মোবাইল ছাড়া নাকি বাঁচা যায় না। কাজের বস্তু বলে কথা! তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না কয়েকজনের। তাঁরা দিব্য দিনাতিপাত করেন মোবাইল ছাড়াই। টলিউডের বিশিষ্ট পরিচালক সন্দীপ রায়ের কথাই ধরা যাক। মোবাইল নেই তাঁর। যাবতীয় ফোনাফুনি ল্যান্ডলাইনেই সীমাবদ্ধ। এত বছর ছবি তৈরিতে কোনও অসুবিধা হয়নি তাতে। মোবাইল থেকে দূরে থাকেন এই মুহূর্তে টলিউডের অন্যতম ব্যস্ত অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ও। মুম্বইওয়ালাদের সঙ্গে একের পর এক কাজ করা কিন্তু তাতেও আটকায়নি। জীবনে কখনও মোবাইল ব্যবহার করেননি লেখিকা মহাশ্বেতাদেবী। প্রকাশকের তাগাদা থেকে বইপ্রকাশের ফোন, প্রয়াত লেখিকার সবই চলত ল্যান্ডলাইনে। খ্যাতি সরে যায়নি তাতেও।
এখনও খুব একটা মোবাইল ব্যবহার করেন না লেখক প্রফুল্ল রায়। নামেই একটি মোবাইল আছে। বেশিরভাগ সময়ই তা বন্ধ। যন্ত্রটি ব্যবহার করতেও বড় বিরক্ত হন! বেস্টসেলার হওয়া কিন্তু আটকায়নি তাতেও। অন্যদিকে মোবাইল ও তার নানা ছলকলা ব্যতিরেকে ইয়ং জেনারেশন যে চলতেই পারছে না। অনেকে বলেন, আজকের দিনে মুঠোফোন ছাড়া বাঁচা অসম্ভব। কিন্তু ব্যবহারে সংযম আনতেই হবে। স্বাস্থ্যকর বিতর্কে অংশ নিলেন গৃহবধূ থেকে সমাজের বিশিষ্টরা।
‘জীবন উপভোগ করতে চাইলে মোবাইল ফোনের ব্যবহার কমান। আমি নিজে সারা দিনে পাঁচ শতাংশেরও কম সময় মোবাইল ব্যবহার করি। মোবাইলের আকার আপনার পকেটে রাখার জন্য ছোট। কিন্তু সারাক্ষণ আপনার মুখ ও কানে রাখার জন্য কিন্তু বেশ বড়। কিন্তু লোকজন যা পকেটে রাখে কম, মুখে আর কানেই রাখে বেশি। ইদানীং দেখি, লোকজন হেডফোন কানে মোবাইল ব্যবহার করতে করতে রাস্তা পেরচ্ছে, কী বিপজ্জনক! কিছু মানুষ মারা না গেলে কারও বোধ আসবে না। নাতি নাতনিদের দেখি মোবাইল নিয়ে কত কী করে! হাজার হাজার অ্যাপ রয়েছে তাতে। আমি নিজে অত কিছু জানিই না। না জেনেও আমার জীবন দিব্য চলছে। এত বেশি মোবাইল ব্যবহার করলে জীবন কখন উপভোগ করবেন!’
— মার্টিন কুপার
মোবাইলের আবিষ্কর্তা
পছন্দ করি না মোবাইল
হৈমন্তী শুক্লা (সঙ্গীতশিল্পী)—স্মার্টফোন ছাড়া এখন তো সবকিছুই অচল। আমিও স্মার্টফোন ব্যবহার করি। যদিও বয়স হয়েছে, হয়তো সব জিনিসটা ভালো লাগে না, তবুও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। এই তাল মিলিয়ে চলতে গিয়েই তো যত বিপত্তি ঘটে। অতিরিক্ত মোবাইলের ব্যবহার তো শরীরের ভীষণই ক্ষতি করে। দুটো মানুষ পাশাপাশি বসে ফোন দেখতে ব্যস্ত থাকেন, কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলেন না। এটা কি ভালো লক্ষণ! এখন গান শোনা, সিনেমা দেখা সবই মোবাইলে হচ্ছে। টিভি দেখা কমে গিয়েছে। আমারও তাই। আমাদের অল্পবয়সে তো এসব কিছু ছিলই না। ল্যান্ডলাইনে ফোন আসাটাই তখন অনেক কিছু মনে হতো। এখন স্মার্ট ফোন ছাড়া অন্ধকার। যদিও আমি স্মার্টফোন পছন্দ করি না। কাজ চালানোর জন্য শিখতে হয়েছে। আগে রেকর্ড প্লেয়ার ছাড়া গান শোনা যেত না। এখন মোবাইলের কারণে গান শোনাটা অন্তত খুব সহজ হয়ে গিয়েছে।। এটাতো একটা দারুণ ব্যাপার। তাও বলবো মোবাইলের আসক্তি এখন এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে, যেটা কমানো খুবই মুশকিল। একটা ক্রেজ চলছে। আবার হয়তো একটা সময় আসবে যখন এই মোবাইল ক্রেজটা চলে যাবে। মানুষ আপনি থেকেই মোবাইল ব্যবহার কম করবেন অথবা বন্ধ করবেন। সেই দিনটার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন গতি নেই।
