবার ‘হিন্দু অ্যাডপশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স অ্যাক্ট, ১৯৫৬’— এই আইন অনুযায়ী ছেলে এবং মেয়েকে তাঁদের অশক্ত এবং বয়স্ক বাবা-মাকে দেখভাল করার আইনি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বাবা-মা বলতে এই আইনেও সৎ বাবা-মায়ের কথা বলা হয়েছে।
অনেকেই হয়তো জানেন না যে ‘গার্হস্থ্য হিংসা নিবারণী আইন ২০০৫’ অনুযায়ী মায়েরা তাঁদের ছেলের করা গার্হস্থ্য হিংসার বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন। তাঁরা তাঁদের ছেলের কাছ থেকে এই আইন অনুযায়ী আর্থিক সুরাহা দাবি করতে পারেন।
শুধু তাই নয়, মায়েরা ছেলেদের কাছ থেকে থাকার জায়গা বা সেই সংক্রান্ত খরচও চাইতে পারেন।
‘ফৌজদারি কার্যবিধি’তে বা ‘ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড’ এর ১২৫ ধারা অনুযায়ীও বাবা-মা তাঁদের সন্তানদের কাছ থেকে খোরপোশ চাইতে পারেন। দেখাতে হবে যে, ছেলে-মেয়েরা বাবা মায়েদের অবহেলা করছেন।
এই আইন অনুযায়ী খোরপোশ পাওয়ার কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই। সন্তানের রোজগার এবং বাবা-মায়ের প্রয়োজনীয়তার দিকে নজর রেখে, মাননীয় ম্যাজিস্ট্রেট খোরপোশের পরিমাণ নির্ধারণ করেন।
৪. স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তিতে স্ত্রীর কতটা অধিকার?
স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তিতে স্ত্রীর অধিকার সাধারণভাবে অবশ্যই থাকে। তবে এখানে বেশ কয়েকটি ‘কিন্তু’, ‘যদি’, ‘অথবা’-এর মতো শব্দ লুকিয়ে আছে।
ধরা যাক, শ্বশুরমশাইয়ের নামাঙ্কিত সম্পত্তি এবং শ্বশুরমশাই জীবিত আছেন, সেক্ষেত্রে শ্বশুরমশাই ইচ্ছে করলে তাঁর নিজের ওই সম্পত্তি জীবদ্দশায় অন্য কাউকে দানপত্র করে দিয়ে যেতেই পারেন—
অর্থাৎ ছেলের মৃত্যুর পর বাবা তাঁর নিজের সম্পত্তি বিধবা পুত্রবধূকে না দিয়ে অন্য কাউকে দান করে দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ওই বিধবা পুত্রবধূর কিছুই করার থাকবে না। ওই দানপত্র অবশ্য আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায় তবে তা বেশ কঠিন ও সময় সাপেক্ষ।
শ্বশুরমশাই যদি মৃত্যুর আগে দানপত্র অথবা উইল না করে থাকেন তাহলে অবশ্য অন্য কথা।
মনে রাখতে হবে, আমাদের উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী বাবা মারা গেলে তাঁর সম্পত্তি সন্তানের উপর বর্তে যায়। অর্থাৎ শ্বশুরমশাই যদি আগে মারা যান তাহলে অবশ্য তাঁর সম্পত্তি তাঁর ছেলের উপর বর্তে গিয়েছে এবং তারপর ওই ছেলের মৃত্যুর পর সেই সম্পত্তিটি আবার বর্তে যাবে তাঁর স্ত্রীর উপর।
তার মানে দাঁড়াচ্ছে, যদি শ্বশুরমশাই বেঁচে না থাকেন তাহলে তাঁর মৃত্যুর পর সম্পত্তি পাচ্ছেন তাঁর ছেলে এবং ওই ছেলের মৃত্যুর পর তাঁর বিধবা পুত্রবধূ।
