বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর

কুয়াশা ঘেরা তুরুক
অজন্তা সিনহা

যাত্রা শুরু 

শিলিগুড়ি শহর ছাড়িয়ে সুকনা জঙ্গলে ঢুকতেই আকাশের মুখ ভার। সকালে কিন্তু দিব্যি পরিষ্কার ছিল ! যাই হোক, সুকনা পেরিয়ে চড়াই-মুখী হল আমাদের গাড়ি। সফরসঙ্গী কলকাতার প্রাক্তন ফুটবল তারকা ও উত্তরবঙ্গের পর্যটন ব্যবসায়ী দম্পতি। বেশ কয়েকটি হেয়ারপিন বেন্ড পার হয়ে পৌঁছলাম রোহিণী। ব্রেকফাস্ট পথের পাশের এক নেপালি রেস্তরাঁয়। প্রায় তেল/ঘি-বিহীন পরোটা আর ঘুগনি, সঙ্গে চা। তারপর আবার যাত্রা! ততক্ষণে কুয়াশা পুরো ঢেকে দিয়েছে চরাচর। 

কুয়াশা মাখা পথ
কিছুদূর যাওয়ার পর কার্শিয়াং শহর পেরিয়ে গাড়ি ডানদিকের কোনাকুনি একটি পথ ধরল। খুব সাবধানে গাড়ি চলছিল। কুয়াশায় এক হাত দূরে কী আছে দেখা যায় না। দিনের বেলা হেডলাইট জ্বালিয়ে, ক্রমাগত হর্ন দিতে দিতে এগয় গাড়ি। গা ছমছমে পরিবেশ। এই অঞ্চলের পাইনের সৌন্দর্য সর্বজনবিদিত। সেই পাইনের বনেই না জানি কত রহস্য দানা বেঁধেছে। পাহাড় পাগলদের তো পাহাড়ের সবই ভালো লাগে! এই ভালো লাগা মন নিয়েই পৌঁছলাম তুরুকের একটি হোম স্টে-র দরজায়। ঘরগুলি সুন্দর সাজানো। বিশেষত কাঠের কটেজ দু’টি তো অপূর্ব! ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই ক্যানভাসে সারি সারি পাহাড়, ছোট ছোট বাড়িঘর আর জঙ্গল।  

চিকেনের আমিরি খানা 
আবহাওয়া তখনও কুয়াশাচ্ছন্ন। ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চের জন্য নেমে এলাম এক ধাপ নীচে। খিদে পেয়েছে জব্বর। হোম স্টে-র কিচেনেই খাবার ব্যবস্থা। ভাত, ডাল, আলু ভাজা, পাঁপড়, চাটনি, আচার আর চিকেনের দুরন্ত এক প্রিপারেশন। পাক্কা নেপালি রেসিপিতে তৈরি এই পদটি প্রস্তুত হয়েছে যাঁর খুন্তি-কড়াইয়ের শিল্পে, তিনি হলেন হোম স্টে মালিকের বড় ছেলে আমির। কাছেই একটা মেলা হচ্ছে, সেখানে স্টল দিয়েছেন আমিরের মা। ছোট ভাই অভিষেককে নিয়ে আপ্যায়ন করলেন আমাদের। 

কমলা বাগান ও পর্যটন
আমিরের মায়ের একটা দোকান আছে হোম স্টে-র পাশেই । পাহাড়ি গ্রামের দোকানগুলো যেমন হয় ! চাল-ডাল, তেল-নুন, লজেন্স-বিস্কুট থেকে ঝাড়ু-বালতি-জুতো, এমনকী পাওয়া যায় কিছু ওষুধপত্রও। গ্রামে বাস করেন ৬০/৬৫ ঘর মানুষ। কমলালেবু চাষ এখানকার মুখ্য জীবিকা, যা পর্যটকদের কাছেও প্রবল আকর্ষণীয়। তুরুক থেকে কিছুটা দূরেই বেশ কয়েকটি কমলা বাগান। সেখানে দেখা শুধু নয়, গাছপাকা কমলালেবু চেখে নেওয়ার সুযোগও পান পর্যটকরা। ভারী মিষ্টি তার স্বাদ। 

অন্যান্য চাষ ও ভিন্ন পেশা
ভুট্টা,আদা ও এলাচ চাষের সঙ্গে নানা ধরনের সব্জি। খেতের টাটকা গাজর, বিন, সিম, সব ধরনের কপি, রাইশাক, স্কোয়াশ, পালং, আলু, শসা, করলা, কুমড়ো, মটরশুঁটি পাবেন খাবার টেবিলে। কৃষিকাজে এখানকার মানুষ রাসায়নিক সার প্রয়োগ করেন না। ফলে, শাকসব্জি অতীব সুস্বাদু । প্রায় সবার বাড়িতেই আছে গোরু, ছাগল, মুরগি। দুধ বা ডিম, মুরগির মাংসও বিক্রি করেন কেউ কেউ। আগ্রহ বাড়ছে পর্যটন ব্যবসায়, পুরো অঞ্চল জুড়ে এখন বেশ কয়েকটি হোম স্টে। ছুতোরের কাজও করেন কেউ কেউ। আছেন ড্রাইভিং পেশার মানুষ। তরুণরা বেশ পছন্দ করেন সেনাবাহিনীর কাজ। নার্স, বিউটি পার্লার, হোটেলের কাজ নিয়ে বাইরে চলে যাওয়া ইদানীং পাহাড়ে যথেষ্ট বেড়েছে। তুরুকেও তার নিদর্শন চোখে পড়ে।  

