বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর

যুগান্তের গর্ভে নতুন
যুগের জন্ম যন্ত্রণা
মৃণালকান্তি দাস

 

সেই কবে এই বাংলায় কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী বারমাস্যার ছবি এঁকেছিলেন। সেই বারমাস্যার যন্ত্রণা আজ অতীত। ভাতের অভাব কমেছে বাংলার মাটিতে। কৃষিতে সোনার বাংলা আজ গোটা দেশে ঈর্ষার। এখন ফসল, আবহাওয়ার উপর পরীক্ষা চলে গাছ-গাছালির কত গবেষণা। ঢ্যাঙা,  বেঁটে পাঁচমিশেলি ফল,  ফুল,  পাতার বাহার নিয়ে প্রকৃতিকে করে নিয়ন্ত্রণ। এভাবেই নিয়ন্ত্রণের পাকে বাঁধা পড়ে বাংলার পরিবেশ। উষ্ণ-কষ্ণ,  ঘেন্নাময় পরিবেশ।  ‘দারুণ অগ্নি বাণে’  শুধু কাব্যিক মাসটার স্মৃতি কেড়ে নিয়েছে—  নিদাঘ-বৈশাখে। নবপত্র গৌরবে ফুলের সাজি নিয়ে হে গম্ভীর...। কালবৈশাখীর মাতনে ভাঙে ডালপালা। সাময়িক বৃষ্টি, বাজের ঝিলিক আর ঝড়ের স্মৃতিতে গরমের মরশুম পার হয়ে যায় কখন। বিবেকের যন্ত্রণা রত্নাকর না হয়ে নতুন দর্শন খোঁজে। বাল্মীকির মতো সৃষ্টি করে চলে—  এক নয়া সমাজের। লালন গানে গানে গেয়ে ওঠেন,  ‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে... যেথায় মানুষে-মানুষে ভেদ না রবে...।’ সেই ভেদহীন সমাজ কোনওদিনই চায়নি এ বাংলার মানুষ। বাঙালিরা।
এ রাজ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গরিবের দিকে তাকাবার সরকার। চাষি মান পেয়েছে গাঁয়ে। টাকা খাটছে। মিলছে পাট্টা। এ রাজ্যে হাজারো কোটি টাকার জিনিস কেনার ক্ষমতার নাম  ‘বাজার।’  এ বাজার তো জনে জনে রাজার। আগে মুখ ব্যাজার করে থাকতে হতো। এখন বাজার চওড়া করে সব রাজার কল্যাণেই। গরিব কাজ পেলে, ফসলের দাম চাষি পেলে বাজার খোলে। এ বাংলার চাষি গতর ভাঙে—  বাঁচতে, বাঁচাতে। সেই চাষির ধর্ম জেনে লাভ কী?