কিন্তু শ্বশুরমশাই বেঁচে থাকাকালীন যদি তাঁর ছেলের মৃত্যু হয় তাহলে বিধবা পুত্রবধূকে তিনি তাঁর সম্পত্তি দেবেন কি না এটা তাঁর উপরেই নির্ভর করে।
এই কোভিড পরবর্তী সময়ে অন্তত পাঁচজন মহিলা আমার কাছে এসে অভিযোগ জানিয়েছেন যে, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে স্বামীর অকালমৃত্যুর পর শ্বশুরমশাই আর বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছেন না। এটা ঠিক যে শ্বশুরমশাইয়ের নিজের বাড়িতে ঢুকতে না পেরে তাঁরা চরম আতান্তরে পড়েছেন তবে সেখানে আমরা দেওয়ানি মামলা দায়ের করার পাশাপাশি ‘গার্হস্থ্য হিংসা নিবারণী আইন বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট’-এর অধীনে মামলা করে ‘থাকার অধিকার’ বা ‘রাইট অব রেসিডেন্স’ চাইতে বলেছি।
৫. আমরা দুই ভাই, এক বোন, বাবা মৃত্যুর কিছুদিন আগে বোনের বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি তার যাবতীয় ব্যাঙ্কে রাখা টাকা পয়সা ইত্যাদির নমিনি করে যান আমাদের একমাত্র বোনকে। বাবা মারা যাবার পর খবর পেয়েছি, আমাদের বোন, সমস্ত টাকা-পয়সা তুলে নিয়েছে। কিন্তু, সেই সব টাকা পয়সার ভাগ আমাদের দিতে চাইছে না। কী করব?
অনেকেই মনে করেন, বাবা-মা যদি ছেলেমেয়েদের মধ্যে কাউকে বা কোনও একজনকে যদি তাঁদের ব্যাঙ্কে রাখা যাবতীয় টাকা-পয়সার নমিনি করে দেন তার মানে বোধহয়, তাঁকেই ব্যাঙ্কে রাখা যাবতীয় টাকা-পয়সা দিয়ে গেলেন বিষয়টা কিন্তু আদৌ তা নয়।
যেমন আপনার ক্ষেত্রে। আপনার দুই ভাই, এক বোন, বাবা মৃত্যুর আগে তাঁর ব্যাঙ্কে রাখা যাবতীয় টাকা-পয়সা ইত্যাদি বোনকেই নমিনি করে দিয়ে গেছেন। আপনার বোনের হয়তো ধারণা হয়েছে, যেহেতু মৃত্যুর আগে বাবা তাঁর কাছে ছিলেন এবং তিনি বাবার সেবা যত্ন দেখভাল করেছেন। কাজেই, বাবা তাঁকে ব্যাঙ্কে রাখা যাবতীয় টাকা-পয়সা দিয়ে গেছেন। কিন্তু, আপনাকে জানাই আইনি পরিভাষায়, ‘নমিনি’ হলেন, ‘কাস্টেডিয়ান অব দ্য প্রপার্টি’ অর্থাৎ আপনার বোন হলেন, ওই অর্থের শুধুমাত্র ‘কাস্টেডিয়ান’।
আরও ভালো করে বলি, আপনার বাবা যদি তাঁর জীবদ্দশায় উইল দানপত্র ইত্যাদি করে তাঁর স্থাবর অস্থাবর যাবতীয় সম্পত্তি আপনার বোনকে না দিয়ে যান তবে, ওই ব্যাঙ্কে রাখা টাকা-পয়সাও, তাঁর অন্য সন্তানদেরও অর্থাৎ আপনাদের অধিকার থাকবে।
আপনার বাবার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নমিনি হিসেবে আপনার বোনের কর্তব্য হবে, ওই অ্যাকাউন্টের থাকা যাবতীয় অর্থ সঠিকভাবে অন্য ভাই-বোনদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দেওয়া। মনে রাখবেন, নমিনি হিসেবে আপনার বোন ওই অর্থ একা ভোগ করতে পারবেন না। আপনার বাবা যদি উইল, দানপত্র ইত্যাদি কিছুর মাধ্যমে বোনকে সব সম্পত্তি না দিয়ে যান, তাহলে ওই সমস্ত সম্পত্তিতে আপনাদের দুই ভাই-এর অধিকার আছে। সেক্ষেত্রে আপনার বাবার মৃত্যুর পর ওই সমস্ত সম্পত্তিতে বর্তমানে আপনাদের প্রত্যেকের এক তৃতীয়াংশের অধিকার, যদি অবশ্য আপনার মা বেঁচে না থাকেন। আপনার ‘মা’ বর্তমানে বেঁচে থাকলে, তাঁরও একটি অংশের অধিকার থাকবে। সেক্ষেত্রে, আপনার তিন ভাই বোন ও মা কে নিয়ে মোট চার জন হলেন এবং প্রত্যেকের একের চার অংশ করে হবে।
