আয়ুর্বেদ কি শুধুই চিকিৎসাবিজ্ঞান? আয়ুর্বেদ কি কেবল পরম্পরাভিত্তিক একপ্রকার বৈদিক চিকিৎসা শাস্ত্র মাত্র! না। আয়ুর্বেদ শব্দের মূল অর্থই হল জীবন সম্বন্ধীয় পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান। জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত অজস্র স্বতন্ত্র নীতিমালা রয়েছে আয়ুর্বেদে যেগুলি একদিকে যেমন মানবদেহের সুস্থতা ও দীর্ঘায়ুর কথা বলে অন্যদিকে রোগের পূর্বরূপ দেখে রোগ প্রতিরোধ করা থেকে রোগাক্রান্ত রোগীর নিরাময়ের পথ দেখায়।
আমরা সকলেই কিন্তু জ্ঞানত বা অজ্ঞানত প্রতিদিনই আয়ুর্বেদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত রয়েছি। রান্নাঘরের প্রতিটি ভেষজ মশলা থেকে সিংহভাগ দ্রব্যসামগ্রীই আয়ুর্বেদের দ্রব্যগুণে সমৃদ্ধ। আবার দ্রব্যের ব্যবহার জানি কিন্ত অধিকাংশ মানুষই জানি না কোন খাদ্যের সঙ্গে কোন খাবার বিষক্রিয়া ঘটায়, কোন খাবারগুলি নিত্য সেবনীয়, কোনগুলি নয়।
এই বছরের জাতীয় আয়ুর্বেদ দিবসের থিম হল ‘প্রতিদিন প্রতিটি বাড়িতে আয়ুর্বেদ’। প্রশ্ন হল এই থিমের অর্থ কী? ভেঙে বললে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র আমাদের শেখায়, আদর্শ জীবনযাত্রা। অর্থাৎ যে শৈলী মেনে জীবন কাটালে রোগ আমাদের স্পর্শও করতে পারবে না। কিংবা করলেও জীবনের সাধারণ উপাদানগুলি দিয়েই আমরা তার প্রতিকার করতে পারব।
১. দিনচর্যা ও ঋতুচর্যা: প্রতিদিন ব্রাহ্ম মুহূর্তে অর্থাৎ সূর্য ওঠার ঘণ্টা খানেক আগে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস শরীর ও মনের পক্ষে সুফলদায়ক। এছাড়াও নিয়মিত রূপে নির্দিষ্ট সময়ে মলত্যাগের অভ্যেস কোষ্ঠকাঠিন্য, অর্শ এবং অন্যান্য রোগের হাত থেকে রেহাই দেয়। তারপর অভ্যঙ্গ (তেল মাখা), ব্যায়াম, স্নান ইত্যাদি একসঙ্গেই দিনচর্যার মধ্যে পড়ে। অন্যদিকে ঋতুচর্যার অর্থ হল প্রত্যেক ঋতুতে নির্দিষ্ট আহার বিহার, পথ্য অপথ্য সেবনের মাধ্যমে নীরোগ থাকা।
২.নিত্য সেবনীয় আহার তালিকা: চরক সংহিতা মতে যে সকল খাদ্যদ্রব্য নিয়মিত রূপে সেবন করা যায় সেগুলি হল, শালিধান্য, মুগ, সৈন্ধব লবণ, আমলকী, দুধ, ঘি, জাঙ্গম মাংস অর্থাৎ (জলচর নয় এমন প্রাণীর মাংস) মধু ইত্যাদি।
৩. নিত্য অসেবনীয় আহার তালিকা: যে সকল খাদ্যদ্রব্য প্রত্যহ নিয়মিতরূপে সেবন শরীরের পক্ষে অহিতকারক সেগুলি হলো কুর্চিকা (দইয়ের ঘোল ও দুধ দ্বারা নির্মিত) দই, মাছ, বিবিধ মাংস, উরদ (মাষকলাই), যব ইত্যাদি।
৪.বিরুদ্ধ আহার: সর্বদা বিশেষ করে সংযোগ বিরুদ্ধ, মাত্রা বিরুদ্ধ আহারগুলি একেবারেই এড়িয়ে চলা উচিত। যেমন—
• দুধের সঙ্গে কাঁঠাল, মাছ, লবণ, খিচুড়ি, মুলা, জাম, ছাতু, তরমুজ ইত্যাদি।
• দইয়ের সঙ্গে ক্ষীর,পনির, দুধ, গরম পদার্থ, কলা ইত্যাদি।
• ঘি ও মধু মাত্রামাত্রায় নৈব নৈব চ।
• তামার পাত্রে ঘি, গরম মধু সেবন, ঘি-এর সঙ্গে ঠান্ডা জল পান, রাতে ছাতু খাওয়া, পায়েস ও ঘোল একসঙ্গে সেবন, পুঁইশাকের সঙ্গে তিল ইত্যাদি।
