আজ সত্যজিৎ রায়ের চরিত্রে পর্দায় আবির্ভাব তাঁর। মুক্তির আগে কতটা আত্মবিশ্বাসী জিতু কমল। শুনলেন সন্দীপ রায়চৌধুরী।
ছবিটা কেমন চলবে বা দর্শক কীভাবে আপনাকে নেবেন সেটা ভেবে নিশ্চয়ই টেনশন হচ্ছে ?
ছবিটা দর্শক দেখবেন কী দেখবেন না, বা আমাকে ভালো লাগল কি না, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নই। তবে, ছবিটা করে আনন্দ পেয়েছি।
‘অপরাজিত’ দেখে শ্যাম বেনেগাল প্রশংসা করলেন।
শ্যাম বেনেগালের প্রশংসা বিরাট পাওনা। বুঝলাম, খুব খারাপ করিনি। তবে এটাও ঠিক ভালো লেগেছে বলেই যে পরিচালকরা আমাকে ডেকে ডেকে কাজ দেবেন, এমনও নয়।
রাজনীতি করতে করতে আপনার অভিনয়ে আসা। স্বপ্নেও ভেবেছিলেন এরকম এক কিংবদন্তির চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পাবেন?
দমের সমস্যা হচ্ছে প্রশ্নটা শুনে। ‘পথের পাঁচালি’, ‘অপরাজিত’, আন্তর্জাতিক পুরস্কার, ফেলুদা আর একটা রাগী লোক। সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে এর বেশি জানতাম না। প্রথম শিডিউলে তৈরি হওয়ার জন্য সময় পেয়েছিলাম ৪ দিন, দ্বিতীয় শিলিউলে ১ মাস। শুরুতে মনে হয়েছিল, আমি ‘লাইফ অব পাই’ ছবির মতো একা একটা সমুদ্রে। আর শ্যুটিং শেষ করে বুঝেছি, উনি আরও বড় সমুদ্র যার শুরু আছে শেষ নেই। ওঁর সম্পর্কে সামান্য কিছু জানতেই আমার পুরো জীবন লেগে যাবে। তাই না জেনে গিয়েছি বলে শাপে বর হয়েছে।
এই চরিত্রে সুযোগ পাওয়া নিয়েও তো অনেক নাটক।
অনীকদা আমাকে চিনতেন। ফোনে একটা চিত্রনাট্য পাঠিয়ে ভিডিও রেকর্ড করে পাঠাতে বলেন। দেখে বুঝিনি, এটা সত্যজিৎ রায়ের চরিত্র। অনীকদা যেটা চাইছিলেন, সেটা কিন্তু পেয়ে যান। আবিরদাকে (চট্টোপাধ্যায়) নিয়ে তার আগেই পোস্টার তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমি খবর রাখিনি। দিন ১৫ পরে আবার ফোন। বললেন, শোনো এটা সত্যজিৎ রায়ের চরিত্র। আবিরই করছে। কিছুদিন পর আমার পাঞ্জাবি পরা ছবি চাইলেন। তারপর বললেন, সত্যজিৎ রায়ের অল্পবয়সের কিছু দৃশ্য আছে, কোনও সংলাপ নেই। তুমি করবে? একদিন সময় চাইলাম। আমার স্ত্রী নবনীতা অভিনেত্রী। ওঁর সঙ্গে, আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। অনীকদাকে বললাম, করব কিন্তু পারিশ্রমিক লাগবে না। আমি শুধু এর অংশ হতে চাই।
তারপর...