যদি মোট সম্পত্তি থেকে আলাদা করে আপনাদের অংশ বের করতে চান তাহলে আপনাকে বা আপনার ভাই নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা চেয়ে পার্টিশনের মামলা দায়ের করতে হবে। আর যদি আপনাদের মধ্যে সদ্ভাব থাকে তাহলে আপনারা মিউচুয়াল পার্টিশন ডিড-এর মাধ্যমেও মোট সম্পত্তির ভাগাভাগি করে নিতে পারেন।
এবার আসি কোন কোন ক্ষেত্রে বাবার পেনশনে কন্যাসন্তান বা পুত্রসন্তানের দাবি থাকে?
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নাবালক পুত্র, অবিবাহিতা কন্যা এবং বিশেষভাবে সক্ষম সন্তান, এরা মৃত বাবার পেনশন পাবার অধিকারী।
তবে অবসরকালীন পেনশন বা কর্তব্যরত অবস্থায় মারা গেলে ওই নির্দিষ্ট চাকরিতে— নাবালক পুত্র, অবিবাহিতা কন্যা এবং বিশেষভাবে সক্ষম সন্তানেরা পেনশন পাবার অধিকারী। রাজ্য সরকার ও কেন্দ্র সরকারের চাকুরেদের ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতিও আলাদা হতে পারে, সেটা মাথায় রাখতে হবে।
৬. দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ থাকা ব্যক্তির সম্পত্তি বা টাকা-পয়সা কি পরিবারের সদস্যরা ভোগ করতে পারেন? বা নিজেদের নামে করতে পারেন?
পরিবারের সদস্য দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ থাকলে স্বাভাবিক ভাবেই পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপর তাঁর সম্পত্তির অধিকার বর্তায় না।
প্রথমে, পরিবারের যে সদস্য নিখোঁজ বা নিরুদ্দেশ, তাঁর নিখোঁজ হওয়ার পর তাঁকে খোঁজার জন্য যাবতীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন, থানায় অভিযোগ জানানো ইত্যাদি।
যথাবিহিত পদক্ষেপ নেওয়ার পরও যদি ওই নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে খুঁজে না পাওয়া যায় বা তাঁর সম্পর্কে কোনও খবর না পাওয়া যায় তাহলে নিরুদ্দেশ হওয়ার পর সাত বছর অতিক্রান্ত হলে, আপনাদের এলাকার (জুরিসডিকসন) জেলা জজের আদালতে আবেদন করে ওই নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করাতে হবে। তারপর, উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, ওই মৃত ঘোষিত ব্যক্তির সম্পত্তি সমস্ত আইনানুগ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ভাগ করা যাবে। আগে উত্তরাধিকারীরা নিজেদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা করবেন। তারপর অবশ্যই স্থাবর সম্পত্তি হলে তা নিজের বা নিজেদের নামে করতে পারবেন।
৭. প্রথম বিবাহ আইনি নয়, এই অবস্থায় দ্বিতীয় বিবাহ করলে প্রথম পক্ষের স্ত্রী-র কোনও দাবি থাকতে পারে কি?