সমন্বয়ধর্মিতাই বাংলার সমাজের বৈশিষ্ট্য। ধর্মীয় বিভাজনকে হারিয়ে এখানে বড় হয়ে উঠেছে লোকায়ত ধর্ম। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সম্প্রীতির বন্ধনকে দৃঢ় করেছিল বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতি,  গোঁড়া হিন্দু বা মুসলিম যেখানে দাঁত ফোটাতে ব্যর্থ। দেবদেবীর এই বিমিশ্রণ গ্রামজীবনে সম্প্রীতির ভিত তৈরি করেছে। কোন হিন্দু দেবতা কোন পির-গাজিতে রূপান্তরিত,  তা আছে ধর্ম ঠাকুরের গাজনে অনুষ্ঠানে  ‘ঘর ভাঙার ছড়া’য়:  ‘ধর্ম হৈল যবনরূপী শিরে পরে কালটুপি,  হাতে ধরে ত্রিকচকামান/ ব্রহ্মা হৈল মহম্মদ বিষ্ণু হৈল পেগম্বর মহৈশ হৈল বাবা আদম।/ গণেশ হৈল কাজী কার্তিক হৈল গাজী ফকির হৈল মুণিগণ।।/ তেজিয়া আপন ভেক নারদ হৈল শেখ পুরন্দর হৈল মৌলানা।/ চন্দ্রসূর্য আদি যত পদাতিক হৈয়া শত উচ্চৈঃস্বরে বাজায় বাজনা।’
যাঁরা বাঙালির এই সংস্কৃতি জানেন না, তাঁরাই আজ বাংলা দখলের স্বপ্ন নিয়ে ছুটছেন পথ,  গলিঘুঁজিতে। ভোটপ্রার্থীদের মহাসঙ্কীর্তন। বাংলার ভোটারের সঙ্গে মহামিলনের জন্য ছুটে আসছেন তাঁরা। ভোট-আলিঙ্গনের জন্য উদ্বাহু,  প্রসারিত। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মে ধর্মে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধাতে চায় অপশক্তি। কিন্তু লোকসংস্কৃতির শিকড় বাংলার মাটিতে এতই চারিয়ে গিয়েছে যে,  আগে লোকসম্পর্কের দৃঢ়বদ্ধ শিকড়কে ছিঁড়তে পারলে তবেই হিন্দু-মুসলিম বিভেদের স্বার্থসিদ্ধি হবে। বাঙালি তা হতে দেবে কি?  বাঙালি কি মেনে নেবে ধর্মলাঞ্ছিত ভোটের উৎসব?
গুজরাত থেকে উত্তরপ্রদেশ— সকলের দৃষ্টি পশ্চিমবঙ্গ। শত্রুর বহুমুখী আক্রমণের মোকাবিলায় অভিজ্ঞ এক রণদক্ষ পথিকৃৎ। তার পরিধি রাজ্যগত কিন্তু প্রাসঙ্গিকতা সর্বভারতীয়। তাই জনগণের যারা শত্রু, তারা এখানে সবচেয়ে বেশি আক্রমণমুখী। সমাজের যত বিকৃত আর বৈনাশিক শক্তি সব এখানে জোটবদ্ধ হয়েছে বাংলা আর বাঙালির বিরুদ্ধে। উদ্দেশ্য— সংগ্রামী জনগণের সংহত প্রতিরোধকে চূর্ণ করা। বাঙালির থেকে ভোট নিয়ে বাঙালিকে ধ্বংস করা।
নৃশংসতায় যারা বাংলার অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি থেকে মুছে দিতে চায় জনগণের প্রাসঙ্গিকতা, তারাও যোগ দিয়েছে এদের সঙ্গে। আর আছে সেই বাহিনী দুর্বুদ্ধির বশে, যারা জীবনের হালখাতা ভরিয়ে ফেলেছে আত্মবিক্রয়ের সুদ কষায়। সমাজের সমস্ত কদর্যতার প্রতিমূর্তি হিসা‍‌বে এক নগ্ন পৈশাচিকতায় ওরা (দলবদলুরা) সারি দিয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সামনে,  কোনও ছদ্মবেশ বা অন্তরালও ওরা অবশিষ্ট রাখেনি। কী চান ওরা?  ওরা সরকারের গাছ থেকে ফল খেয়েছেন অনেকেই। এখন বোধ হয় গাছতলা থেকে কুড়ানোর প্রত্যাশা! অন্ধকারের জীবদের জন্য জাগরণী গাইছেন নবযুগের লুসিকার!