ভৌগোলিক অবস্থান
ইয়াং নদীর বিস্তৃত উপত্যকা ঘিরে গড়ে উঠেছে সিটং। সিটং আদতে খাসমহল, অনেকগুলি ছোট ছোট গ্রামের সমষ্টি। তারই একটি মিডল তুরুক। অবস্থান সিটং ২-এ । উচ্চতা মোটামুটি ৪ হাজার ফুট। সকলেই প্রায় নেপালি ভাষাভাষী। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। মিলেমিশে পালন করেন দুর্গাপুজো, দশেরা, দেওয়ালি, বড়দিন, লোসার বা বুদ্ধ পূর্ণিমা। কাছেই রয়েছে একটা ঝর্ণা আর কিছু দূরে খানিকটা উঁচুতে এক গুম্ফা। ট্রেক করে উঠতে হয়। ঝর্ণা আপাতত দৃশ্যমান নয়। শুনলাম, বর্ষায় একেবারে আপন বেগে চলমান তিনি। গুম্ফাটি খুব পুরনো না হলেও দেখে প্রাচীনতার অনুভূতি মেলে।

মেলায় মেলামেলি 
লাঞ্চের পরও আকাশের মুড ভালো হল না। ঠান্ডা বেড়েছে। তার মধ্যেই পায়ে হেঁটে ঘোরাঘুরি। মাঘ মাসের আগমন, তাই মাঘী মেলা বসেছে কাছের এক খোলা প্রান্তরে। বুড়ির মাথার পাকা চুল (ক্যান্ডি), ফুচকা, ঘুগনির পাশাপাশি রয়েছে হস্তশিল্প, ঘরসংসারের সরঞ্জাম, কিছু শীতের ফ্যাশনেবল জামাকাপড়। সাজগোজের সরঞ্জামও চোখে পড়ল। মাইকে বাজছে নেপালি গান। নাগরদোলাও আছে। জমজমাট এই মেলা ছেড়ে ঘরে আসা দায়। কিন্তু ঠান্ডার চোটে ফিরতেই হল। ফেরার পথে মুগ্ধ করা পাইনের সৌন্দর্য। এছাড়াও আছে  নানা জাতের গাছ। কোথাও কোথাও জঙ্গল বেশ ঘন। শুনলাম গ্রামে লেপার্ড হানা দেয় সুযোগ পেলেই। পোষা কুকুর, ছাগল ধরে নিয়ে যায়। ইতস্তত চোখে পড়ে খরগোশ, হরিণ ও ভালুক। অঞ্চলটি পক্ষীপ্রেমীদের স্বর্গ! ফুলের মরশুমে রঙের ছড়াছড়ি, প্রজাপতিদের ব্যস্ত উড়ান তখন। ডিনারে রুটি আর চিকেনের একটা হালকা পদ। দ্রুত ঘুম নামে চোখে।  

আশপাশে দ্রষ্টব্য
দু’টি দিন অনায়াসে কাটানো যায় তুরুকে। একটি দিন থাকুক সাইট সিয়িংয়ের জন্য। যেতে পারেন রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত মংপু । মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা হবে অহলদারা ভিউ পয়েন্ট থেকে একই সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও তিস্তা দর্শন। এছাড়াও বেশ ভালো মহানন্দা ফরেস্ট রেঞ্জের উচ্চতম অঞ্চল লাটপাঞ্চার, নামথিং লেক (ভাগ্যে থাকলে দর্শন হয়ে যেতে পারে বিরল প্রজাতির সালামান্দার), ইয়াং নদী এবং কমলা বাগান। 

জরুরি তথ্য
এনজেপি/শিলিগুড়ি/বাগডোগড়া থেকে রিজার্ভ গাড়ির ভাড়া ৩ হাজার টাকা। এছাড়া সার্ভিস বা শেয়ার গাড়িতে এনজেপি/শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়াং, ভাড়া মাথাপিছু ১০০-১৫০ টাকা। ছাড়ে শিলিগুড়ি জংশন/তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ড থেকে সকাল ৮টায়। কার্শিয়াং থেকে মিডল তুরুক যাওয়ার গাড়ি দুপুর ১টা থেকে ২-৩০ মিনিট পর্যন্ত পাওয়া যায়, ভাড়া মাথাপিছু ১০০ টাকা। ফেরার জন্য— মিডল তুরুক থেকে কার্শিয়াং সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে সব গাড়ি ছেড়ে দেয়। থাকা-খাওয়ার খরচ মাথাপিছু প্রত্যহ ১২০০ টাকা। দুপুর ও রাতের খাবারের জন্য পাবেন ভাত, রুটি, ডাল, ভাজি, সব্জি, চিকেন, ডিম। পুরি/রুটি-সব্জি, টোস্ট-অমলেট, ওয়াইওয়াই, চাউমিন, মোমো, পকোড়া ব্রেকফাস্ট ও স্ন্যাক্সের জন্য মেলে। গিজার, রুম হিটার ও ওয়াই-ফাইয়ের ব্যবস্থা আছে। সাইট সিয়িংয়ের বন্দোবস্ত আছে। বর্ষা বাদ দিয়ে বছরের যে কোনও সময় যেতে পারেন।
ছবি: লেখক

14th     February,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