৫. পারিবারিক ভেষজ বাগান: উঠোন হোক বা ছাদ অথবা ব্যালকনি। একফালি ছোট জায়গা থাকলেই খুব অনায়াসেই গড়ে তুলতে পারেন ভেষজ বাগান যা আপনার কাছে হয়ে উঠতে পারে সুস্বাস্থ্যের বিশেষ চাবিকাঠি। মূলত ঘৃতকুমারী, কালমেঘ, ব্রাহ্মী, তুলসী, গুলঞ্চ, পুদিনা, বাসক, থানকুনি ইত্যাদি ভেষজ উদ্ভিদের রোপণ বাড়িতেই করা যায়
যা আপদে বিপদে চটজলদি পুরো পরিবারকে প্রাকৃতিকভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাহায্য করবে।
৬. রান্নাঘর যখন একটি পারিবারিক সুস্বাস্থ্য কেন্দ্র: রান্নাঘরের অধিকাংশ দ্রব্যই ভেষজ গুণে সমৃদ্ধ। সবধরনের মশলায় যেমন অসংখ্য স্বাস্থ্যগুণ রয়েছে তেমনই রয়েছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির শক্তি। অন্যদিকে চাল, ডাল যাতে পালিশহীন হয় সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত ও তেল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই সেটিও যাতে খাঁটি সেবন করা হয় তার দিকেও খেয়াল রাখা দরকার।
এছাড়াও যতটা সম্ভব ননস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে রান্না এড়িয়ে চললে ধাতব বিষক্রিয়া থেকে রেহাই পাওয়া যায়। খাদ্যদ্রব্য যাতে সুপাচ্য, সুস্বাদু হয় ও অধিক পুষ্টিগুণ যুক্ত থাকে সেদিকে সর্বদা নজর দেওয়া উচিত।
৭. অধ্যসন ও আহার মাত্রা: আয়ুর্বেদের সংহিতায় ‘রোগা সর্বাদপি মন্দ্যাগ্নি’ অর্থাৎ সমস্ত রোগের মূল কারণ হিসেবে মন্দ্যাগ্নিকে দায়ী করা হয়েছে। এখানে এই অধ্যসন অর্থাৎ পূর্ববর্তী খাদ্য হজম হওয়ার আগেই পুনরায় খাবার খেলে তা অধ্যসন হয় যা বিভিন্ন রোগের উৎপত্তির কারণ তাই খিদে পেলে তবেই খান। আহার মাত্রা সর্বদা এমন হবে যাতে পাকস্থলীর এক চতুর্থাংশ ফাঁকা থাকে।
৮. যে সকল বেগসমূহ কখনই ধারণ করবেন না: হাঁচি, কাশি, তৃষ্ণা, ক্ষুধা, উদ্গার, কান্না, নিদ্রা, বমি, মল, মূত্র ইত্যাদি বেগ নিয়মিত নিয়ন্ত্রণ করলে বা দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখলে বিবিধ প্রকার দুরারোগ্য ব্যাধি হয় তাই উক্ত বেগসমূহ কখনই ধারণ করবেন না।
৯. জলপানের নিয়ম: সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে প্রত্যহ নির্দিষ্ট সময়ে পরিমাণ মতো জলপানের গুরুত্ব অপরিসীম। আয়ুর্বেদ মতে— ‘অজীর্ণে ভেষজং বারি জীর্নে বারি বলপ্রদম।
ভোজনে চামৃতং বারি ভোজনান্তে বিষপ্রদম।।’
অর্থাৎ অজীর্ণ রোগে জল প্রধান ওষুধ, খাওয়ার জীর্ণ হওয়ার পর জলপান বলপ্রদ।
ভোজনকালে জলপান অমৃতসম, ভোজনের তৎক্ষণাৎ পর জলপান বিষের ন্যায় ক্ষতিকর।
১০. দৈনন্দিন সদবৃত্ত সুখের চাবিকাঠি: শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রফুল্লতা বজায় রেখে জীবনকে সহজ ও সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে সদবৃত্ত (বিশেষ কিছু শিষ্টাচার) অন্যতম উপায়।
আয়ুর্বেদমতে লোভ, লালসা, ভয়, ক্রোধ, আসক্তি, শোক ইত্যাদি বেগ ধারণ করা উচিত পাশাপাশি সর্বদা সদ্ভাব, মধুর ভাষণের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিনয়ী, সত্যবাদী হলে মানুষ মানসিক সন্তাপ থেকে মুক্ত থাকে যা পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভের জন্য অতি প্রয়োজনীয়।