বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর

বঙ্গব্যঞ্জনে রসনাতৃপ্তি
কমলিনী চক্রবর্তী

বাঙালি রান্না মানেই বিভিন্ন বৈচিত্র্য। বাঙালি রান্না মানেই সাধারণের পাশে অসাধারণের বাস। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে বাঙালি রান্নার নানা দিক উঠে এল এই প্রতিবেদনে।

কথায় বলে মাছে ভাতে বাঙালি— প্রবাদবাক্যটি থেকেই স্পষ্ট বাংলার রান্নাঘরে মাছের প্রভাব। নদী প্রধান পুব বাংলায় মাছের অভাব ছিল না। তাই প্রথম থেকে শেষ পাত পর্যন্ত রান্নায় মাছের প্রাধান্য দেখা যেত। এমনকী শাক বা তরকারিও মাছ দিয়ে রান্না করার প্রচলন পুব বাংলার হেঁশেল থেকেই এসেছে। বাংলাদেশের খাওয়াদাওয়ায় মাছের প্রাচুর্য প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি। গল্পটা আমার ঠাকুরদা, কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মুখে শোনা। তাঁর প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার অভিজ্ঞতার একটুকরো স্মৃতিচারণও বলা যায়। পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার উলপুর জমিদার বংশের কন্যা সুষমা রায়চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়েছেন নীরেন্দ্রনাথ। জামাই আদরে পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়েছেন শ্বশ্রূমাতা। খাবারে প্রতি পদেই মাছ বিরাজমান। যত্নের যাতে ত্রুটি না হয় সেই কারণে ছোট শ্যালিকাটিকে রাখা হয়েছে তত্ত্বাবধানে। সে তখন বছর বারো-পনেরোর বালিকা। স্বভাবতই খাওয়াদাওয়ার তদারকে তেমন মন নেই। বরং দিদি আর নতুন জামাইবাবুকে নিয়ে বাড়ি সংলগ্ন পুকুরঘাটে যেতেই ব্যাকুল। সেখানে নৌকা বাঁধা আছে। তাই খাওয়াদাওয়ার পাট সেড়ে সকলে মিলে রওনা দিলেন পুকুরঘাটে। দ্বিপ্রাহরিক নৌকা বিহারের সাধ নীরেন্দ্রনাথের মনে। কিন্তু ঘাটে গিয়ে দেখেন নৌকা তো উল্টে রাখা। কাদায় নেমে তা সোজা করবে কে? এনিয়ে মোটেও চিন্তিত নয় তাঁর শ্যা঩লিকা। নিজেই কাপড় গুটিয়ে তরতর করে নেমে গেল সে সিঁড়ি বেয়ে। নৌকার দড়ি খুলে তা যেই না সোজা করেছে, অমনি নৌকার নীচ থেকে একঝাঁক কই মাছ বেরিয়ে কিলবিল করে জলে নেমে পড়ল। দীর্ঘদিন গ্রাম জীবনে অনভ্যস্ত কবি তো বিস্মিত। কিন্তু স্ত্রী সুষমা সহ বাড়ির অন্যান্যরা নির্বিকার। যেন এমটাই স্বাভাবিক। মাছের এমনই প্রাচুর্য ছিল পুব বাংলার ঘরে ঘরে। 
অথচ ভাবলে অবাক লাগে এহেন বাঙালিই কি না নিজেদের ঐতিহ্য ভুলে বিদেশি খাবারের পিছনে দৌড়চ্ছে! এখনকার প্রজন্মে মাছের কদর আদৌ আছে কি না জিজ্ঞেস করলে কলকাতার বিখ্যাত একটি বাঙালি রেস্তরাঁর কর্ণধার রঞ্জন বিশ্বাস বলেন, মাছের প্রতি এই প্রজন্মের আকর্ষণ হয়তো কমেনি, তবে তা রান্নার পদ্ধতি একটু বদলে নিয়েছে তাঁরা। সেখানে বিদেশি প্রভাব এনে মাছের বেকড, গ্রিলড, ফ্রায়েড পদই আধুনিক প্রজন্মের কাছে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে মাছের ঝোল ঝাল অম্বলের বদলে তাঁরা হয়তো বেছে নিচ্ছেন ক্রিস্পি ফ্রায়েড মৌরলা, ভেটকি চিংড়ি পপকর্ন, ইলিশ চিজবল