বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর

মেজাজটাই আসল রাজা... 

 করোনা আবহে এখন সকলের মনেই আতঙ্ক। মারণ ভাইরাস ঘরবন্দি করে ফেলেছে গোটা বিশ্বকে। প্রায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে সমস্ত শিল্প। ট্রেন বা বিমান পরিষেবা কবে আবার স্বাভাবিক হবে তার নিশ্চয়তা নেই। তবু হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকলে তো চলবে না। মাস্ক-স্যানিটাইজার সহযোগে এই ‘নিউ নর্মাল’ দুনিয়ায় একটু প্রকৃতির শ্বাস নেওয়ার জন্য কি কাছে-পিঠে বেরিয়ে পড়া যায় না? বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ঐতিহ্যশালী রাজবাড়ির আতিথেয়তায় কয়েকটা দিন কাটিয়ে এলে মন্দ কী? কোথায়, কেমন সেসব রাজবাড়ির অন্দরমহল? রাজঅতিথি হতে পকেটে রেস্তই বা কতটা প্রয়োজন? করোনা পরিস্থিতিতে জায়গাগুলো কতটা নিরাপদ? সবদিক খোঁজখবর নিয়ে লিখেছেন বাপ্পাদিত্য রায়চৌধুরী।

ইতিহাসের গন্ধ মাখা রাজপ্রাসাদগুলিকে অতিথিশালায় রূপান্তরিত করে তাক  লাগিয়ে দিয়েছে রাজস্থান। গুজরাত বা মধ্যপ্রদেশও অনেকটাই সফল এই প্রচেষ্টায়। পর্যটনপ্রেমী বাঙালি সেসব জায়গায় অবসর কাটিয়ে নির্ভেজাল আনন্দ পান। অথচ এই বাংলার সীমানার মধ্যেই এমন বেশ কিছু রাজবাড়ি, জমিদারবাড়ি বা ঐতিহ্যশালী ভবন আছে, যেগুলিকে অতিথিদের বসবাসের জন্য সাজিয়ে তোলা হয়েছে। সেখানে অফুরন্ত আরাম। আশ্চর্য দেখনদারি। আর তাক লাগানো লাক্সারি। করোনা সংক্রমণের মধ্যেও কেউ কেউ দরজা খুলে রেখেছে অতিথিদের জন্য। মেনে চলছে সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা। কেউ বা অপেক্ষায় আছে, করোনার গ্রাস পেরিয়ে মুক্ত হবে বাংলা।
যেমন দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাওয়ালি রাজবাড়ি। কলকাতা থেকে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায় ‘দ্য রাজবাড়ি বাওয়ালি’তে। ৩০০ বছরের পুরনো বাড়ির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে পুকুর, আশ্রম সহ বিশাল প্রান্তর। ক্লাসিক হেরিটেজ, ডাকবাংলো, জমিদারি স্যুইট, রয়্যাল স্যুইট, নতুন বাড়ি প্রভৃতি নামে থাকার ব্যবস্থা রাজকীয়। অথচ সর্বত্র পাঁচতারা আধুনিকতার ছোঁয়া। জিভে জল আনা হরেক খাবারের পাশাপাশি এখানে পাওয়া যায় পোস্ত বা সরষে বাটা দেওয়া বাঙালির চিরন্তনী পদও। করোনা সংক্রমণকালেও দরজা খোলা বাওয়ালির অতিথিশালার। এখানকার কর্ণধার অজয় রাওলার কথায়, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সব রকমের নির্দেশিকা মেনে আমরা অতিথিদের রাখছি। কোনও জায়গাই সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশনড নয়। এমনভাবে থাকার জায়গাগুলি ছড়ানো, যাতে সামাজিক দূরত্ব মানা যায় সর্বত্র। এমনকী, রেস্তরাঁতেও সব অতিথিদের একসঙ্গে বসে খাবার খাওয়ার সুযোগ দিচ্ছি না আমরা।’ অতিথিরা চলে গেলে, গোটা একটা দিন খালি রাখা হচ্ছে ঘর স্যানিটাইজ করার জন্য। প্রতিটি কর্মীকে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হচ্ছে। এই রাজবাড়িতে জলখাবার নিয়ে ঘরভাড়া শুরু দৈনিক ৫ হাজার ৫০০ টাকা থেকে। কর অতিরিক্ত। তবে অজয়বাবু বলছেন, ‘যাঁরা একটু নিরিবিলিতে দিন দশেক বা সাতেকের জন্য ওয়ার্ক ফ্রম হোম করতে চান, তাঁদের জন্য আদর্শ জায়গা এই রাজবাড়ি। আমরা তার জন্য স্পেশাল প্যাকেজ করে দিতেও প্রস্তুত।’