এই প্রশ্নের উত্তরে বলব, যেমনটা আপনি বলছেন প্রথম বিবাহটাই আইনি নয় তাহলে বলতে হয় ওই বিবাহটা আইনিভাবে বৈধ নয়।
হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান প্রভৃতি যে কোনও ধর্মেই নির্দিষ্ট বিবাহ পদ্ধতি আছে। যেমন হিন্দু বিবাহ আইন, মুসলিম শরিয়তি আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট বিবাহ পদ্ধতি, খ্রিস্টানদের জন্য নির্দিষ্ট বিবাহ পদ্ধতি। এর সঙ্গেই রয়েছে ১৯৫৪ সালে প্রণীত ‘বিশেষ বিবাহ আইন’ যেখানে দুটি ভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যেও বিবাহ সম্পন্ন হতে পারে।
এর মধ্যে যে কোনও পদ্ধতি অবলম্বন করে বিবাহ সম্পন্ন হলে সেই বিবাহটি আইনিভাবে বৈধতা পায়। হিন্দু বিবাহ আইন অনুযায়ী একটি বিবাহ বজায় থাকলে বা একটি আইনি ভাবে হওয়া বিবাহ বজায় থাকলে দ্বিতীয় বিবাহ করার অনুমতি দেওয়া হয় না। কাজেই সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিবাহ আইনিভাবে বৈধ হয় না। আপনার প্রশ্ন অনুযায়ী প্রথম বিবাহ আইনি নয়। অর্থাৎ ধরে নিচ্ছি প্রথম বিবাহ আইনিভাবে বৈধ নয়। এই অবস্থায় পরবর্তী যে বিবাহ আইনি পদ্ধতিতে করা হবে, সেই বিবাহই ‘প্রকৃত’ ও ‘বৈধ’ বিবাহের স্বীকৃতি পাবে।
অর্থাৎ আইন মেনে বিবাহ না হলে, সেই বিবাহের আইনি স্বীকৃতি মেলে না। উদাহরণ দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করছি—যেমন হিন্দু বিবাহ আইন অনুযায়ী আগুনের চারপাশে ঘোরা, সাত পাক ঘোরা বা সপ্তপদী, মালা বদল, সিঁদুর দান এগুলো সবই হিন্দু বিবাহ আইন ও রীতিনীতি স্বীকৃত। এই পদ্ধতিগুলি মেনে বিবাহ হলে তা অবশ্যই বৈধ বিবাহ।
আবার ‘স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট’ ১৯৫৪ বা ‘বিশেষ বিবাহ আইন’ ১৯৫৪ দ্বারাও রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে বিবাহ আইন স্বীকৃত।
অর্থাৎ, যদি আইন মেনে প্রথম বিবাহটা হয় তাহলে হিন্দুদের মধ্যে দ্বিতীয় বিবাহ কিছুতেই আইনি স্বীকৃতি পাবে না, ওই প্রথম স্ত্রী জীবিত থাকাকালীন বা তাঁদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ না হলে।
হিন্দু বিবাহ আইন অনুযায়ী, প্রথম বিবাহ ‘বৈধ’ ও ‘বজায়’ থাকাকালীন কিছুতেই দ্বিতীয় বিবাহ করা যায় না।
যদি কোনও পুরুষ কোনও মহিলার সঙ্গে ‘লিভ-ইন’ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে মনে রাখবেন আইনি পদ্ধতিতে তাঁর সঙ্গে বিবাহ না হলে তিনি শুধুমাত্র একজন লিভ-ইন পার্টনার। বিবাহিত স্ত্রীর মর্যাদা তিনি দাবি করতে পারবেন না।
কাজেই বিবাহ বৈধভাবে না হলে একজন মহিলা কখনওই পুরুষের কাছ থেকে বৈধ স্ত্রীর মর্যাদা ও অধিকার দাবি করতে পারবেন না।
কিন্তু যদি এমন হয় প্রথম বিবাহ আইনি ও বৈধ ভাবে হওয়া সত্ত্বেও এবং প্রথম স্ত্রী বেঁচে থাকা সত্ত্বেও অর্থাৎ প্রথম বিবাহ বজায় থাকা সত্ত্বেও ওই পুরুষটি দ্বিতীয়বার বিবাহ করছেন, তাহলে হিন্দু আইনে ওই বিবাহ ‘বৈধ’ হবে না।
হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী বিবাহিতা স্ত্রী স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর রেখে যাওয়া সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন। তবে, অবৈধ সম্পর্কের ফলে জন্ম নেওয়া সন্তানেরা কিন্তু পিতার সম্পত্তি দাবি করতে পারেন। অর্থাৎ, সব শেষে বলব, বৈধ বিবাহ ছাড়া পুরুষ সঙ্গীর কাছ থেকে সম্পত্তির ভাগ পাওয়া অসম্ভব। তবে, ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট’ বা গার্হ্যস্থ হিংসা নিবারণী আইন এর বলে লিভ-ইন পার্টনার অর্থাৎ মহিলা সঙ্গীটি তাঁর পুরুষ সঙ্গীর কাছ থেকে ‘আর্থিক সুরাহা’ (মনিটারি রিলিফ) ও ‘থাকার অধিকার’ (রেসিডেন্স অর্ডার) চাইতে পারেন।
৮. অবিবাহিত বোন বা ভাই দাদা-বউদির সংসারে থাকে, দাদার মৃত্যুর পর কী কী আইনি রক্ষাকবচ আছে তাঁদের জন্য?
বহু মানুষ এই প্রশ্নটা করে থাকেন। বিশেষত যেখানে বাবা-মা হয়তো মারা গেছেন। দিদি কিংবা বোনের বিয়ে হয়নি ভাই কিংবা দাদা হয়তো বিয়ে করে নিয়েছেন। বউদি বা ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে অবিবাহিতা ননদের বনিবনা হচ্ছে না এই নিয়ে সংসারে অশান্তি লেগেই থাকছে।
বাড়ি যদি বাবা কিংবা মায়ের নামাঙ্কিত হয় এবং তা যদি তাঁরা দাদা-ভাইকে দানপত্র করে হস্তান্তর না করে থাকেন তাহলে বর্তমান আইন অনুযায়ী সেই সম্পত্তিতে দাদা/ভাইয়ের যেমন অধিকার থাকে, তেমনই দিদি/ বোনেরও অধিকার থাকবে— অর্থাৎ মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে হয়তো চিন্তা রইল না, কিন্তু হয়তো দৈনন্দিন খরচ ও খাওয়াদাওয়ার খরচ নিয়ে চিন্তা থেকেই যাবে।
সাধারণভাবে অবিবাহিত বোন কিংবা ভাইই হন তাঁদের প্রতিপালন করবার জন্য আইনি দায় দাদা/ভাইয়ের না থাকলেও, চাইলে ‘গার্হস্থ্য হিংসা নিবারণী আইন’ অনুযায়ী দিদি/বোন, দাদা/ভাইয়ের কাছ থেকে আর্থিক সুরাহা ও বাসস্থানের অধিকার চেয়ে মামলা করতে পারেন।
তবে দাদার মৃত্যুর পর বউদি যদি ওই অবিবাহিতা দিদি/ বোন/ ভাইয়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন তাহলে সমস্যা বাড়ে বইকি।
তবে আজকাল মহিলারাও মহিলাদের বিরুদ্ধে ‘গার্হস্থ্য হিংসা নিবারণী আইন’ অনুযায়ী আর্থিক সুরাহা, বাসস্থানের দাবি, ‘প্রোটেকশন অফিসার’-এর কাছ থেকে সুরক্ষা চেয়ে মামলা করতে পারেন। সেই অনুযায়ী অবিবাহিতা দিদি/বোনের ওপর দাদার মৃত্যুর পর যদি বউদি অত্যাচার করতে থাকেন তাহলে বউদির বিরুদ্ধে মাননীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলা করতে পারেন। অবিবাহিত দাদা-ভাই অবশ্য তা পারবেন না।
এটাও জানিয়ে রাখা কর্তব্য যে, আলাদা করে দাদা কিন্তু তাঁর জীবদ্দশাতে অবিবাহিতা বোন বা অবিবাহিত ভাইদের ভরণপোষণের দায়িত্ব না নিতে চাইলে, সেই দাদাকে জোর করে বাধ্য করাটা নিতান্ত অসম্ভব।
সেখানে দাদার মৃত্যুর পর বউদিকে অবিবাহিতা ননদ বা অবিবাহিত দেওরের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধ্য করাটাও একইরকম অসম্ভব।
৯. জোর করে জমি দখল করে রাখলে কী করণীয়?