জাতীয় রান্না। তাই বলে গতানুগতিক বাঙালি রান্না হারিয়ে যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়। এখনও যে কোনও অনুষ্ঠানে আমরা বাঙালির ঐতিহ্যপূর্ণ রান্নারই কদর করি। যেমন অন্নপ্রাশন থেকে বিয়ে সর্বত্রই কষা মাংস, মাছের কালিয়া, চিংড়ির মালাইকারি, ইলিশ ভাপে, পোলাও ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। শেষ পাতে আইসক্রিমের দাপটে দই অনেকটা চাপা পড়ে গিয়েছে ঠিকই, তবু বাঙালি মিষ্টির সঙ্গে কম্পিটিশনে কেউ নেই। সন্দেশ, রসগোল্লার পাশাপাশি পান্তুয়া, কমলাভোগ, এমনকী রাবড়িও পাবেন। 
আসলে বাঙালির খাবারের ধরনখানা ভারী অদ্ভুত। বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি ও লোকাচারের সংমিশ্রণ যেন। কোথাও বাংলাদেশি স্বাদ, কোথাও বা মুসলমানি মশলা, কোথাও আবার ইংরেজি কালচার! সব কিছুই মিলেমিশে একাকার বাঙালি রান্নায়। তাই মশলাপাতি থেকে উপকরণ সবেরই বিপুল বিস্তার। বাঙালি রান্নার ধরন নিয়ে সেলিব্রিটি শেফ সুশান্ত সেনগুপ্ত বলেন, এই খাবারের চরিত্রটাই বহুবিধ। যে কোনও স্বাদ, যে কোনও ঘ্রাণ এই রান্নায় পাওয়া যায়। আর সেই কারণেই বোধহয় বাঙালিরা এত বহুলমাত্রায় খাদ্যরসিক। আসলে সব স্বাদের সঙ্গেই তারা অভ্যস্ত। ফলে যে কোনও রান্নাই সহজে চেখে দেখতে পারে। বাঙালি রান্নায় এই প্রভাবের ইতিহাসটা একটু বিশ্লেষণ করলেই দেখবেন মোগল, ইংরেজ ছাড়াও বাংলার হেঁশেলে আঞ্চলিক প্রভাবও প্রচণ্ড। আর এই আঞ্চলিক প্রভাবের কারণেই বাঙালি রান্না এত বিভিন্ন, এত বিচিত্র। প্রতিটি মশলা ভিন্ন স্বাদ বহন করে, আর সেই স্বাদের ওপর ভর দিয়ে বাঙালি রান্না হয়ে ওঠে অনন্য। এমনকী একই উপকরণে ভিন্ন ফোড়ন এবং মশলার ব্যবহারে রান্নার স্বাদে আসে আমূল পরিবর্তন। আবার একই সঙ্গে অতি সাধারণ পদ্ধতিতেও বাঙালি রান্না সম্ভব। বাঙালি হেঁশেলে সাধারণ ও অসাধারণ রান্না পাশাপাশি ঘর করে। আর সেটাই এই রান্নার বিশেষত্ব এবং ইউএসপি। 
হালফিল বাঙালি রান্নায় আবার ফিউশন শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে সুশান্ত বলেন, বাঙালি রান্নার ক্ষেত্রে ফিউশনটা কিন্তু একটু অন্যরকম। অর্থাৎ শুধুই যে বাইরের প্রভাব মিশিয়ে এই রান্না হয় তা নয়, বরং বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের প্রভাবেও এই রান্নায় ফিউশন আনা হয়। এই শুক্তোর কথাই ধরুন, তারই নানা রকমফের। কেউ শুধুই তেতো দিয়ে শুক্তো রাঁধেন, কেউ বা তাতে মাছ মেশান, কেউ আবার তরকারির তারতম্য ঘটিয়ে শুক্তোর স্বাদ পুরোপুরি বদলে দেন। এখানেও শেষ নয়, শুক্তোর মশলাতেও আছে বৈচিত্র্য। কেউ সর্ষে বেটে ব্যবহার করেন, কেউ বা পোস্ত ছড়ান, কেউ আবার সর্ষে পোস্তর সংমিশ্রণে তৈরি করেন শুক্তো। ফলে বাঙালি রান্নার এই বহুবিধ স্বাদ ও ধরনই এই রান্নার উল্লেখযোগ্য দিক। অনেক ঘরানা, অনেক প্রভাবকে আয়ত্তে এনে বাঙালি রান্না হয়ে উঠেছে অনন্য, অসাধারণ।   
ছবি: ৬ বালিগঞ্জ প্লেস ও ৩৭ রেলিশ রুটের সৌজন্যে
 

15th     April,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