কথা হচ্ছিল বালাখানা এস্টেটের কর্ণধার রণধীর পালচৌধুরীর সঙ্গে। নদীয়ার মহেশগঞ্জের যে পৈত্রিক বাড়িটিকে তাঁরা হেরিটেজ হোম স্টে করেছেন, সেটি আসলে ছিল এক নীলকর সাহেবের বাড়ি, যিনি জন্মসূত্রে ছিলেন একজন ইতালিয়ান। ১৮৮০ সালে রণধীরবাবুর ঠাকুরদা এই বাড়িটি কিনে নেন। এখন আধুনিক সাজে সাজানো হলেও, বাড়িটির মূল কাঠামোয় কোনও রদবদল হয়নি। এস্টেটের বিঘের পর বিঘে জমিতে খাঁটি গ্রামবাংলার গন্ধ। এখানে যাঁরা আসেন, তাঁরা অন্তত আরও একবার আসার ইচ্ছা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। বিদেশিরাও এখানে এলে বাংলার আসল রূপ চিনতে পারেন। নদীয়ায় এখন বিক্ষিপ্তভাবে লকডাউনের সমস্যা চলছে। তবু অনেকেই এর মধ্যেও আসার জন্য খোঁজখবর করছেন, জানালেন রণধীরবাবু। এখানে থাকার খরচ শুরু দিন পিছু পাঁচ হাজার টাকা থেকে। লাঞ্চ বা ডিনারের খরচ শুরু ৪০০ টাকা থেকে। কিন্তু সে স্বাদের মাহাত্ম্য আলাদা। গরমকালে বন্ধ থাকে এস্টেট। জুলাই থেকে খোলে। দোল পর্যন্ত অতিথিরা আসা যাওয়া করেন।
মেমারির কাছে আমাদপুরে রয়েছে আরও একটি হেরিটেজ হোম স্টে। যদিও করোনার কারণে আমাদপুর হেরিটেজ হোম স্টে’তে এখন অতিথিদের আসা যাওয়া বন্ধ, তবে খুব তাড়াতাড়ি আবারও খুলে দেওয়া হবে দরজা, জানালেন এখানকার কর্ণধার শিলাদিত্য চৌধুরী। তিনি জানিয়েছেন, ১৫ আগস্ট বা ১ সেপ্টেম্বর থেকে তাঁরা অতিথিদের বুকিং নেওয়া শুরু করলেও, ৪০ শতাংশ ঘর খালি রাখবেন। করোনা সংক্রমণ রুখতে আর যা যা করতে হয়, সেগুলির পাশাপাশি কঠোরভাবে এই নীতি মানবেন তাঁরা। এমনকী, খাওয়াদাওয়ার সময়ও যাতে একাধিক পরিবার একসঙ্গে বসে না খেতে পারে, তার জন্য বদলে দেওয়া হবে সময়ও। কিন্তু এই বিপর্যয়ের সময়টুকু কাটিয়ে উঠলে, সারা বছরই এখানে প্রকৃতির নানা স্বাদ পান অতিথিরা। বাঘ বাড়ি, মুখার্জি বাড়ি, দুর্গাবাড়ি, সাধু বাড়ি আশ্রম, রাধামাধবের মন্দির, আনন্দময়ী কালীবাড়ি, বড় কালী, খ্যাপাকালী, মেজো কালী, টেরাকোটার শিবমন্দির— সব মিলিয়ে চিরন্তনী বাংলার আশ্চর্য স্বাদ এখানে। সঙ্গে আটপৌরে আতিথেয়তা তো রইলই।
একসময় যে বাড়িতে এসে দিনের পর দিন কাটিয়ে সাহিত্যের রসদ সংগ্রহ করতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সেই ইটাচুনা রাজবাড়িতে এই করোনা সংক্রমণেও অতিথি আনাগোনা অব্যাহত। এখানকার অন্যতম কর্তা ধ্রুব কুণ্ডুর কথায়, ‘হুগলির এই রাজবাড়ির আশপাশে তো কোনও সমুদ্র বা পাহাড় নেই। তবুও এখানে কখনও গেস্ট আসায় ছেদ পড়ে না। আমরাই ভাবতাম, কী এমন রহস্য আছে এখানে? দেখা গিয়েছে, এখানকার অতিথিরা তিনটি বিষয়ে অত্যন্ত সন্তুষ্ট। প্রথমত, এখানকার খাঁটি বাঙালি খাবার। দ্বিতীয়ত, এখানকার কর্মীদের আতিথেয়তা। তৃতীয়ত, গোটা রাজবাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্ন। করোনা সংক্রমণের গোড়ার দিকে আমরা সরকারি নিয়ম মেনেই অতিথিদের আসার অনুমতি দিইনি। কিন্তু সরকার সেই সুযোগ ফের করে দেওয়ায়, আবারও বিপুল সাড়া পেতে শুরু করেছি। তবে সাবধানতার খাতিরেই কিন্তু কম বুকিং নিচ্ছি।’ ইটাচুনা রাজবাড়িতে ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে থাকা যায়। খাওয়ার খরচ তিন বেলা মিলিয়ে হাজার খানেক টাকা। কিন্তু সেখানে অফুরান আয়োজন।
বাংলার রাজবাড়িগুলির মধ্যে ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি অন্যতম। এই বিরাট এস্টেটের একটি অংশ রাজ্য সরকারকে দেওয়া হয়েছে পর্যটন শিল্পের জন্য। মূল রাজবাড়ি এখনও রাজাদের হাতে। সেখানে হেরিটেজ ট্যুরের জন্য খোলা থাকে দরজা। রাজবাড়ির অন্যতম কর্তা বিক্রমাদিত্য মল্লদেবের কথায়, ‘এই করোনা সঙ্কটের মধ্যেও যেমন প্রচুর মানুষ খোঁজ করছেন আসার জন্য, তেমন আসছেনও। জঙ্গল, পাহাড়, নদীর এমন সহাবস্থান আর কোথায়?’ শুধু যে ঝাড়গ্রামের রাজবাড়ির আতিথেয়তার জন্যই এখানে অতিথিরা আসেন, তা নয়। এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক রাজবাড়ি আছে, যেগুলি দর্শনীয়। সব মিলিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা এমন রাজকীয় আয়োজন দুর্লভই বলা চলে। থাকার খরচও নাকি খুব বেশি নয়।
মুর্শিদাবাদের বারিকোঠি প্রাসাদে আছে হেরিটেজ স্যুইট, র‌য়্যাল হেরিটেজ স্যুইট ও মহারাজা হেরিটেজ স্যুইট। কিন্তু এই প্রাসাদের আতিথেয়তায় সেটাই বড় কথা নয়। দেড়শো বছরের পুরনো খাট, আড়াইশো বছরের পুরনো আসবাব হোক বা সুদূর বিস্তৃত আমবাগান— ইতিহাস এখানে এখনও সর্বত্র বিরাজমান। মুর্শিদাবাদের কাশেমবাজার রাজবাড়িতে ভোলা ময়রা ও অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির যে আসর বসত, সেই ইতিহাস যেন এখনও কথা বলে এখানকার অন্দরমহলে। এই রাজবাড়িও এখন পর্যটকদের প্রিয় ঠিকানা।
নবাব আলিবর্দি খাঁ একসময় ডেনিশদের (ডেনমার্কের অধিবাসী) বাংলায় বসবাস ও ব্যবসা করার সুযোগ দিয়েছিলেন। সেই সময় শ্রীরামপুরে গড়ে ওঠে ডেনিশদের ভিটে। এমনই এক ঐতিহ্যবাহী বাড়িকে সংস্কার করে গড়ে উঠেছে ডেনমার্ক টাভার্ন। শুধু যে নতুন প্রজন্মই এখানকার আতিথেয়তায় মজেছে, তা নয়। স্থানীয় বাসিন্দারা আপন করে নিয়েছেন ইতিহাসের গন্ধ মাখা এই বাড়িটিকে।
হেরিটেজ প্রপার্টিগুলিকে পর্যটনের মানচিত্রে তুলে ধরতে বদ্ধপরিকর ভারতীয় পর্যটন মন্ত্রক। ইন্ডিয়া ট্যুরিজমের রিজিওনাল ডিরেক্টর (ইস্ট) সাগ্নিক চৌধুরীর কথায়, ‘আমরা চাই, বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাড়ি, যেগুলি এখন পর্যটকদের থাকার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে, সেগুলি দেশের মানুষের কাছেও সমাদর পাক। কারণ বাংলার আতিথেয়তা বিশ্ববন্দিত। তার পাশাপাশি ইতিহাসকে আঁকড়ে দিনযাপন করার অনুভূতিই আলাদা। সেই সুযোগকে আরও প্রসারিত করতে বদ্ধপরিকর পর্যটন মন্ত্রকও।’

9th     August,   2020
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