জোর করে অন্যের জমি দখল করে রাখা একেবারে বেআইনি এবং জমির মালিকের উচিত তৎক্ষণাৎ আইনি পদক্ষেপ নেওয়া। জোর করে অন্যের জমি দখলকারীকে বেআইনি দখলদার বলা হয়। আর যদি জোর করে অন্যের জমি দখল করে কেউ সেই জমিতে ঢুকে বসে থাকেন তাহলে তাঁকে অনুপ্রবেশকারী বা অনধিকার প্রবেশকারী বলা হয়। ওই অনধিকার প্রবেশকারী ব্যক্তিকে বা অনুপ্রবেশকারী বা অনধিকার প্রবেশকারী ব্যক্তিকে প্রকৃত মালিকের জমি থেকে বিতাড়িত করার জন্য বা বেআইনি দখলদার অবস্থা থেকে উচ্ছেদের জন্য নিকটবর্তী বা স্থানীয় জুড়িসডিকশনের দেওয়ানি আদালতে উচ্ছেদের মামলা বা অ্যাভিকশন সুইট মামলা করতে হয়, এবং একই সঙ্গে ওই বেআইনি দখলদার ব্যক্তি যাতে ওই সম্পত্তি কোনওরকম হস্তান্তর করতে না পারে এবং কোনওরকম বেআইনি কাজ করতে না পারে, তার জন্য ওই স্যুট মামলার সঙ্গেই একটি ইনজাংশন মামলাও করা যেতে পারে।
এই ধরনের প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে আর একটি ভাগও জড়িয়ে থাকে। সাধারণভাবে আমরা দেখি যে ওই তথাকথিত বেআইনি দখলদার জমির মালিকানাও দাবি করে বসে। এমনটা হলে, তাঁদের বক্তব্য হয় ওই জমি তারাও কিনেছেন।
তখন জমির প্রকৃত মালিকের উচিত, ওই জমিটি তাঁরই, সেটা আদালতে প্রমাণ করা। সেইজন্য ‘ডিক্লারেটারি স্যুট’ বা ‘সুট ফর ডিক্লারেশন’- এর মামলা আদালতে দাখিল করতে হয়। অর্থাৎ, আদালতের কাছে প্রার্থনা করতে হয়, যাতে আদালত ‘ডিক্লেয়ার’ করেন বা ঘোষণা করেন যে ওই জমির মালিক প্রকৃতপক্ষে তিনিই।
আবার কখনও কখনও জমির দখল ফেরত পাবার জন্য ‘রিকভারি স্যুট’ মামলাও দাখিল করতে হয়। এটিও একটি দেওয়ানি মামলা এবং যতদিন না মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে ততদিন ওই মামলাতে ইনজাংশন চাওয়া হয়। নিম্ন আদালতের রায়ে সন্তুষ্ট না হলে উচ্চ আদালতে মামলা করা যায়।
১০. ডিভোর্সের মামলায় কখন স্ত্রী খোরপোশ দাবি করতে পারেন?
ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী যদি কোনও ব্যক্তি তাঁর যথেষ্ট রোজগার সত্ত্বেও নিজের স্ত্রীকে অবহেলা করেন বা যথাযোগ্য প্রতিপালন না করেন তাহলে ওই স্ত্রী খোরপোশ চেয়ে আবেদন করতে পারেন। হিন্দু বা মুসলমান উভয় ধর্মের মহিলাদের ক্ষেত্রেই এই আইন প্রযোজ্য।
আবার স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ ডিভোর্স-এর মামলা বা ‘রেস্টিটিউশন অব কনজুগাল রাইটস’ বা ‘বিবাহিত সম্পর্ক পুনস্থাপন’-এর মামলা করলেও আর এক ধরনের খরচ বা খোরপোশ চাইতে পারেন, আইনের পরিভাষায় যাকে বলে ‘অ্যালিমনি পেনডেনটিলিটে’।
‘হিন্দু বিবাহ আইন’ ও ‘বিশেষ বিবাহ আইন’, এই দুই ধরনের বিবাহ আইনেই ‘অ্যালিমনি’ পাওয়ার বিধান আছে। এই দুই ধরনের আইনেই স্ত্রীরা ‘অ্যালিমনি’ পেতে পারেন।
আবার ‘গার্হস্থ্য হিংসা নিবারণী আইন’ অনুযায়ীও একজন স্ত্রী ‘মানিটারি রিলিফ’ বা ‘আর্থিক সুরাহা’ পেতে পারেন।
মনে রাখতে হবে, স্ত্রী যদি নিজের প্রতিপালনে অক্ষম হন, আবার স্বামী যদি রোজগার যথেষ্ট থাকা সত্ত্বেও স্ত্রীকে প্রতিপালন না করেন, তাহলে স্ত্রী খোরপোশ অথবা অ্যালিমনি চাইতে পারেন।
অনেকেই ভাবেন স্ত্রী চাকরি করলে বোধহয় স্বামীর কাছ থেকে আর খোরপোশ চাইতে পারবেন না।
এখানে বলে রাখি, স্বামীর রোজগার যদি স্ত্রীর চাইতে অনেক বেশি হয় এবং স্ত্রীর রোজগার যদি তাঁর নিজের প্রতিপালনের জন্যও যথেষ্ট না হয় তাহলে কিন্তু আদালত সব দিক বিচার করে ও খতিয়ে দেখে স্ত্রীর রোজগার থাকা সত্ত্বেও তাঁকে আবার খোরপোশ/ অ্যালিমনি দেওয়ার জন্য স্বামীকে নির্দেশ দিতে পারেন।
এখানে জানিয়ে রাখি, মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের একটি বিশেষ রায়ের বলে, খোরপোশ বা অ্যালিমনির মামলা চলাকালীন স্বামী এবং স্ত্রীকে নিজের নিজের রোজগার সম্বন্ধিত এফিডেভিট দিতে হচ্ছে। সেখানে নিজেদের প্রকৃত রোজগার গোপন করাটা কিন্তু আইনত অপরাধ।
১১.ডিভোর্সের মামলায় স্বামী কি খোরপোশ দাবি করতে পারে?