ওদের রাজনীতি,  সর্বভারতীয়-আন্তর্জাতিক-মহাজাগতিক হয়ে উঠতে গেলে ‘বঙ্গালি’কে হতেই হবে আত্মবিস্মৃত। হিন্দি দেশভাষা না-হলেও তা রাষ্ট্রনেতার ভাষা। অতএব রাজাই সর্বত্র পূজ্যতে। মাছের চোখ তাই,  বাঙালিত্ব বিস্মরণ। ওদের অবাঙালি নেতারা কটুক্তিকে মনে করেন বাক্‌চাতুর্য,  মিথ্যাচারকে মনে করেন চতুরতা। অতিভীষণকে মনে করেন কবিত্ব, দ্বিচারিতাকে মনে করেন উদারতা,  কুৎসিত তর্জনীতাড়না 
এবং অশ্রাব্য তর্জনকে মনে করেন বীরত্ব।
ওরা চায়, সংলাপে হিন্দি শব্দ ছড়াতে হবে হরির লুটের মতো। চাই বিজ্ঞাপনী-বার্তায় ইংরেজি-হিন্দি শব্দের মারকাটারি। যে বাঙালি গোটা বাক্য অবিমিশ্র বাংলায় বলতে পারে,  তাকে শত্রু চিহ্নিত করতে হবে। ইষ্ট দেবদেবীও বদলাতে হবে। হিন্দি-বলয় থেকে দেবদেবী খুঁজতে হবে। যাতে দুর্গাপুজোর চেয়ে ঢের বেশি গণজোয়ার নামে গণেশচতুর্থীর জনসমুদ্রে। সবই বাংলায় মোদীয় বেদিনির্মাণের প্রস্তুতিপর্ব। রামমন্দির নিমিত্তমাত্র! বাঙালিকে হিন্দি-হিন্দু করে তুলতে গেলে পদ্মকে জসিমউদ্দিনের আঁচল থেকে ছিনিয়ে নিতে হবে। বাউলের গেরুয়া খুলে গৈরিক  ‘পতাকা’  ওড়াতে হবে। যেখানে  ‘কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’  গাওয়ার সাহস পাবেন না রবিবাউলও। ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থায় মনোনিবেশ করতে হবে।  ‘ধামাকা মচা’তেই হবে।
দেশভাগের পর গড়ে ওঠা কলোনিগুলিতে দেশের মতো পরিবেশ গড়ে থাকতে চেয়েছিলেন পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা ছিন্নমূল মানুষগুলি। রেশনের চাল,  জীবিকা-ঘটিত অনিশ্চয়তার পাশাপাশি ছিল আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। সেই দিনগুলিতে উদ্বাস্তু কলোনিতে ‘দেশের ভাষা’  ছিল স্মৃতির সবথেকে বড় অবলম্বন। চলবে না, চলবে না। নাগরিকত্ব আইনের আতঙ্কে বাঙালিকে ভুলিয়ে দিতে হবে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বাঙাল ভাষা:  ‘মাসিমা মালপো খামু...।’
আবার রবীন্দ্রনাথ। আমরা যেন স্মরণে রাখি আন্তর্জাতিক এই কবির প্রাজ্ঞ-সঞ্জাত ওই কথাগুলি:  ‘নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস/ শান্তির ললিতবাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’
নববর্ষে মন জানতে চায়—  কাণ্ডারি হুঁশিয়ার তো?  আমরা জেগে আছি তো?  প্রতিটি দিনই নবজন্মের,  প্রতিটি দিনই প্রাপ্তির ও অপ্রাপ্তির,  প্রতিটি দিনই পায়ে পায়ে পথ চলা। এসো হে বৈশাখ,  এসো,  সুসংবাদ এসো। বঙ্গ সমাজের সর্বাঙ্গ নিষ্কাষিত করে উপরে ভেসে উঠছে যত ক্লেদ,  গ্লানি আর কলুষের গাদ— এখন শুধু ছেঁকে নিয়ে নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলার অপেক্ষা। এ এক কলুষমুক্ত মাতৃভূমি রচনার পাক প্রক্রিয়া— আছে স্বপ্ন আর সম্ভাবনা নিয়ে উৎকণ্ঠ প্রতীক্ষার সতর্কতা। যুগান্তের গর্ভে এখন নতুন যুগের জন্ম যন্ত্রণা।

15th     April,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