আবার সব চুপচাপ। মাস দেড়েক পর আবার ফোন। লুক সেটের ডেট দিলেন। সেদিন প্যাকড শিডিউল আমার। সোমনাথ কুণ্ডু ২০ মিনিটে মেক আপ করলেন। একটা জামা পরে শ্যুটিং জোনে ঢুকে দেখি, সকলে চুপ। এত তাড়া ছিল, ছবিগুলো আর চেক করিনি। রাতে শ্যুটিং সেরে বাড়ি ফিরে টিভি দেখছি। হঠাৎ অনীকদা হোয়াটসঅ্যাপে কিছু ছবি পাঠিয়ে বলল, ছবিগুলো দেখো। মানিকবাবুর বিভিন্ন পোজে ছবি। মেসেজ করলাম, আমার ছবিগুলো পাঠাও। অনীকদা বলল, ‘রাস্কেল ইটস ইউ।’ তখন ভালো করে দেখলাম। নবনীতাকে ডাকলাম। কে চিনতে পেরেছ? ও বলল, হ্যাঁ, কেন পারব না? সত্যজিৎ রায়ের দুর্লভ ছবি। বললাম, আরে এটা আমি। তারপর সারা রাত শুধু জুম করে ছবিগুলো দেখেছি। ততদিনে হাসানদাকে (প্রযোজক) বলতে শুরু করেছে অনীকদা, জিতুকেই চাই আমার। তারপরও শুনলাম আমি করছি না। পুজোর চারদিন আগে আবার ফোন। ‘চলে এসো। ওয়ার্কশপ করব। একাদশী থেকে শ্যুটিং শুরু।’ বিশ্বাস হয়নি। ছবিটা করেছি, এখনও বিশ্বাস হয় না!
অনেকে বলছেন সত্যজিতের চরিত্র করে আপনি অহঙ্কারী হয়ে উঠেছেন।
যেদিন সত্যজিৎ রায়ের চরিত্রে আমার লুক প্রকাশ্যে এল, সেদিন সকাল থেকে ফোন বন্ধ রেখেছিলাম। ইন্ডাস্ট্রির অনেক বন্ধুবান্ধব বলেছিল, এটাকে তুই ক্যাশ করলি না। তাঁদের বলি, আমার ক্যাশ দরকার নেই। অ্যাসেট দরকার। মেগাসিরিয়াল করছি না বলে অনেকে এসব বলছে। বাজে কথা। মাধ্যম আলাদা হতে পারে, কিন্তু সব কাজই এক। অর্ণব মিদ্যার ‘সেদিন কুয়াশা ছিল’ বলে একটা অন্যরকম ছবি করলাম। ফেলুদার অ্যান্টাগনিস্ট হওয়ার জন্য সৃজিতদা ফোন করেছিলেন। আমি ওঁকে বলি, এই ছবি রিলিজের আগে আমার এই চরিত্র করা উচিত? অ্যাপ্রিশিয়েট করে বলেছিলেন, কেউ সৃজিত মুখার্জির মুখের উপর এটা বলবে না।
দাঁতের পাটি বদল নিয়ে তো সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল। সিগারেটও নাকি প্রচুর খেয়েছেন?
এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা হোক, চাই না। স্ট্যাকেডো টোনে কথা বলতেন লোকটা। এটা রপ্ত করতেই দিনরাত একাকার হয়ে গিয়েছে। ঠোঁট না খুলে বাংলা বলতে পাগল পাগল লাগত। একটা দেড় মিনিটের দৃশ্যে আমাকে ২৬টা সিগারেট খেতে হয়েছে। আমি হাঁপানি রোগী। কী অবস্থা হতো সেটা অনীকদা আর ওঁর স্ত্রী দেখেছেন। কষ্ট হয়েছে ঠিকই। তবে, এটা সুইট পেইন।
আবিরের সঙ্গে কথা হয়েছে?
না। তবে আমাদের ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম সেরা অভিনেতা আবিরদা। ও করলেও একইরকম বা হয়তো বেটার করত। কারণ ছবির অভিজ্ঞতা ওর অনেক বেশি। আমার ওপর প্রেশার বেড়ে গেল যখন অনীকদা বা প্রযোজক বলছিলেন, তুমি আমাদের ডার্ক হর্স। আবিরকে সরিয়ে তোমাকে নিচ্ছি। এরপর একদিন ফাল্গুনীবাবুর (আবিরের বাবা) নাটক দেখতে গেলাম। তখন উনি বললেন, তুইও তো আমার ছেলেই। ভালো করে কাজ কর। বললাম, পাঁচ বছর আগে বিজয়া রায়ের লেখা ‘আমাদের কথা’ তুমিই আমাকে দিয়েছিলে।
এরপর কী পরিকল্পনা?
প্ল্যান করে তো বাড়ি-ঘর হয়, জীবন কি হয়! সকলেরই ভালো কাজ করার ইচ্ছে থাকে। ভোর পাঁচটায় উঠে মাঠে দৌড়ই, রেওয়াজ করি, অ্যাকসেন্ট ভালো করার চেষ্টা করি। নিজে তৈরি থাকি। সুযোগ আসার হলে, আসবেই।