এ প্রসঙ্গে বলে যায় ১৯৫৫ সালের ‘হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট’ অনুযায়ী, খোরপোশ স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই দাবি করতে পারেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্ত্রীই খোরপোশ পান। তবে স্বামী বিশেষ ভাবে সক্ষম হলে কিংবা আয় করতে অসমর্থ হলে তিনিও খোরপোশ পেতে পারেন। সাধারণভাবে স্বামীর আয়ের এক তৃতীয়াংশ বা এক পঞ্চমাংশ টাকা পান স্ত্রী। মাসিক কিস্তির ক্ষেত্রে স্বামীর বেতনের এক চতুর্থাংশ পর্যন্ত টাকা খোরপোশ হিসেবে পেতে পারেন স্ত্রী। ‘খোরপোশ’ চেয়ে মামলা করতে গেলে আগে ‘ডিভোর্স’ চেয়ে মামলা করতেই হবে এমন কোনও কথা নেই।
হিন্দু বিবাহ আইনের চব্বিশ নম্বর ধারায় পরিষ্কার বলা আছে, স্বামী প্রয়োজনে অর্থাৎ নিজস্ব উপযুক্ত রোজগার না থাকলে স্ত্রীর কাছ থেকে খোরপোশ (অ্যালিমনি) চাইতে পারেন। শুধু তাই নয়, তিনি স্ত্রীর কাছ থেকে মামলা চালাবার খরচও চাইতে পারেন। তবে, খোরপোশ কত দিতে হবে তা ঠিক করা হবে দুই পক্ষের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান বিচার করে।
আবার বিয়ে যদি ‘বিশেষ বিবাহ আইন’ বা ‘স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট’ অনুযায়ী হয় তবে অবশ্য স্বামী, স্ত্রীর কাছ থেকে খোরপোশ পাওয়ার অধিকারী নন। এই আইনে শুধুমাত্র স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে ‘ডিভোর্স’ মামলার সূত্রে খোরপোশ দাবি করতে পারেন।
এক্ষেত্রে আরও একটি প্রশ্ন ওঠে ডিভোর্সের পর কী পুত্রবধূ শ্বশুরবাড়ির গয়না রাখতে পারে?
আইন অনুযায়ী, একজন মহিলা, তাঁর বিয়েতে, বাপের বাড়ি থেকে যে গয়নাগাটি পাবেন, তাতে যেমন শুধুমাত্র তাঁরই অধিকার থাকে, তেমনি তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে বিয়েতে পাওয়া যাবতীয় গয়না-গাটিতে শুধুমাত্র তাঁরই অধিকার থাকে। যদি, বিয়ের পরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদও হয়ে যায়, তাহলেও আইনত ওই গয়নাগাটি, যাকে স্ত্রী ধন-সম্পত্তি (অর্থাৎ, একজন মহিলা তাঁর বিয়েতে শ্বশুরবাড়ি থেকে যে সব গয়নাগাটি ইত্যাদি পেয়ে থাকেন) বলে, সেই স্ত্রী ধন- সম্পত্তিতে, শুধুমাত্র, সেই মহিলারই অধিকার থাকে। বিয়ে উপলক্ষ্যে স্বামীর আত্মীয়-স্বজন যে গয়নাগাটি উপহার হিসেবে দিয়ে থাকেন, তা-ও ওই স্ত্রী-ধন সম্পত্তির আওতায় পড়বে। তবে হ্যাঁ, অনেকসময় যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে মিউচুয়াল ডিভোর্সের শর্ত হিসেবে অনেক সময়ই বলা হয়ে থাকে, বিয়ে উপলক্ষ্যে মেয়ের বাড়ি থেকে ছেলেকে যে গয়নাগাটি দেওয়া হয়েছিল, ছেলে পক্ষ সেই গয়না (যেমন—ঘড়ি, আংটি, সোনার বোতাম, সোনার চেইন ইত্যাদি) মেয়ের বাড়িকে ফেরত দেবে, আবার, ছেলের পক্ষ মেয়েকে (অর্থাৎ পুত্রবধূকে) বিয়ে উপলক্ষ্যে, যে গয়নাগাটি দিয়েছিল, সেগুলোও ফেরত চাইতে পারে। যে প্রশ্ন আপনি আমাকে করলেন, তার সোজাসাপটা উত্তর হল—বিয়েতে শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া যাবতীয় গয়না-গাটিকে স্ত্রী ধন- সম্পত্তি বলে, তাতে পুত্রবধূরই অধিকার থাকে। এমনকী ডিভোর্স হয়ে গেলেও ?