নেশার নাম মোবাইল
সন্দীপ্তা সেন (অভিনেত্রী এবং মনোবিদ): মোবাইলের ব্যবহার কমা ইদানীং দিনে দুই-তিন ঘন্টা মোবাইল থেকে দূরে থাকার যে ট্রেন্ড তৈরি হচ্ছে তা আশাব্যঞ্জক। ঘুমের সময়টুকু ছাড়াও দিনে একটা সময় অন্তত মোবাইল থেকে দূরে থাকা খুব জরুরি। আসলে মোবাইল দেখা এক ধরনের নেশা। আমার কাছে অনেকেই আসেন যাঁরা হয়তো ঘন্টার পর ঘন্টা নেশাগ্রস্তের মতো ফোন দেখেন। ক্ষতিকারক জেনেও অভ্যেসটা ছাড়তে পারেন না। আগে তো যোগাযোগের মাধ্যম বলতে চিঠি, ল্যান্ডলাইন এগুলোই ছিল। তা সত্ত্বেও মানুষের মধ্যে যোগাযোগও অনেক বেশি ছিল। মোবাইল বরং মানুষের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়েছে। কারণ ভিডিও কলিং বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এখন মানুষে-মানুষে ভার্চুয়াল যোগাযোগ হয়তো বেড়েছে কিন্তু আন্তরিকতা, ধৈর্য, অপেক্ষা এই জিনিসগুলো কমেছে। অস্থিরতা বেড়েছে। একটা টাচ স্ক্রিন কত দ্রুত কাজ করতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলছে। ধৈর্য কমার ফলে আমাদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের চারপাশে সম্পর্ক গুলো ক্রমেই ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে। কর্মজীবনে জটিলতা বাড়ছে। এরপরেও আমাদের জীবন কিন্তু এখন মোবাইল ছাড়া চলবে না। আসলে সব কিছুরই ভালো-খারাপ দুই আছে। এক্ষেত্রে খারাপের পাল্লাটা একটু বেশিই ভারী বলে আমার মনে হয়।
মোবাইল ছাড়া বাঁচব না!
পিয়ালি চক্রবর্তী (দাস)। ৩২। গৃহবধূ। কাঁকুড়গাছি: সারাদিন বাড়িতে থাকি। মেয়ে, বর বেরিয়ে গেলে আর কোনও কাজ নেই। গোটাদিন ভূতের মতো এই বাড়িটায় আটকা পড়ে। মোবাইল আমার এই জেল-যন্ত্রণায় একটু দখিনা বাতাস। মেয়ের তো রোজ বায়না, নতুন টিফিন চাই। কোথা থেকে পাব নতুন রেসিপি? তাই ভরসা ওই ফোন। নতুন নতুন রান্না শেখা যায়। ওর স্কুলের গ্রুপেও কতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাসেজ আসে। বরও কাজ থেকে ফিরে খেলা নয়তো খবর নিয়ে বসে থাকে। সিরিয়ালগুলি কি ভালো হয়! কিন্তু একটাও দেখার উপায় নেই। সেখানেও ত্রাতা মোবাইলই। বাবা দূরে থাকেন। তাঁকে ফোন করতেও তো মোবাইলই ভরসা। মাঝে মাঝে ভাবি যন্ত্রটা না থাকলে বাঁচতাম কীভাবে?
খুব দরকারি
সৈকত বৈদ্য। ২২। ছাত্র। জয়নগর: ফোন ভীষণ দরকারি। লকডাউনে যখন পড়াশোনা করতাম, তখন তো পুরোটাই মোবাইলের উপর ছিল। কত নতুন জিনিস জানা যায় ফোন থেকে। হাতের মুঠোয় গোটা বিশ্ব! রোজকার আপডেট পাই। খেলা দেখতে পারি। ছাত্র হিসেবে সব বই কেনার সামর্থ্য নেই। পিডিএফে পড়তে পারি। বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখার ভালো উপায় তো এখন মোবাইল।
এনার্জি পাই মোবাইল দেখে
অর্পিতা বিশ্বাস। ২৪। তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। গড়িয়া: উফ, কাজের যা চাপ! মোবাইল একটু স্বস্তি দেয়। কাজের ফাঁকে একটু সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ বুলিয়ে নিলে ফের এনার্জি পাই। আর তাছাড়া, ইমেল, হোয়াটসঅ্যাপে তো এখন কাজের কত নোটিফিকেশন আসে। সবমিলিয়ে মোবাইল ফোনটা খুব কাজের।
লিখেছেন: মনীষা মুখোপাধ্যায়, শান্তনু দত্ত, মানসী নাথ